আদালতে যাওয়ায় তনুময় বসুকে ঘিরে ১৫ জেলায় ক্ষোভ চরমে

0

▪সন্দীপ দে▪

প্রাক্তন ভারতীয় গোলরক্ষক তনুময় বসুকে ঘিরে ১৫ জেলায় ক্ষোভ চরমে উঠেছে। এ যেন জেলার ক্রীড়া জগতের ক্রীড়া প্রশাসকদের “গণ আন্দোলনে”র তীক্ষ্ণ পরীক্ষার সামনে পরে ভয়ঙ্করভাবে কোনঠাসা একদা ভারতীয় ফুটবলের তারকা তনুময় বসু।

২২টি জেলার মধ‍্যে ১৫ টি জেলার ক্রীড়া প্রশাসকদের কাছে তনুময় বসু নাকি বিশ্বাস যোগ‍্যতা হারিয়ে ফেলেছেন। এমনটাই অভিযোগ উঠে আসছে। তাঁর কাছ থেকে একে একে জেলাগুলি সরে আসতে শুরু করেছিল বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। এতদিন চাপা পড়ে থাকলেও এখন সেটা প্রকাশ‍্যে এসে গিয়েছে। বিশেষ করে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস ফেডারেশনের এজিএমকে আটকাতে তনুময় বসু আদালত থেকে মিটিংয়ের স্থগিতাদেশ নিতেই তাঁকে ঘিরে জেলায় জেলায় হতাশা,বিরক্তি এবং ক্ষোভ চরমে উঠেছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ‍্য, ২২ টি জেলা ক্রীড়া সংস্থার মাথার উপরে আছে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস ফেডারেশন। গত চার বছর ধরে এই সংস্থার সভাপতি আছেন তনুময় বসু। কোভিডের জন‍্য নতুন কমিটি গঠন সম্ভব হয়নি। জেলা কর্তাদের কাছ থেকে জানা যায়, এবার নতুন কমিটি গড়ার জন‍্য নাকি দুই মাস আগে তনুময় চেয়েছিলেন দীঘায় অ‍্যানুয়াল জেনারেল মিটিং হোক। পরে দীঘার পরিবর্তে কলকাতা নিউটাউনে এক পাঁচতারা হোটেলে মিটিং করার কথা হয়। কোভিডের জন‍্য তখন কোনও জেলার কর্তা রাজি হয়নি। তারপরে সেই মিটিং বীরভূমে করতে চেয়েছিলেন তনুময়। সেটাতেও রাজি ছিল না একাধিক জেলা। বেশিরভাগ জেলা এজিএমটি করতে চেয়েছিলেন মালদা শহরে। ঠিক হয় এজিএম হবে ৮ মার্চ। তখন তনুময় জেলা কর্তাদের জানান, ১০ মার্চ তাঁর মেয়ের বিয়ে। মিটিংটা ১০ তারিখের পরে করা হোক। পরে তনুময়ের সেই অনুরোধ মেনে ৮ মার্চে মিটিংয়ে বদলে ৪ মার্চ করা হয়। কিন্তু এই ৪ মার্চের মিটিং অবৈধ বলে চুচুড়ার সিটি সিভিল কোর্টে মামলা করেন তনুময়। আদালত ১৫ মার্চ পযর্ন্ত এজিএম না করার নির্দেশ দেন।

এই মুহূর্তে জেলা ফেডারেশনের কাজ স্তব্ধ। একাধিক জেলার কর্তাদের দাবি, ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস ফেডারেশনের সভাপতি হয়ে আদালতে গিয়ে ফেডারেনকে নিস্ক্রিয় করে ঠিক করেননি তনুময় বসু। এই ঘটনার পর থেকেই তনুময়কে ঘিরে জেলায় জেলায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ওয়েষ্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস ফেডারেশনের ৮১ বছরের ইতিহাসে কেউ আদালতে যাননি। যদি কোনও সমস‍্যা হয়ে থাকে তাহলে নিজেদের মধ‍্যে আলোচনা করে সমস‍্যা মিটিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু আদালতে গিয়ে ফেডারেশনকে নিস্ক্রিয় করে দেবে কেউ,এটা মেনে নিতে পারছেন না অধিকাংশ জেলার কর্তারা।

