ক্রীড়া সংগঠক, রাজনীতি, সমাজ সেবাঃ নানান রূপে বিশ্বরূপ

    0

    ◆সন্দীপ দে◆

    ২৪ অক্টোবর : বিজয়া দশমীর সন্ধ‍্যা। ১২৫ এ বিপীন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের ১২৩ বছরের অনাথ আশ্রম ‘রেফিউজ’-এর প্রাচীন দূর্গা পুজার বিসর্জনের ঠিক আগে মাকে বরন করে নিচ্ছিলেন এলাকার মহিলারা। তারই মাঝে ফর্সা,ছিপছিপে ১৪ বছরের গণেশ ফুটবলের জার্সি,শর্টস পড়ে মা দূর্গার পা ছুঁয়ে আর্শীবাদ নিচ্ছিল। বিজয়ার সিঁদুর খেলায় ব‍্যস্ত মহিলারা হয়তো অনেকেই জানেন না গণেশের পরিচয়। কে এই গণেশ? কি তার পরিচয়? শুনলে শুধুই বিস্ময় জাগে। এভাবেও জীবনের মূল স্রোতে ফেরা যায়? নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে। চরম বিস্ময়ে বিভোর হতে হয় মনের অজান্তেই।

    আজ থেকে দেড় দশক আগে বৈষ্ণবঘাটা পাঁটুলির বাইপাসের ফুটপাথে এক পাগলি মা তাঁর সন্তানকে নিজের কোমরে দড়ি বেঁধে নিজের সন্তানকে আগলে রেখেছন। কখনও সন্তানের মুখে নিজের স্তন গুঁজে দিচ্ছেন। আবার কখনও নিজের খেয়ালে তিন মাসের সন্তানকে ধূলোবালি মাখাচ্ছেন। সেই পাগলি মা আর তাঁর সন্তান তিলে তিলে এগিয়ে চলেছিল এক মর্মান্তিক পরিণতির দিকে। পাগলি মা নিজের সন্তানকে নিয়ে যে ফুটপাথে রাতদিন কাটাতেন তার ঢিল ছোড়া দুরত্বে পুলিশ ফাঁড়ি। পুলিশ কখনও পাগলি মার দিকে ভুলেও তাকায়নি। পথচলতি মানুষও দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেছেন। ২০০৭ সালে এমন মর্মান্তিক ঘটনা প্রকাশ হয়েছিল বাংলার এক দৈনিক সংবাদপত্রে। সেই খবর পড়েই পাঁটুলি গিয়ে পাগলি মা ও তাঁর সন্তানকে নিজেদের অনাথ আশ্রম ‘রিফিউজ’-এ নিয়ে এসেছিলেন বিশ্বরূপ দে। সেদিনের তিন মাসের পুত্র সন্তানই আজকের গণেশ। নবম শ্রেণিতে পড়ে। আশ্রমের সবার প্রিয় গণেশ। তবে তার মা আর বেঁচে নেই। চার বছর আগেই পাগলি মায়ের ‘রেফিউজ’-এ মৃত‍্যু হয়।

    গণেশের মতো অবস্থা ছিল কার্তিকেরও। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের আস্তাকুঁড়ের পাশ থেকে ছোট্ট কার্তিক ও তার মানসিক ভারসাম্যহীন মাকে উদ্ধার করে নিয়ে ‘রিফিউজ’-এ নিয়ে এসে আশ্রয় দিয়েছেন বিশ্বরূপ। কার্তিক,গণেশ নামকরণ ‘রিফিউজ’ই করেছে।

    কদিন আগেই ‘ইনসাইড স্পোর্টস’ তুলে ধরেছিল মহমেডান ক্লাব সচিব রাজু ওরফে ইসতিয়াক আহমেদের মানবিক দিক গুলি। ক্রীড়া সংগঠন,রাজনীতির কাজের ফাঁকে এহেন বিশ্বরূপ দের সমাজসেবার কাজ প্রশংসনীয়। এ যেন নানান রূপে বিশ্বরূপ।

    বিশ্বরূপ ছাত্র জীবনে করতেন কংগ্রেস। তারপর চলে আসেন ক্রীড়া সংগঠনে। জগমোহন ডালমিয়ার হাত ধরে সিএবির গুরুদায়িত্ব সামলেছেন বহু বছর। এখন তিনি বৌবাজার এলাকার ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। এলাকায় তিনি জনপ্রিয় হয়েছেন নিঃস্বার্থ কাজের জন‍্য। নিজের ওয়ার্ডে বিশ্বরূপই যেন মুশকিল আসান। সাধারণের জন‍্য প্রতিনিয়ত ডিম ভাত খাওয়ানো থেকে দুস্থদের চশমা দেওয়া, অসুস্থদের চিকিৎসার ব‍্যবস্থা করা – কোনও কিছুই বাদ নেই। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সঙ্গে একাধিক দূর্গা পুজার আয়োজন।

