মামলার ফাঁসে সুব্রত-ভাস্করদের জেলায় ৩ বছর লিগ বন্ধ

0

◆সন্দীপ দে◆

গত ৩ বছর ধরে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ফুটবল লিগ বন্ধ। এই জেলা একটা সময় ভারতীয় ফুটবলের সাপ্লাই লাইন ছিল। এই জেলা থেকে অলিম্পিক ফুটবলে অংশ নিয়েছিলেন মহাবীর প্রসাদ,কেষ্ট পাল। এই জেলা থেকে উঠে এসেছেন সমরেশ চৌধুরী,ভাস্কর গাঙ্গুলি,সুব্রত ভট্টাচার্য,মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য,মিহির বসু থেকে অলোক দাস,দীপেন্দু বিশ্বাস,সংগ্রাম মুখার্জি,লালকমল ভৌমিকের মত কত কত ফুটবলার। মামলার ফাঁসেআটকে গিয়ে সেই জেলার ফুটবল লিগটাই হচ্ছে না। অভিযোগ,গত তিন বছর ধরে উত্তর২৪ পরগনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্তারা ইতিবাচক ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। বরং সেই সময়ের কমিটির কতিপয় কর্তা নিজেদের ভুল স্বীকার না করে সমস‍্যাটা বাড়িয়ে তুলেছেন বলে এমনটাই অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।

ঘটনার সূত্রপাত (২০১৯ সালে) ইছাপুর অনুশীলনী ও বেলঘরিয়ার নিমতা মিলন সমিতি ম‍্যাচকে কেন্দ্র করে। এই ম‍্যাচে নিমতার মিলন সমিতির ফুটবলার রাজু ভুঁইয়ার বৈধতা নিয়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থায় প্রতিবাদ করে ইছাপুর অনুশীলনী ক্লাব। তাদের প্রতিবাদ খতিয়ে দেখে লিগ সাব-কমিটি সিদ্ধান্ত জানায় যে, ফুটবলার রাজু বৈধ ফুটলার। এর পর ইছাপুর সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ওয়ার্কিং কমিটিতে যায়। এক মাস পর জেলা ক্রীড়া সংস্থার ওয়ার্কিং কমিটি ফুটবলার রাজু ভুঁইয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাসনে পাঠায়। এই সিদ্ধান্তর প্রতিবাদ করে এবার নিমতা মিলন সমিতি আরবিট্রেশনে যায়। আরবিট্রেটর নিয়োগ করা হয় স্থানীয় রবীন্দ্র কুমার দে-কে। এই আরবিট্রেটর ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তকে মান‍্যতা দেয়। কিন্তু মিলন সমিতি কর্তারা আরবিট্রেটরের নিয়োগ ও স্বচ্ছতাকে চ‍্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করেন।

প‍্যারাগন শিল্ডে এখনও দর্শকের ভিড় চোখে পড়ে।

মিলন সমিতি যখন মামলা করে সেই সময় আবার শ‍্যামনগরের যুগের প্রতীক ক্লাব কর্তারা জেলা ক্রীড়া সংস্থার অন‍্য একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করে বসে। যুগের প্রতীকের মামলার কারণ হল,২০১৯ এর লিগ শেষ হল না। তাহলে তাদের দলের স্ট‍েটাস কোন জায়গায় থাকল? পরের বছর প্রথম ডিভিশনে খেলবে নাকি সুপার ডিভিশনে খেলবে? সেই সিদ্ধান্ত না নিয়ে পরের বছরের জন‍্য ট্রান্সফার শুরু করে কোন নিয়মে? জেলা ক্রীড়া সংস্থার তৎকালীন কর্তারা ইতিবাচক উদ‍্যোগ নেয়নি বলে অভিযোগ। ফলে এই দুই মামলার ফাঁসে আটকে গিয়েছে জেলা ফুটবল লিগ।

এই মামলা নিয়ে আমরা যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম তাদের বক্তব‍্য তুলে ধরছি।

