আদালতের দিকে তাকিয়ে সোনা জয়ী অ‍্যাথলিট মনোরঞ্জন পোড়েল

0

সন্দীপ দে

মাঝে মাঝেই উকিলকে ফোন করে তিনি জিজ্ঞাসা করেন,”কেসের কোনও খবর আছে? এনি ডেভেলপমেন্ট?” ইতিবাচক উত্তর না পেয়ে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। মাস খানেক পর আবার সেই উকিলকে ফোন তাঁর। প্রশ্ন সেই এক। উত্তর? সেটাও একই।

দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে ক্ষীণ আশা নিয়ে এখনও উকিলকে ফোন করেন বাংলা তথা ভারতের খ‍্যাতনামা অ‍্যাথলিট মনোরঞ্জন পোড়েল। যখন তিনি টপ ফর্মে ছিলেন তখন দু-দুটি চাকরি (সাই ও কাস্টমস) পেয়েও তা গ্রহণ করেননি। পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতে ১৯৮৯ সালে সাহাগঞ্জের ডানলপ ফ‍্যাক্টরিতে স্পোর্টস অফিসারের চাকরি জীবন শুরু করেন। ৯ বছরের চাকরি জীবনের মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। বন্ধ হয়ে গেল ডানলপ ফ‍্যাক্টরি। বকেয়া স‍্যালারি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র‍্যাচুইটি পাওয়ার আশায় আদালতে মামলা করলেন। সেই মামলার রায় আদালত দিচ্ছে কিনা জানতে চেয়ে নিজের উকিলকে গত ২৩ বছর ধরে ফোন করে খোঁজ নিয়ে চলেছেন সোনা জয়ী অ‍্যাথলিট মনোরঞ্জন পোড়েল।

১৯৭১ সালে ইরানের তেহেরান শহরে ইন্টারন‍্যাশনাল অ‍্যাথলেটিক্স চ‍্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় সোনা জিতেছিলেন। ওই প্রতিযোগিতায় ৪×৪০০ রিলে দৌড়ে রুপোও জিতেছিলেন। ২২ বার ন‍্যাশনাল করেছেন। ক‍্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ব্লু সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। বাংলা এবং ভারতীয় অ‍্যাথলেটিক্সে একটা সময় রাজ করেছেন তিনি। ক্লাব স্তরে সারা জীবন মোহনবাগানের হয়েই প্রতিনিধিত্ব করে গিয়েছেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সাল পযর্ন্ত ভারতীয় দলের কোচও ছিলেন। মনোরঞ্জন পোড়েলের নাম এই প্রজন্ম কয়জন জানে? আমরা, যারা এই প্রজন্মের ক্রীড়া সাংবাদিক, কতটুকু জানতে পেরেছি? মনে রাখতে পেরেছি তাঁকে? এ আমাদের ব‍্যর্থতা, লজ্জাও।

গতবছর হঠাৎ এই নামটা ভেসে উঠেছিল মোহনবাগান ক্লাবের সৌজন‍্যে। “মোহনবাগান দিবস”-এ লাইফটাইম অ‍্যাচিভমেন্ট পেয়েছিলেন মনোরঞ্জন পোড়েল। তারপর আর আর কেউ মনে রাখেনি তাঁকে।

বর্তমানে কেমন আছেন মনোরঞ্জন পোড়েল? এক কথায় লিখতে হলে, ভাল নেই তিনি। এই প্রতিবেদককে এই তথ‍্যটা প্রথম দিয়ে ছিলেন ভারতের প্রাক্তন গোলরক্ষক তনুময় বসু। “মনোরঞ্জনদা আমাদের জেলা সহ গোটা বাংলার গর্ব। তাঁর শরীরে পাঁচ-পাঁচটা অস্ত্রোপচারের ধকল ও খরচ, মানুষটাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। ভদ্রভাবে বাঁচতে গেলে যে অর্থের দরকার সেটা নেই। আমরা সবাই যদি একটু এগিয়ে আসি, তাহলে বাংলার অন‍্যতম সফল এই অ‍্যাথলেট জীবনের শেষটা একটু ভালভাবে বাঁচতে পারে।” “ইনসাইড স্পোর্টস”-কে বলছিলেন তনুময় বসু।

