◆সন্দীপ দে◆
তিনি একদিকে আইএফএ-র চেয়ারম্যান। অন্যদিকে ময়দানের দক্ষ ক্রীড়া সংগঠক। ফুটবলের সঙ্গে বাংলার ক্রিকেট জগতেও তাঁর প্রভাব আছে। সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তা ময়দানে কান পাতলেই শোনা যায়। এআইএফএফের নব নিযুক্ত সভাপতি কল্যাণ চৌবেও তাঁকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন। তিনি সুব্রত দত্ত। নিজের ভবিষ্যতের জন্য কি ‘রোড ম্যাপ’ তৈরি করেছেন? তিনি কি ক্রিকেট প্রশাসনে আসছেন? আইএফএ-এর অন্দরে “ওরা-আমরা”-র লড়াই বন্ধ করতে পারবেন? ‘দত্ত পরিবার’র উত্তরসূরী হিসেবে কতটা সফল হতে পারবেন অনির্বান-অধিরাজ? ময়দানের রাজনীতির মান কমছে কেন? ভবানীপুরে নিজের অফিসে বসে ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-এর এক ঝাঁক প্রশ্নের খোলামেলা উত্তর দিলেন সুব্রত দত্ত।
প্রশ্নঃ সামনেই CAB তে নির্বাচন। ময়দানে শোনা যাচ্ছে, রাজ্য ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা CAB -এর প্রশাসনে নাকি এবার সুব্রত দত্তকে দেখা যাবে। অতীতে আপনার বাবা কিংবদন্তি ক্রীড়া প্রশাসক বিশ্বনাথ দত্ত আইএফএ থেকে CABতে গিয়েছিলেন। এবার কি ছেলেও বাবার পথ অনুসরণ করছেন?
সুব্রত দত্তঃ জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাবের সচিব আমি। আমাদের জর্জ ফুটবলের সঙ্গে সিএবি লিগও খেলে। সেই কারণে সিএবিতে আমাদের ক্লাব থেকে প্রতিনিধিত্ব করতাম। অতীতে একটা সময় সিএবির একাধিক কমিটিতে ছিলাম। ক্রিকেট প্রশাসনে হয়তো অফিস বেয়ারার্স ছিলাম না কিন্তু ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু কয়েক বছর আগে আদালতের রায় বেড়োলো। রায় বলা হয়েছিল অন্য কোনও ক্রীড়া সংস্থার পদে থাকলে ক্রিকেট প্রশাসনে সক্রিয়ভাবে থাকা যাবে না। তাই সিএবি ছেড়ে শুধু ফুটবল নিয়েই ছিলাম। এখন আবার আদালতের নতুন রায়ে বদলে গেছে। অন্য ক্রীড়া সংস্থায় থেকেও ক্রিকেট প্রশাসনেও থাকা যায়।
প্রশ্নঃ তার মানে আপনাকে এবার সিএবির প্রশাসনে দেখা যাবে?
সুব্রত দত্তঃ কথাটা হচ্ছে, আমি যেহেতু জর্জের সঙ্গে জড়িত তাই ময়দানের বহু ক্রিকেট ক্লাব কর্তার সঙ্গে আমার ভাল সম্পর্ক। হয়তো সেই কারণেই সিএবির কিছু কর্তা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। নির্বাচনে সাহায্য চাইছেন। আমি যাতে সিএবি প্রশাসনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত কাজ শুরু করি সেই ব্যাপারেও কর্তারা আমাকে বলেছেন। ঠিক এই মুহূর্তে সিএবিতে যাওয়ার জন্য আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত নই। সিএবিতে যাব কিনা এখনও ঠিক করেনি। তবে সিএবি কর্তারা যদি আমার অভিজ্ঞতা কাছে লাগাতে চায় তাহলে লাগাতেই পারে। কিন্তু এটা যেন কেউ না ভাবে সিএবিতে কোনও পদের লোভে যেতে চাই। আমি উচ্চাকাঙ্খি নই।
প্রশ্নঃ আমি যতদুর জানি, একটা সময় আপনি তো বাবা বিশ্বনাথ দত্তর হাত ধরেই সিএবিতে যেতে পারতেন। বাবার পরিচয়ে সিএবিতে যেতে চাননি।
সুব্রত দত্তঃ বাবা মাঠ ছেড়েছিলেন ১৯৯২ সালে। আর আমি জর্জটেলিগ্রাফ দিয়ে ক্রীড়া সংগঠনের কাজ শুরু করেছিলাম ১৯৯৬ সালে। পরে যদিও জগুদা (জগমোহন ডালমিয়া) আমাকে বহুবার সিএবিতে এসে কাজ করতে বলেছিলেন। আমি রাজি হইনি। প্রথমত, আমার লক্ষ্য ছিল ফুটবল। দ্বিতীয়ত,
আমি চাইনি বাবার জন্য জগুদা আমাকে কোনও পদ পাইয়ে দিক।
প্রশ্নঃ ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে একবার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,পদ থাক বা না থাক, কখনও সংগঠন ছাড়তে নেই। সংগঠনের কাজ করাটাই আসল কাজ। প্রশ্ন হল, ক্ষমতা না থাকলে সংগঠনের কাজ করাটা কতটা কঠিন?