জেলার একাধিক কর্তাদের দাবি, তনুময় বসু নাকি ফেডারেশনের সচিব হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৫ থেকে ১৬ টি জেলার কর্তা তনুময়বাবুকে সচিব পদে চাননি। (যদিও কর্তারা তাঁকে চেয়ারম‍্যান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন)। ভোটের বাজারে তনুময়বাবুর “সংখ‍্যা কি কম পড়িয়াছিল”? সমস‍্যাটা তৈরি হয় এখান থেকেই। অভিযোগ, তারপরেই তনুময়বাবু নাকি নিজের জেলার চুচুড়ার নিম্ন আদালতে মামলা করেন।

আদালতের নির্দেশকে যথাযথভাবে সম্মান জানিয়েও গত ৪ মার্চ মালদা শহরে ১৫ জেলার কর্তারা একত্রিত হয়েছিলেন। যা নজিরবিহীন ঘটনা। তবে আদালতের নির্দেশকে সম্মান জানিয়ে অ‍্যানুয়াল জেনারেল মিটিং করেননি কর্তারা। পরবর্তী কি পদক্ষেপ করা উচিৎ তাই নিয়েই বেসরকারি ভাবে তার একটা পরিকল্পনা করে রেখেছেন জেলার কর্তারা। কি সেই পরিকল্পনা? সেই বিষয় নিয়ে জেলার কোনও কর্তা মুখ খোলেননি। তবে তনুময় বসু যে ভাবে আদালতে গেলেন সেটাকে ভাল ভাবে নেননি ১৫ জেলার কর্তা। তনুময়ের উপর তাঁদের বিশ্বাসটাই চলে গিয়েছে। গোটা ঘটনায় তাঁরা বিরক্ত,হতাশ এবং ক্ষুব্ধও। এই বিষয়ে “ইনসাইড স্পোর্টস” যে সকল জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে, সেটাই তুলে ধরছে।

কয়েক মাস আগে তনুময় বসুর সঙ্গে সুদীপ বিশ্বাস। সঙ্গে এআইএফএফ সহসভাপতি সুব্রত দত্ত

◆সুদীপ বিশ্বাস (সচিব, উত্তর দিনাজপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থা) :
“আদালতে মানুষ কখন যায়? শেষ পর্যায়ে যায়। সেই রকম পরিস্থিতি তো তৈরি হয়নি। পরিবারেও তো সমস‍্যা হয়, ঝামেলা হয়। পরে আলোচনার মধ‍্যে সমস‍্যার সমাধানও হয়। সেটা করলেন না। আদালতে যাওয়ায় মিউচুয়াল রেসপেক্টে ধাক্কা খেল। একদিন বিচার ব‍্যবস্থা সম্পন্ন হবে ঠিকই কিন্তু এই যে সম্পর্কের দুরত্ব তৈরি হল, তা কি পূর্ণ হবে? আদালতে গিয়ে আমাদের ফেডারেশন নিস্ক্রিয় হওয়ায় সব থেকে ক্ষতি হল জেলার খেলোয়াড়দের। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমি কখনও দেখিনি, কোনও জেলার ক্রিকেটার আন্ত: জেলা ক্রিকেটের সার্টিফিকেট নিতে এসেছে। ফুটবলাররা কিন্তু আসে। এই সার্টিফিকেট থাকলে সিভিক ভলেন্টিয়ার পদে চাকরির ক্ষেত্রে সাহায‍্য করে। আন্তঃজেলা ফুটবল পরিচালনা করে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস ফেডারেশন। ফুটবল না হলে গ্রামের ফুটবলারদের ক্ষতি। প্রতিভাও উঠে আসবে না। অবিলম্বে ফুটবলারদের স্বার্থেই ফেডারেশনকে সক্রিয় করে হোক।”

জলপাইগুড়ি ডিএসএ সচিব সব‍্যসাচী (কুমার ) দত্ত

◆ সব‍্যসাচী (কুমার) দত্ত (সচিব, জলপাইগুড়ি জেলা ক্রীড়া সংস্থা) :
আমি আশু করের সময় থেকে জেলা ফুটবল প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত। এমন ঘটনা দেখিনি। তনুময়দা ভারতের স্বনামধন্য ফুটবলার। সমস‍্যা থাকতেই পারে। আলোচনার মধ‍্যে দিয়েই মিটিয়ে নেওয়া যেতে পারত। সেটা না করে আদালতে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছি না। সংস্থার সভাপতি হয়ে সংস্থার বিরুদ্ধে এমনটা করা উচিত হয়নি।”