কিন্তু পোড়েলবাবুর সঙ্গে কথা বললে বোঝার উপায় নেই যে, তিনি ভাল নেই। ভদ্র, প্রচন্ড আত্ম সম্মান নিয়ে চলেন। নিজের কষ্ট, যন্ত্রণা, অবজ্ঞা নিজের মধ‍্যেই রেখে দিয়েছেন তিনি।

প্রশ্ন : আপনি দু-দুটি চাকরি পেয়েও করেননি। আজ, আপনি সত্তর বছর পেরিয়ে গিয়েছেন। এখন কি মনে হয় ভুল করেছেন?

মনোরঞ্জন পোড়েল : সাইতে চাকরি করিনি কারণ, আমার পোষ্টিং অন‍্য রাজ‍্যে হচ্ছিল। কলকাতা ছাড়তে চাইনি। আর কাস্টমসে একটা বিরক্তি ছিলই। কিন্তু আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কাস্টমের চাকরিটা না নিয়ে মস্ত বড় ভুল করেছি।

প্রশ্ন : আপনি নাকি পরে স্পোর্টস কাউন্সিলেও চাকরি করেছেন?

মনোরঞ্জন পোড়েল : হ‍্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। আমার এক মাত্র মেয়ের বিয়ে হল। তখন আমার স্ত্রী একাকিত্বে ভুগত। তখন আমি ভারতীয় দলের কোচ। স্ত্রীকে পাতিয়ালায় নিয়েও গিয়েছিলাম। কিন্তু থাকতে পারেনি। কোচিং ছেড়ে কলকাতায় চলে এলাম। তখন ক্রীড়ামন্ত্রী ছিলেন সুভাষ চক্রবর্তী। তিনিই স্পোর্টস কাউন্সিলে (অ‍্যাড হক, পার্মানেন্ট চাকরি নয়) কাজের ব‍্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন : এই কনট্রাক্টচুয়াল চাকরিতে মাইনে তো খুব সামান‍্য ছিল।

মনোরঞ্জন পোড়েল : ওই আর কি। আমার কোনওদিনই বেশি চাহিদা ছিল না। তবে কয়েক বছর হল, এই স্পোর্টস কাউন্সিলের চাকরিটাও আর নেই। ওরা বলল, আপনি যেভাবে বিভিন্ন গ্রাম থেকে অ‍্যাথলিট তুলে এনেছেন তা খুব কম লোকে করেছে। তবুও বলছি, আপনার বয়স হয়ে গিয়েছে। এখন আর আপনাকে রাখতে পারব না।

প্রশ্ন : আপনি বাংলার অ‍্যাথলেটিক্সকে অনেক দিয়েছেন। বিখ‍্যাত খেলোয়াড় আপনি। আপনার খেলোয়াড় জীবনে কাদের অবদান বেশি?

মনোরঞ্জন পোড়েল : আমি যতটুকু খেলেছি তার জন‍্য অনেক বড় ভূমিকা আছে আমার স্ত্রী দেবযানীর। আমার খেলোয়াড় জীবনে আমি শুধু বাইরে বাইরে খেলে গিয়েছি। আর আমাদের একমাত্র মেয়েকে মানুষ তো স্ত্রীই করেছে। হুগলির সাহাগঞ্জ স্পোর্টস ক্লাবের অবদান কখনও ভুলতে পারব না। ত্রিবেনী শিবপুর স্পোর্টিং ক্লাবে ২১ বছর ধরে কোচিং করিয়েছি। এতটাই ওরা আমার উপর ভরসা করতেন। এটা কি কম পাওয়া? ২০১৩ সালে মাননীয়া মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় আমাকে “ক্রীড়া গুরু”-র সম্মান দিয়েছিলেন। খুবই সম্মানিত বোধ করেছিলাম। গত বছর মোহনবাগান লাইফটাইম অ‍্যাচিভমেন্ট দিয়েছে। এই সব ঘটনা মনে পড়লে ভাল লাগে।

প্রশ্ন : আপনার জীবনে সেরা ভুল কি?