বিপ্লব দাশগুপ্ত,কর্তা,নিমতা মিলন সমিতি

বিপ্লব দাশগুপ্ত (অন‍্যতম কর্তা,বেলঘরিয়া নিমতা মিলন সমিতি)ঃ “আমাদের ফুটবলার রাজু ভুঁইয়া বৈধ ফুটবলার। ছেলেটি আমাদের জুনিয়র স্তর থেকে খেলে আসছে। রাজুর বাড়ি গয়সপুরে। কিন্তু বেলঘরিয়ায় তার মাসির কাছেই থাকে। আমাদের এখানকার নন্দননগর হাইস্কুলের ছাত্র। স্কুল সার্টিফিকেট,প‍্যানকার্ড সব বৈধ। ওই সময় আমাদের জেলার ফুটবলারদের রেজিস্ট্রেশন করার সময় প‍্যান কার্ড দেখা হত। সেই প‍্যান কার্ডও বৈধ। প্রথমে সব খতিয়ে দেখে রাজুকে বৈধ ফুটবলার ঘোষণা করল জেলা লিগ সাব কমিটি। পরে ওয়ার্কিং কমিটি বলল অবৈধ। কিন্তু কেন অবৈধ তার কারণ আমাদের বলেনি। আর আরবিট্রেটরের নিয়োগ ও তাঁর সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতার অভাব ছিল। সেই কারণেই আমরা আদালতে গিয়েছি। ফুটবল বন্ধ হোক কখনই আমরা চাই না। কিন্তু জেলার কিছু কর্তা নিজেদের মতো যা খুশি করবে সেটাও মেনে নেওয়া যায় না”।

দীপঙ্কর ঘোষ, সচিব, যুগের প্রতীক ক্লাব

দীপঙ্কর ঘোষ (সচিব, যুগের প্রতীক) ঃ “২০১৯ সালে লিগ শেষ হল না। অসুম্পূর্ণ হয়েই থাকল। লিগ তালিকায় পয়েন্টের দিকে তাকিয়ে কয়েকটা ক্লাব সুপার না প্রথম ডিভিশনে থাকবে সেটা ঝুলেই রইল। সেই সমস‍্যার সমাধান না করে পরের বছর ফুটবলার ট্রান্সফারের নোটিশ জারি করল জেলা ক্রীড়া সংস্থা। তাদের এই অন‍্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে আমরা আদালতে গিয়েছি। ওই সময় কিছু কর্তা ছিল যারা ভুল করেও স্বীকার না করে সমস‍্যাটা বাড়িয়ে গিয়েছে। এখন যে নতুন কমিটি এসেছে তারা আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। জেলায় ফুটবল লিগ হচ্ছে না তার জন‍্য আমাদেরও খারাপ লাগছে। ফুটবলের স্বার্থে প্রয়োজনে আমরা মামলা তুলে নিতে রাজি। কিন্তু ওরা ভুলটা স্বীকার করুক।”

প্রদীপ রায় চৌধুরী (সচিব,বেলঘরিয়া অ‍্যাথলেটিক ক্লাব) ঃ “ওই সময় আমি নিজে সাব কমিটিতে ছিলাম। ফুটবলার রাজুর প‍্যান কার্ড আমরা যাচাই করেছিলাম। ঠিকানা এখানকার। আবার স্কুল সার্টিফিকেটও এখানকার। আসলে আমাদের জেলা ক্রীড়া সংস্থার কয়েকজন কর্তা আছেন যারা ঘোঁট পাকিয়েছে। নিয়ম মেনে অডিট হত না। আমি জেলা শাসককে লিখিতভাবে সব জানিয়েছিলাম। পরে অবশ‍্য নতুন করে অডিট করে কমিটি গঠন হয়েছে। কিন্তু লিগ কবে শুরু হবে আমি জানি না। এখন নাকি শুনছি ওরা একটা লিগ কাম নক-আউট টুর্নামেন্ট করবে। যা জেলা ক্রীড়া সংস্থার স্বীকৃত টুর্নামেন্ট নয়।”