সুব্রত দত্তঃ সংগঠন হল ক্লাব গুলোকে নিয়ে কাজ করা। ক্লাব,জেলাকে গুরুত্ব দেওয়া। ক্রীড়া উন্নয়ের স্বার্থে। একটা সময় বছরের পর বছর বাবা-কাকা সংগঠনের কাজ করেছেন। পরে আমি করেছি। এখন অনির্বান করছে। ক্ষমতা না থাকলে সংগঠনের কাজ করা যায় না এটা বিশ্বাস করি না। তবে হ্যাঁ, সংস্থার প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ক্লাব সংগঠনের কাজে সুবিধা হয়।
প্রশ্নঃ একটা সময় সবাই ধরেই নিয়েছিল যে, আপনিই ফেডারশের সভাপতি হচ্ছেন। কিন্তু পাশার দান উল্টে গেল। এমনটা হবে ভাবতে পেরেছিলেন?
সুব্রত দত্তঃ তোমার এই প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা গানের লাইন মনে পড়ছে -“আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।”
AIFF সভাপতি হতে চেয়েছিলাম কারণ, অধিকাংশ রাজ্য আমাকে চেয়েছিল। আমার কিছু পরিকল্পনা,স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বাস্তবায়িত করতে পারিনি। সহ-সভাপতি ছিলাম। সিদ্ধান্ত নিতেন সভাপতি। এক্সিকিউটিভ মিটিংয়ে বহু পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম। কোনওটা পাশ হয়েছিল তো বাস্তবায়িত হয়নি। আবার প্রস্তাব গৃহীতই হয়নি। রাজ্য সংস্থার লাইসেন্স, স্ট্রাইকার ক্লিনিক করতে চেয়েও পাশ হয়নি।
প্রশ্নঃ আপনি কখন বুঝলেন যে, চাকা উল্টো দিকে ঘুরছে? কোনও ক্ষোভ, দূঃখ আছে?
সুব্রত দত্তঃ সভাপতি হতে না পারার জন্য আমার কোনও দূঃখ নেই। ক্ষোভ নেই। আমার এখন বয়স ৫০ বছরের উর্দ্ধে। COA যে সংবিধান বদলে ফেলল তার ফলে আইনের কারণে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারিনি। মেনে নিয়েছি। তবে রাজনৈতিক কারণে কিন্তু আমার সভাপতি হওয়া হল না, এটা ঠিক নয়। কল্যাণ চৌবেকে আমার কিছু পরিকল্পনার প্রজেক্ট আমি দিয়েছি। নতুন কমিটি হয়েছে। আশাকরি কল্যাণের নেতৃত্বে ভারতীয় ফুটবল এগিয়ে যাবে। আমার বিশ্বাস কল্যাণ পারবে।
প্রশ্নঃ আপনি ২৭বছর ধরে ক্রীড়া সংঠনের কাজ করছেন। আপনার বয়স বাড়ছে। বিশ্বনাথ দত্তর পর প্রদ্যোৎ দত্তর পরে আপনি এসেছেন। বাংলার ক্রীড়া জগতে “দত্ত পরিবার”-এর ‘ব্যাটন’ এখন অনির্বান দত্ত ও অধিরাজ দত্তর হাতে। তারা কি “দত্ত পরিবার”-এর সুনাম, সাফল্য ধরে রাখতে পারবে?
সুব্রত দত্তঃ জর্জ টেলিগ্রাফ শুরুই করেছিলেন আমার দাদু হরিপদ দত্ত। তারপরে বাবা,কাকার পর আমি এসেছি। এখন অনির্বান,অধিরাজ এসেছে। যে যার যোগ্যতায় জায়গা করেছেন। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলার ফুটবল,ক্রিকেটের মালিক আমরা নই। আমি বিশ্বনাথ দত্তর ছেলে বলে আমি সব পদ পেয়ে যাব। এটা হতে পারে না। যার যা যোগ্যতা তাকেই প্রমান করতে হবে। ভবিষ্যতে যদি অনির্বান, অধিরাজ কাজ করতে পারে, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে তাহলে প্রশাসনে থাকবে।
প্রশ্নঃ ময়দানের পরিবেশ বদলে গিয়েছে। যোগ্য লোকের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। ময়দানে আগেও রাজনীতি ছিল, এখনও আছে,ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু এখনকার ‘ময়দানি রাজনীতি’ কি সুস্থ রাজনীতি?