মনোরঞ্জন পোড়েল : কাস্টমসের চাকরিটা না নেওয়া।

প্রশ্ন : বাড়িতে আপনি আর স্ত্রী দেবযানীদেবী। চাকরির আর বয়স নেই। ব‍্যাঙ্ক ব‍্যালেন্সও নেই। কিভাবে চলে আপনাদের?

মনোরঞ্জন পোড়েল : (অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর) ওই চলছে আর কি।

নিজের অভাব, যন্ত্রণা বলতে চান না। লজ্জাবোধ করেন। তাঁর দুই ঘনিষ্টর কাছ থেকে জানতে পেরেছি, প্রচন্ড আর্থিক কষ্টে আছেন পোড়েল দম্পতি। কয়েক মাস আগে মারাত্মক দূর্ঘটনায় তাঁর শরীরে বড় অস্ত্রোপচার করার সময় মেয়ে অদ্রিজা পাশে ছিলেন। কিছুদিন মেয়ের কাছেও ছিলেন। কিন্তু মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতে বেশিদিন থাকতে চাননি পোড়েলবাবু। মেয়ে অদ্রিজা বাবা অন্ত প্রাণ, জামাইও ভাল। কিন্তু নিজের কঠিন লড়াই করছেন নিজের বাড়িতে থেকেই। মেয়ে-জামাইকে বিরম্বনার মধ‍্যে ফেলতে চান না।

মনোরঞ্জন পোড়েলের খারাপ অবস্থার কথা জানেন রাজ‍্য অ‍্যাথলেটিক্স সংস্থার সচিব কমল মৈত্রও। তিনি “ইনসাইড স্পোর্টস”-কে বলছিলেন,” বাংলা ও ভারতীয় অ‍্যাথলেটিক্স জগতে মনোরঞ্জন পোড়েল অনেক বড় নাম। দেশকে সোনা এনে দিয়েছেন। ভারতের বহু বছর কোচ ছিলেন। উনি যখন স্পোর্টস কাউন্সিলে ছিলেন তখন অ‍্যাথলেটিক্সে খুব ভাল কাজ করেছেন। অনেক অ‍্যাথলিট উঠে এসেছে। নিজের জন‍্য কারও কাছে কখনও চাননি। তার শেষ জীবনটা সুষ্ঠুভাবে কাটলে খুব ভাল হত। আমাদের সংস্থারও ভাল অবস্থা নয় যে পাশে দাঁড়াব। এ এক কঠিন পরিস্থিতি।”

অনেকেই পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এড়িয়ে গিয়েছেন তারা। তবে আদিসপ্তগ্রামের বিধায়ক তপন দাশগুপ্ত সামান‍্য হলেও পাশে থেকেছেন। পোড়েলবাবু এখন আর কারও কাছে প্রত‍্যাশা করেন না। মনে মনে স্বপ্ন দেখেন, ডানলপ ফ‍্যাক্টরি বন্ধ মামলায় আদালত তাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। তিনি সহ ডানলপের সকল স্টাফ নিজেদের প্রাপ‍্য অর্থ পাচ্ছেন। আর তাই তো মাঝে মাঝে তাঁর উকিলকে ফোন করার অভ‍্যাস ছাড়তে পারেননি।
কিন্তু আদৌও আদালতের রায় প্রকাশ হবে? সুদিন ফিরবে? নাকি মনোরঞ্জন পোড়েল সব জেনেও গোস্পদে চোখ রেখে আকাশ দেখার চেষ্টা করছেন?

সোনা যায়, কয়েক মাস আগে তাঁর বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয় তখন কোনও এক ব‍্যক্তির অনুরোধে আদিসপ্তগ্রামের বিধায়ক তপন দাশগুপ্ত পোড়েলবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তপনবাবু ছাড়াও কয়েকজন প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা কথা রাখেন নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here