◆ কুন্তল গোস্বামী (সচিব,শিলিগুড়ি মহকুমা ক্রীড়া পরিষদ) : তনুময় বসুর আদালতে যাওয়া সমর্থন করি না। তনুময় বাবু বিখ‍্যাত গোলকিপার ছিলেন। এজিএমে নির্বাচন হলে স্পোর্টিংলি অংশ নিলেই ভাল দেখাতো। যেটা ঘটল তা অত‍্যন্ত দূঃখ জনক ঘটনা।”

সুব্রত দত্ত, সচিব, কোচবিহার ডিএসএ

◆ সুব্রত দত্ত (সচিব,কোচবিহার জেলা ক্রীড়া সংস্থা) : “জেলা প্রতিনিধিদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হয়। ব‍্যক্তি নয়,সংস্থা বড়। আদালতে গিয়েছেন। এখন সব কিছুই যদি আটকে যায় তাহলে সব থেকে ক্ষতি হবে খেলা,খেলোয়াড়ের এবং সংস্থার।”

◆ অমিতাভ (দুলু) ঘোষ (সচিব, দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থা) : “আদালতে যাওয়ার ঘটনা না ঘটলেই ভাল হত। খেলাধূলার স্বার্থে সবাইয়ের সঙ্গে কথা বলে সমস‍্যা মিটে গেলেই ভাল হত।”

◆ সুতীর্থ সাউ ( যুগ্ম সহ সচিব, পঃ মেদিনীপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থা) : সংস্থার সভাপতি হয়ে আদালতে যাওয়াটি মেনে নিতে পারছি না। মতান্তর থাকতেই পারে। তাই বলে আদালতে যেতে হবে! সবাই মিলে আলোচনা করা যেত না? তনুময় বসুর কাছে খেলোয়াড়সুলভ আচরণ আশা করেছিলাম।”

◆ মদন মোহন মারিক ( সহ সচিব, দঃক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা ক্রীড়া সংস্থা) : “তনুময় বসুর মতো ফুটবলারের কাছ থেকে এটা আশা করিনি। সভাপতি হিসেবে সংস্থার বিরুদ্ধে যাওয়াটা সমর্থনযোগ্য নয়। খুবই লজ্জাজনক ঘটনা।”

ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস ফেডারেশনের প্রাক্তন সচিব গৌতম গোস্বামী

◆ গৌতম গোস্বামী (প্রাক্তন সচিব, ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস ফেডারেশন) : “তনুময় বসু ভারতের স্বনামধন্য গোলকিপার ছিলেন। আমি যে বছর সংস্থার সচিব পদ ছেড়েছিলাম সেই বছরই সকল সদস‍্যদের সঙ্গে কথা বলে তনুময় বসুকে সভাপতি করা হয়েছিল। জেলার ক্রীড়া প্রশাসক থেকে খেলোয়াড়রা তনুময়কে পেয়ে স্বপ্ন দেখেছিল। তাঁকে ঘিরে যে প্রত‍্যাশা তৈরি হয়েছিল তা পূরণ তো হয়ইনি বরং সভাপতি হওয়ার পর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন তনুময়। পদ নয়,কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল। সংস্থার উর্ধ্বে কোনও ব‍্যক্তি থাকতে পারে না। তনুময় একটা পদ পাওয়ার জন‍্য যে নোংরামি করছেন, তার তীব্র প্রতিবাদ করছি। লজ্জাজনক ঘটনা।”

বিশ্বজিৎ ভাদুড়ি, সচিব, মুর্শিদাবাদ ডিএসএ

◆ বিশ্বজিৎ ভাদুড়ি (সচিব, মুর্শিদাবাদ জেলা ক্রীড়া সংস্থা) : মতান্তর থাকতেই পারে। সংস্থার ৮১ বছরের ইতিহাসে যা কখনও ঘটেনি সেটাই ঘটালেন তনুময় বসু। আজ সংস্থাকে রাস্তায় নামিয়ে আনলেন। তনুময়বাবুর এই নিন্দনীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আজ বেশির ভাগ জেলা ক্ষুব্ধ। এককাট্টা।”