সুব্রত দত্তঃ মানুষের জীবনটাই এখন বদলে গেছে। আগে সহজ থাকলেও এখন কঠিন জীবন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ময়দানে হয়তো ভাল মানুষ আসছে না। আসতে চায়ছে না। অবক্ষয় তো সর্বস্তরেই হয়েছে। ক্রীড়া জগতেও অবক্ষয় হয়েছে। তবে রাজনীতি সর্ব স্তরেই আছে। এই পৃথিবী রাজনীতি মুক্ত নয়। ময়দানের রাজনীতির কথা বলছো, দেখতে হবে এই রাজনীতি গঠন মূলক নাকি ধ্বংসাত্মক। রাজনীতি করুক কিন্তু গঠন মূলক হওয়া উচিত। যারা ধ্বংসাত্মক রাজনীতি করছে তাদের বোঝাতে হবে। সংস্থার ক্ষতি মানে নিজেরও ক্ষতি। আমি এমন কোনও কাজ করব না যাতে সংস্থার ক্ষতি হয়। যারা নেতৃত্ব দেয় তারা উত্তরসূরী তৈরি করেন। সেটারও এখন অভাব।
প্রশ্নঃ আপনার ভাই এখন IFA সচিব। অনির্বানের কোষাধ্যক্ষ, সচিব হওয়ার কঠিন লড়াইয়ের সময় আপনি নীরব ছিলেন। আপনার এই নীরবতার অর্থ কি?
সুব্রত দত্তঃ আমি ওর দাদা বলেই নীরব ছিলাম। বাবার কাছে শিখেছি, ক্লাব যদি চায় তাহলে নিজের যোগ্যতায় আসবে। আমার হাত ধরে ভাই আসবে কেন? মানুষ প্রশ্ন করবে। আমি এক্ষেত্রে ওর বিরোধী। অনির্বানকে বলেওছি সেটা। এটা ওর ভালর জন্যই করেছি। ক্লাব চেয়েছে বলেই অনির্বান সচিব হয়েছে। যোগ্যতা না থাকলে স্থায়ীভাবে কাজ করা যায় না। ওই জন্যই আমি আবার বলছি, পদের থেকে সংগঠন বেশি জরুরি। অনির্বান যদি সংগঠন করে ক্লাবের সমর্থন ধরে রাখতে পারে তাহলে থাকবে।
প্রশ্নঃ IFAতে এখন তো “ওরা-আমরা”-র লড়াই চলছে। অসুস্থ লড়াই। ময়দান জানে সে কথা। যে কোনও সংস্থায় বিরোধী গোষ্ঠী থাকেই। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যেভাবে চলছে তা মনে হয় IFA-এর ইতিহাসে আগে কখনও এমন হয়েছে কিনা জানি না। সভাপতি অজিত ব্যানার্জি, আপনি আছেন। চেয়ারম্যান তো ইচ্ছে করলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারেন?
সুব্রত দত্তঃ সচিব-সভাপতির সঙ্গে অন্যদের একটা দুরত্ব তৈরি হয়েছিল ঠিকই। এটা যাতে আর না হয় তার জন্য গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সবাইকে নিয়ে বৈঠক করেছি। IFAএর সংবিধান মতে ১২বি ধারা অনুযায়ী প্রশাসনে মতপার্থক্য হলে সমস্যার সমাধানের জন্য চেয়ারম্যান সভা করতে পারে। আমি সেটাই করেছি। ঠিক হয়েছে একদিন অন্তর একদিন নিজেদের মধ্যে বসে আলোচনা করবে। পাশাপাশি সচিব ও সভাপতি তাৎক্ষণিকভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। সেক্ষেত্রে পরবর্তী মিটিংয়ে বাকি অফিস বেয়ারার্সদের বুঝিয়ে বলে দিলেই হবে। পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব যাতে না হয় তার জন্য সবাইকে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে চলতে হবে। অফিস বেয়ারার্সদের মধ্যে মত বিরোধ, তর্কাতর্কি সংস্থার পক্ষ্যে ভাল নয়। আশাকরছি সমস্যা মিটেছে।
প্রশ্নঃ অনির্বান দত্ত তিন মাস হল সচিব হয়েছেন। চেয়ারম্যান হিসেবে কত নম্বর দেবেন?
সুব্রত দত্তঃ আমি অনির্বানের দাদা। যদি নম্বর দিই তাহলে লোকে বলবে আমি বেশি নম্বর দিচ্ছি। গড়ের মাঠের ক্লাব কর্তারা নম্বর দিক। সেটাই অনির্বানের কাছে আসল নম্বর। ক্লাব বেশি নম্বর দিলে অনির্বান বেশিদিন সচিব থাকবে। কাজেই আমার নম্বর দেওয়াটা ঠিক হবে না।