    তবে তাঁর বিশাল কর্মকান্ড অনাথ আশ্রম ‘রিফিউজ’কে কেন্দ্র করেই। ১৯০১ সালে এই ‘রিফিউজ’ প্রতিষ্ঠত। তার আগে বৌবাজারের এই বিশাল অট্টালিকায় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার আস্তাবল ছিল। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ আমলে এখানেই সিরাজের গোপন আশ্রয়স্থলও ছিল। কথিত আছে, এই অনাথ আশ্রমের পিছনে একটি কবরস্থানে নবাব সিরাজের সেনাপতিকে কবর দেওয়া হয়েছিল। ১৯০১ সালে যখন ‘রিফিউজ’ প্রতিষ্ঠা পায় তখন সক্রিয় ভূমিকা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। পরবর্তীকালে এই অনাথ আশ্রমের দায়িত্ব আসে চন্দ্র কুমার দে’র হাতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,এই চন্দ্র কুমার দে ছিলেন রামকৃষ্ণ দেবের চিকিৎসক। চন্দ্রবাবু প্রথম এম ডি ছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগর বিধবা বিবাহ আইন নিয়ে যখন লড়াই শুরু করেছিলেন তখন পাঁচ জন এই আইনের প্রস্তাবক ছিলেন। সেই পাঁচজনের মধ‍্যে একজন হলেন এই চন্দ্র কুমার দে। এই চন্দ্র কুমার দে হলেন বিশ্বরূপের দাদুর দাদু। ‘রিফিউজ’-এর দায়িত্ব সেই চন্দ্র কুমার দে থেকে চলে আসছে। গত ২২ বছর ধরে এখন দক্ষতার সঙ্গে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রীড়া সংগঠক বিশ্বরূপ দে।

    এই ‘রিফিউজ’-এর কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়ে নিজের চোখে দেখে গিয়েছেন পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার শাহিদ আফ্রিদি। কয়েক বছর আগে বিসিসিআইয়ের ত‍ৎকালীন সভাপতি সস্ত্রীক শ্রীনিবাসন ‘রিফিউজ’-এ এসে এক কোটি টাকা দিয়ে বড় বিল্ডিং তৈরি করে দিয়েছেন। এই অনাথ আশ্রমে প্রায় চারশো ছেলে মেয়ে থাকে। এদের থাকা,খাওয়া পড়াশোনার সব দায়িত্ব রিফিউজের। কয়েক বছর আগে রবি শাস্ত্রী ‘রিফিউজ’-এর ইন্ডোর গেমের উদ্বোধন করে গিয়েছেন। এখানে টেবল টেনিস,জুডো,জিমন‍্যাস্টিক্স এবং দাবা খেলার চর্চা হয়। মাঠের অভাবে ফুটবল ও ক্রিকেটটা শুরু করতে পারছেন না বলে জানালেন বিশ্বরূপ দে।

    নিজের কাজের সঙ্গে এই সমাজসেবা মূলক কাজ করার সময় পান কি করে? ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-এর প্রশ্নের উত্তরে বিশ্বরূপ দে বলছিলেন,”এই কাজের একটা অদ্ভুত নেশা আছে। যারা এই কাজ করে তারাই মর্ম বুঝবে। কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। বিশ্বাস করুন, এই কাজে অদ্ভুত একটা তৃপ্তি পাই।” ইদানিং দেখা যাচ্ছে, ‘কিছু’ ব‍্যক্তি সমাজ সেবা মূলক কাজ করছেন একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। আপনি সেটা মানেন? বিশ্বরূপ বলেন,”সমাজটাই এখন বদলে গেছে। নিজের স্বার্থ ছাড়া কেউ ভাবতেই চায় না। আমার পরিস্কার ভাবনা হল, কাজ করতে হলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে,মন থেকে করো। আর তা যদি না করতে পারো কোরো না। মাঝামাঝির জায়গা নেই। তবে এটাও ঠিক,এখনও অনেক মানুষ আছেন যারা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন। তবে এঁদের সংখ‍্যাটা কমে আসছে। এটাই চিন্তার বিষয়।”

    আপনি তো এখন সিএবির কোনও পদে নেই। বড় জায়গায় না থাকলে কাজ করতে সমস‍্যা হয় না? প্রশ্নটাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বিশ্বরূপ বলতে থাকলেন, “কিসের সমস‍্যা? খেলার মাঠই আমাকে অক্সিজেন জোগায়। আমার কলকাতা লিগের ক্লাব আছে। এছাড়াও অনেক ছোট ছোট খেলার সংগঠনের সঙ্গে আমি সক্রিয়ভাবে যুক্ত। কাজ করাটা আসে সেই কাজের উপর ভালবাসা থেকে। সেই ভালবাসা আমার থাকবে।”

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here