কোচিং লাইসেন্স না করাটা সুভাষ-সুব্রতর ঐতিহাসিক ভুল : জহর

0


সন্দীপ দে ◆ মালদা

গত সাতদিনে কুশমন্ডি ও মালদার মন জয় করে বাড়ি ফিরছেন বাংলার অভিজ্ঞ কোচ জহর দাস। উপকৃত মালদা ক্লাব ও ওয়াইএমএ কোচিং ক‍্যাম্পের ফুটবলাররা। বাড়ি যাওয়ার আগে মঙ্গলবার দুপুরে মালদা সার্কিট হাউসের ঘরে বসে ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে খোলামেলা সাক্ষাৎকার দিলেন প্রখ‍্যাত ফুটবল কোচ জহর দাস।

প্রশ্ন : পিকে ব‍্যানার্জি বছরের পর বছর টানা কোচিং করিয়ে গিয়েছেন। সাফল‍্যও পেয়েছেন। আপনার ফুটবলে এত পান্ডিত‍্য থাকা সত্বেও আপনি কেন ময়দানে টানা কোচিং করতে পারলেন না?

জহর দাস : নিজেকে কলকাতা কেন্দ্রিক করে তুলিনি। সুভাষ, সুব্রতর মতো কোনও বড় ক্লাব নেই, তাই কোচিং করাবো না, ঠিক তা নয়। কোচিংয়ের জন‍্য যে কোনও জায়গা যেতে আমার সমস‍্যা নেই। অন‍্যভাবে নিও না, প্রদীপদা যা করেছে তাই দিয়ে কিন্তু ফুটবলের সামগ্রিক অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেননি। অমলদা, আমাদের বলতেন,”আমার সব কেড়ে নিতে পারবি কিন্তু অভিজ্ঞতা কেড়ে নিতে পারবি না। এই জন‍্যই বিভিন্ন জায়গা থেকে অমলদা ডাক পেয়েছিলেন। ওড়িশায় দুই আড়াই বছর থেকে কোচিংও করিয়েছিলেন। আসলে কি জানো সন্দীপ, কিছু কোচ আছে নিজের জায়গা ছাড়ে না। আর না ছাড়ার জন‍্য কিন্তু ওই সব কোচেরা অনেক কিছু করে যা তোমাকে বলতে পারবো না। বলতে চাইও না।
প্রশ্ন : প্রদীপদা, অমলদার পর কয়েক বছর সুভাষ ভৌমিক ও সুব্রত ভট্টাচার্য বড় ক্লাবে কোচিং করে সাফল‍্য পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, অলোক মুখার্জি, সঞ্জয় সেন (এখন এটিকে মোহনবাগানের সঙ্গে যুক্ত), শঙ্করলাল চক্রবর্তীরা উঠে এসেছিলেন। একটা সময়ের পর ওরা হারিয়ে গেলেন।

জহর দাস : সুভাষ-সুব্রত বড় ক্লাব ছাড়া কোচিং করাতে চায় না। বিশ্বজিতের আরও অ‍্যাক্টিভ হওয়া উচিত ছিল। কোচিংয়ে সঠিকভাবে সব কিছু বিশ্বজিৎ মেনটেইন করেছে। A লাইসেন্স যদি কেউ ভালভাবে করে থাকে, তাহলে বিশ্বজিৎ তাদের মধ‍্যে একজন। ওর এবারই মহমেডানের দায়িত্ব পাওয়া উচিত ছিল।

প্রশ্ন : বিদেশি কোচেদের জন‍্যই কি বাঙালি কোচেরা হারিয়ে গেল? কে বা কারা দায়ী?

জহর দাস : বাঙালি কোচেরা সুযোগ না পাওয়ার জন‍্য আমি দুটি কারণ উল্লেখ করব। এক) সব থেকে বেশি দায়ী ক্লাব ও অ‍্যাসোসিয়েশনের কর্তারা। বিদেশি কোচ এনে বাড়িতে ও পাড়ায় হিরো হয়। দুই) দর্শকরা যে কোনও স্তরের বিদেশি কোচেদের গ্রহণ করে নেয়। তাদের প্রতি ধৈর্য দেখায়। আর বাঙালি কোচকে বেশিদিন গ্রহণ করে না। ধৈর্য‍্যও দেখায় না।

প্রশ্ন : আপনি বলতে চাইছেন, বাঙালি কোচেদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয় না?

জহর দাস : ঠিক ধরেছো। তুমি বলোতো, ভারতে আসা সব বিদেশি কোচ উন্নতমানের? তবে হাবাস ভাল। ইস্টবেঙ্গলে যা এখন পারফরম‍্যান্স বাঙালি কোচ হলে কবে তার চাকরি চলে যেত। ইস্টবেঙ্গল কোচ রবি ফাউলার বলছেন, কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পর সময় পাননি। তবু একমাসের বেশি সময় পেয়েছেলিন। কদিন দেখেই তো ফাউলার বলতে পারতেন যে, কিছু ইন্ডিয়ান আর চলবে না। এই কোচ ভাল‍?

প্রশ্ন : সুভাষ-সুব্রত দুই প্রধানে সাফল‍্য এনে দিয়েছিলেন। আজ তাদের লাইসেন্স থাকলে হয়তো আইএসএলে কোনও দলে কোচিং করাতেন।

জহর দাস : সুভাষ-সুব্রতর কোচিং লাইসেন্স না করাটা তাদের ঐতিহাসিক ভুল। আমি যখন লাইসেন্স করতে যায় তখন ভৌমিককে লাইসেন্স করে নিতে বলেছিলাম। তখন ভৌমিক আমাকে বলেছিল, ” ধুর, তোরা কর। আমি করব না। আমার ক্লাবের অভাব হবে না।”

প্রশ্ন : আপনাকে আমরা অমল দত্তর দ্বিতীয় সংস্করণ বলে মনে করি। আপনার কোচিং স্টাইল অমল ঘরানার?

