সন্দীপ দে
চরম আর্থিক সঙ্কটে বাংলার ফিফা সহকারী রেফারি সমর পাল। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে এবারের লকডাউনের দুদিন আগে থেকে সবজি বিক্রি শুরু করেছেন সমর পাল। যা ভাবাই যায় না।
বাগনান থেকে একটু ভিতরে মুককল্যাণ গ্রামের নিজের বাড়িতে কিছু কাঁচা সবজি নিয়ে বসছেন সমরবাবু। গ্রামের কিছু মানুষ সেই সবজি কিনলে তবেই সেদিনের হাঁড়িতে ভাত ফুটে। সমর পালের বাড়িতে আছেন মা, স্ত্রী, একমাত্র ছেলে। চারজনের সংসার চালাতে অথৈ জলে বাংলার এই ফিফা সহকারী রেফারি।
ফিফার ব্যাজ পেলেও একটা চাকরিও জোটেনি। বহুজনকে অনুরোধ করেছেন, কিন্তু সবাই বলেছেন ‘দেখছি’। এখনও সবাই ‘দেখছেন’। “একটা চাকরির জন্য অনেককেই অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু হয়নি। গত বছর লকডাউনের সময় জমানো টাকা যা ছিল তাই দিয়ে সংসার চলেছে। কিন্তু এবার আর পারলাম না। বাধ্য হয়েই সবজি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিতে হল। এখন সকালে মোবাইল অন করলে অনেকেই টেক্সট করে গুডমর্নিং জানায়। সঙ্গে লেখে ‘ঘরে থাক, সাবধানে থাক, সুস্থ থাক।’ কিন্তু তারা জানে না আমার মত অনেকেই ঘরে সুস্থ,সাবধানে থাকতে পারে না। ওই সব কথা শুনতেই ভাল লাগে।” ফোনে ধরা গলায় কথা গুলি বলছিলেন ফিফা সহকারি রেফারি সমর পাল।

২০১৪ সালে প্রাঞ্জল ব্যানার্জি ও সমর পাল প্রথম ফিফার ব্যাজ পেয়েছিলেন। প্রাঞ্জল রেফারি ও সমর সহকারী রেফারির ফিফা ব্যাজ পেয়েছেন। গত ৬ বছরে ২৮ টা দেশে আন্তর্জাতিক ম্যাচে সহকারী রেফারির ভূমিকা পালন করেছেন ফিফা এলিট সহকারী রেফারি সমর। কিন্তু ২০২০ করোনার জন্য আর কোনও ম্যাচ পাচ্ছেন না তিনি। গত মাসে এএফসি কাপের গ্রুপ স্টেজে হংকং ও আমানে ম্যাচের সুযোগ পেলেও শেষ মূহুর্তে করোনার জন্য বাতিল হয়ে যায়। যার ফলে খুব আর্থিক সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে বলছিলেন সমর।

“আমাদের পাশের গ্রাম চন্দ্রভাগে থাকতেন রেফারি রথীন মুখার্জি। টিভিতে তাঁর খেলা পরিচালনা দেখতাম। সেই থেকেই আমারও ইচ্ছে হয়েছিল, আমিও একদিন রেফারি হব, সবাই আমাকে টিভিতে দেখবে। সেই নেশা থেকেই ২০০৩ সালে রেফারি হিসেবে শুরু করি। পরে যখন ফিফার ব্যাজ পেলাম তখন মনে হল, একটা জায়গায় পৌঁছতে পারলাম। কিন্তু তখন ভাবিনি আমাকে একদিন সবজি বিক্রি করতে হবে। এখন ভাবি কেন যে এই রেফারি হতে এসেছিলাম? ভুল করেছি, খুব ভুল করেছি সন্দীপদা।” কথা গুলি বলছিলেন সমর পাল।
কিন্তু আন্তর্জাতিক ম্যাচের পেমেন্ট তো ভালই। এই প্রশ্নের উত্তরে সমর “ইনসাইড স্পোর্টস”-কে বলে উঠলেন,”পেমেন্ট ভাল। কিন্তু আমরা তো সারা বছর ম্যাচ পাই না। প্রত্যেক মাসে তো রোজগারের প্রয়োজন। আপনি নিজেই বলুন না, ফিফার ব্যাজ পাওয়ার পরও একটা চাকরি জোটে না। রেফারির সর্বোচ্চ সময় ৪৫ বছর। যদি ফিট থাকে তবে ৪৫ বছর পযর্ন্ত ম্যাচ পাবে। তারপর কি হবে? নতুন প্রজন্ম কেন রেফারি হতে আসবে বলতে পারেন?”

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই মুহূর্তে বাংলায় ফিফা এলিট প্যানেলে আছেন তিন জন। প্রাঞ্জল ব্যানার্জি রেফারি। আর সহকারী রেফারি হলেন সমর পাল ও অসিত সরকার। অনেক কষ্টে একটা বেসরকারি চাকরি পেয়েছেন প্রাঞ্জল। কিন্তু সমর ও অসিতের ভাগ্যে এখনও চাকরি জোটেনি। এই প্রতিবেদকের মনে আছে, একটা সরকারি চাকরির জন্য ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের কাছে বহুবার অনুরোধ করেছিলেন প্রাঞ্জল। এমনকি তৎকালীন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী লক্ষ্মীরতন শুক্লাও বহু চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সরকারি চাকরি হয়নি প্রাঞ্জলের। বাধ্য হয়ে টেকনো গ্রুপের চাকরি নিয়ে কলকাতা ছেড়ে শিলিগুড়ি চলে গিয়েছিলেন। কয়েক মাস হল, রাজারহাট নিউটাউনে বদলি হয়ে এসেছেন প্রাঞ্জল।
যে বছর কলকাতায় লিওনেল মেসি আসেন সেই ম্যাচ খেলিয়েছিলেন ফিফা রেফারি বিপ্লব পোদ্দার। পরে স্পোর্টস কাউন্সিলে তার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র। রাজ্যের বর্তমান ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস কি বাংলার এই তিন ফিফা রেফারিকে সরকারি চাকরি দিতে পারেন না? ফুটবলাররা যদি স্পোর্টস কোটায় চাকরি পেতে পারেন, তাহলে রেফারিদের স্পোর্টস কোটায় চাকরি হবে না কেন? পারফরমেন্স দেখেই রেফারিদেরও চাকরি দেওয়া হোক। আইএফএ- সিআরএ যৌথভাবে রেফারিদের চাকরির ব্যবস্থা করতে পারে না? বাংলার ফুটবলে যদি ফুটবলারদের অবদান থাকে, তাহলে রেফারিদের অবদান কোনও অংশে কম নেই। তাহলে এই বৈষম্য কেন?
সমর পালের কাতর অনুরোধ,”স্পোটর্স কাউন্সিলে যদি একটা চাকরি পাওয়া যেত তাহলে অন্তত সংসারটা বেঁচে যায়।” সব শেষে নিজে সবজি বিক্রি করছেন সেই ছবি যেন “ইনসাইড স্পোর্টস” না ছাপে সেই অনুরোধ করলেন সমর। “আমি চাইনা আমার সবজি বিক্রির ছবি প্রকাশ হোক। ভাল লাগছে না কিছুই।”