রতন সমাজদার,সচিব, উত্তর ২৪ পরগনা জেলা ক্রীড়া সংস্থা

রতন সমাজদার (সচিব,উত্তর ২৪ পরগনা জেলা ক্রীড়া সংস্থা) ঃ ” আমাদের এই জেলা লিগ হচ্ছে না,বন্ধ আছে এটা আমাদেরও খারাপ লাগছে। আমি কাউকে দোষারোপ করছি না। আমাদের লক্ষ‍্য মাঠে ফুটবল শুরু হোক। পরিস্থিতি অনুকুলে আনতে একটু সময় লাগছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই সমস‍্যা মিটে যাবে। তবে আমরা জেলার সব ক্লাবদের নিয়ে চারটি জোন ভাগ করে জুলাই মাসে একটা লিগ কাম নক-আউট টুর্নামেন্ট শুরু করছি। অন্তত খেলাটা শুরু হোক। আমরা সবাই চেষ্টা করছি আলোচনার মধ‍্যে দিয়ে যাতে মামলা দুটি তুলে নেওয়া যায়। তাহলে এই বছরই জেলা লিগ শুরু করে দিতে পারব।”

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,জেলার এক কর্তা জানালেন,এই সব ঘটনা যখন ঘটে তখন জেলা ক্রীড়া সংস্থার ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট ছিলেন তৃণমূল বিধায়ক প্রয়াত কাজল সিনহা। অভিযোগ, কাজলবাবুই নাকি নিজের ঘনিষ্ঠ অঞ্জন দাশগুপ্তকে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সচিব পদে বসিয়েছিলেন। সেই অঞ্জন দাশগুপ্তর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

উত্তর ২৪ পরগনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে বহুবছর ধরে জড়িয়ে আছেন প্রীতিময় চন্দ। এই মুহুর্তে তিনি ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট। জেলা সংস্থার ভাল কাজ,খারাপ কাজ সবই তাঁর জানার কথা। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ক্রীড়া জগতে কান পাতলে শোনা যায়, জেলা সংস্থায় প্রীতিময় চন্দর প্রভাব আছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, সমস‍্যা মেটাতে তিনি কি উদ‍্যোগী হয়েছে? গত মার্চ মাসে তিনি ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট পদে এসেছেন। তিন মাস হয়ে গেল। জেলা লিগ না করে কেন টুর্নামেন্ট করা হচ্ছে? এসব জানতেই প্রীতিময় বাবুকে ফোন করেও প্রতিক্রিয়া জানতে পারা যায়নি। তিনি আমাদের বলেন,”এখন বাইরে যাচ্ছি। সন্ধ‍্যায় ফোন করতে পারেন।” পরে যখন তাঁকে বলা হয় সচিব রতন সমাজদারের সঙ্গে কথা হয়েছে তখন প্রীতিময় বাবু বলেন,”রতন যখন বলেছে সেটাই যথেষ্ট।” এই বিতর্ক থেকে প্রীতিময় চন্দ কি এড়িয়ে গেলেন?

সুব্রত ভট্টাচার্য

এই জেলার শ‍্যামনগর থেকে উঠে এসেছেন সুব্রত ভট্টাচার্য। খেলা না হওয়ার জন‍্য প্রচন্ড বিরক্ত। সুব্রত বলছিলেন,”সংস্থা চালাতে হলে সমস‍্যা তো আসবেই। তাই বলে ফুটবলটাই বন্ধ হয়ে থাকবে? সমস‍্যা মেটাতে উদ‍্যোগী হতে হবে কর্তাদেরই। ভুলে গেলে চলবে না, খেলা আছে বলেই কর্তাদের চেয়ার আছে। আমি যখন মোহনবাগানে টপ ফর্মে খেলছি তখনও সপ্তাহে অন্তত দুটি জেলা লিগের ম‍্যাচ খেলেছি নিয়ম করে। শুধু আমি কেন,আমাদের সময় সবাই জেলা লিগ খেলত। ভাবতেই পারছি না যে,তিন বছর ধরে লিগ হচ্ছে না।”

মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য

এই জেলার আর এক প্রাক্তন ফুটবলার মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য বলছিলেন,”জেলার কর্তাদের সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই। তবে আমি অনেক আগেই শুনেছি আমাদের জেলায় ফুটবল লিগ বন্ধ। খারাপ লাগে। সবাই জানে আমাদের জেলা লিগের উত্তেজনা কলকাতা লিগের থেকে কোনও অংশে কম ছিল না। এখন সেই লিগ বন্ধ। খারাপ লাগে।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here