বিপ্লব চক্রবর্তী, কোষাধ‍্যক্ষ, ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস ফেডারেশন

◆ বিপ্লব চক্রবর্তী (কোষাধ‍্যক্ষ, ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস ফেডারেশন) : “এই মুহুর্তে পুরো বিষয়টা সাবজুডিস ম‍্যাটার। বেশি কিছু বলতে চাই না। তবে এটুকু বলব,সচিব পদ পাওয়ার লড়াইয়ে যখন দেখলেন তাঁর ভোট সংখ‍্যা কমে গিয়েছে ঠিক তখনই আদালতে গেলেন। অনেক জেলা আপত্তি করে আসছিল। এখন বেশি করে আপত্তি করছে। পুরো ঘটনায় আমরা হতাশ, বিরক্তও।”

দেবব্রত সাহা, সচিব, ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস ফেডারেশন

◆ দেবব্রত সাহা (সচিব,ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস ফেডারেশন) : “ব‍্যক্তি স্বার্থ দেখতে গিয়ে সংস্থা ও খেলাটাই নষ্ট করে দিচ্ছেন তনুময় বসু। আদালতকে সম্মান করি। অনেক কিছু বলার আছে। সময় এলে বলব। আমরা অপেক্ষা করছি। পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি।”

যার বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার সেই তনুময় বসু “ইনসাইড স্পোর্টস”কে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে বললেন,” আমার মেয়ের বিয়ে ১০ মার্চ। তাই সদস‍্যদের বলেছিলাম দশ তারিখের পর মিটিং করতে। ৮ মার্চের মিটিং স্থগিত করে। পরে দেখলাম এজিএম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৪ মার্চ। হুগলি ডিএসএকে মিটিংয়ের কথা জানালেও আমাকে কোনও মেল করা হয়নি। তখন আমি ১৮ ফেব্রুয়ারি মেল করে জানাই, এই ভাবে মিটিং ডাকা সংস্থার সংবিধান বিরোধী। জেনারেল কমিটির মিটিং ডেকে এজিএমের নতুন তারিখ,সময় ও স্থান ঠিক করতে হয়। এটাই সংস্থার নিয়ম। আমি সকল জেলাকে এই মর্মে মেল করে জানিয়েছিলাম। কিন্তু তার কোনও উত্তর পাইনি। আমি অপমানিত বোধ করেছিলাম। তখন বাধ‍্য হয়েই আদালতে যাই। তবে আমিও চাই না ফেডারেশন নিস্ক্রিয় হয়ে যাক। পরিস্থিতি আমাকে বাধ‍্য করেছে। আর যারা বলছে আমি সচিব হতে চেয়েছিলাম তাঁরা ভুল বলছে। আমি কখনই সচিব হতে চাইনি। সভাপতি থেকে সচিব হওয়াটা কখনও ভাল দেখায় না।”
সংস্থার সভাপতি হয়ে আদালতে যাওয়াটা কি ঠিক করলেন? উত্তরে তনুময় বাবু বলেন,”সভাপতির সঙ্গে কথা না বলেই মিটিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। সভাপতিকে মানল কোথায়? আমি অপমানিত বোধ করছি।”

ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস ফেডারেশনের জট খুলবে কিনা এখনও অপেক্ষা করতে হবে আগামী ১৫ মার্চ পযর্ন্ত। জেলা সূত্রের খবর,এখনও পযর্ন্ত তনুময়ের পক্ষ‍্যে মাত্র চারটি জেলা পাশে আছে। মালদায় ১৫ জেলা কর্তা একত্রিত হয়েছিল। এরপরেও আরও তিনটি জেলা তনুময়ের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে মত দিয়েছেন বলে সূত্রের খবর। অর্থাৎ ১৮ টি জেলা তনুময় বসুর বিরুদ্ধে চলে গেছে। এত জেলার এত গোল রক্ষা করতে পারবেন ভারতের প্রাক্তন গোল রক্ষক?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here