জহর দাস : অমল দত্ত অনেক বড় মাপের কোচ। আমি যখন কাজ শুরু তখন আমি কাউকে নকল করতে যায়নি। কাজ করতে করতে এমনটা হয়ে ও গিয়েছে।

প্রশ্ন : মিজোরামে গিয়ে আইজলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দলটাকে তৈরি করেছিলেন। পরে দেখা গেল, আপনার জায়গায় কোচিং করাচ্ছেন খালিদ জামিল। আপনি জমি তৈরি করলেন। চাষও করলেন। ফসল তুলেলন খালিদ।

জহর দাস : মিনথান বলে একজন আইজল দলে ছিলেন। সবই তার হাতে ক্ষমতা। সে নিজেকে আমার সঙ্গে প‍্যারালাল করে তুলেছিল। আমাকে কন্ট্রোল করতে চেয়েছিল। থাকতে পারেনি, চলে আসি।

প্রশ্ন : আমি বিভিন্ন জেলায় ঘুরছি। প্রতিভাবান আদবাসি ফুটবলার বেশি চোখে পড়ছে। অতীতেও দেখেছি। অথচ বাংলা বা ভারতীয় ফুটবলে আদিবাসী ফুটবলাররা স্টার হতে পারেনি। কেন এমন হয়?

জহর দাস : ওদের লক্ষ‍্য নেই। কলকাতায় ওদের নিয়ে যেতে হলে একসঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। যেহেতু ওরা খুব কম পড়াশোনা করে তাই আদিবাসী ছেলেগুলিকে গ্রুমিং করতে হবে।

প্রশ্ন : এই যে জেলায় প্রশিক্ষণ দিয়ে গেলেন। ছেলেগুলিকে কেমন লাগল?

জহর দাস : কুশমন্ডি ও মালদা ক‍্যাম্পের ছেলেদের দেখলাম। আমি খুব তৃপ্ত। মালদা ক‍্যাম্পটা সবে দুই মাস শুরু হয়েছে। অনেক ছেলে মেয়ে আছে। পরিকাঠামো খুব ভাল। সব থেকে ভাল লেগেছে কর্তারা খেলোয়াড়দের কথা ভাবছে। একটু সময় লাগবে, চিন্তার কিছু নেই। এখান থেকেই ভাল ভাল ফুটবলার উঠে আসবে। তবে কুশমন্ডিতে ১২ টা ছেলে আছে। খুব ভাল। ওইরকম একটা গ্রামে এত ভাল ফুটবল কোচিং ক‍্যাম্প থাকতে পারে না গেলে জানতেই পারতাম না। ক‍্যাম্পটা চালায় শিবশঙ্কর পাল। জেলা ক্রীড়া সংস্থার যেটা করার কথা সেটা শিবশঙ্কর একাই নিজের উদ‍্যোগে করছে।

প্রশ্ন : জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্তাদের কাজ সম্পর্কে কিছু জেনেছেন?

জহর দাস : দেখো, জেলা ক্রীড়া সংস্থা অনেক কাজ করতে পারে না বা করে না। তোমাদের ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-এর মাধম‍্যে জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্তাদের অনুরোধ করব, আপনারা যদি কোনও কাজ করতে না চান, করবেন না ঠিক আছে। কিন্তু কুশমন্ডি, মালদা ক্লাবের প্রচেষ্টাকে ডিসটার্ব করবেন না।

প্রশ্ন : জেলার ফুটবলকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব?

জহর দাস : অবশ‍্যই সম্ভব। সবার আগে আইএফএকে এগিয়ে আসতে হবে। ইন্টার স্কুল ফুটবল আগে ফিরিয়ে আনতে হবে। আইএফএ একটা কোচিং কমিটি তৈরি করুক। সেই কমিটির সদস‍্যরা জেলায় গিয়ে কোচেদের সাহায্য করতে হবে। জেলার লিগ সহ বন্ধ হয়ে যাওয়া টুর্নামেন্ট চালু করতে হবে। জেলা লিগ চ‍্যাম্পিয়ন দলকে এক লক্ষ টাকা করে প্রাইজ মানি দিক আইএফএ। তাহলে আগ্রহ বাড়বে। তৃণমূল স্তরে যদি টাকা (প্রাইজ মানি) না থাকে তাহলে আগ্রহ তৈরি হবে না। একই সঙ্গে সব জেলার চ‍্যাম্পিয়ন দল গুলিকে নিয়ে একটা টুর্নামেন্ট করতে হবে। আর জেলার কর্তাদের টেকনিক্যাল কমিটি করতে হবে প্রাক্তন খেলোয়াড়দের নিয়ে। সেই কমিটি জেলার খেলার বিভাগটা দেখবে।

প্রশ্ন : নিজেকে কি উপেক্ষিত বলে মনে করেন? আক্ষেপ আছে?

জহর দাস : না। আমি উপেক্ষিত নই। আমার কোনও আক্ষেপও নেই। আমার যা কোয়ালিটি তার থেকে আমি বেশিই পেয়েছি।

প্রশ্ন : আর কতদিন কোচিং করবেন?

জহর দাস : আর তিন বছর কোচিং করাব। সবক্ষেত্রে একটা শেষ আছে। বয়সের কারণে তিন বছর পর মাঠে নেমে কোচিং করা সমস‍্যা হবে। মাঠে নামতে পারব না। আর চেয়ারে বসে কোচিং করা মানে ফাঁকিবাজি করা। ওটা করতে পারবো না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here