সন্দীপ দে
২৬ এপ্রিল, কলকাতা : বাংলার ক্লাব ক্রিকেটে চার প্রধানের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে ভবানীপুর ক্লাব। গড়ের মাঠের ক্রিকেটে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, স্পোর্টিং ইউনিয়ন এবং কালীঘাট – চার ক্লাব প্রাধান্য দেখিয়ে আসছে বছরের পর বছর। কিন্তু গত তিন বছর ধরে ছবিটা একটু বদলে গিয়েছে। দুর্দান্ত ভাবে উঠে আসছে ভবানীপুর ক্লাব। শ্রেষ্ঠত্বর বিচার হয় ধারাবাহিকতার উপরে। ভবানীপুর গত তিন বছর ধরে আপাতত সেই জেতার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পেরেছে।

২০১৮-‘১৯ মরশুমের সিএবি লিগে মোহনবাগানকে হারিয়েছিল এই ভবানীপুর। সেই বছর প্রথম তারা সিএবি লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। দুমাস আগেই জে সি মুখার্জি ট্রফির ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ভবানীপুর। এবার দ্বিমুকুট জয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ভবানীপুর। আগামীকাল, মঙ্গলবার সিএবির ওয়ানডে ক্রিকেটের ফাইনালে খেলবে ভবানীপুর। প্রতিপক্ষ মোহনবাগান।

মঙ্গলবার ফাইনালের দুই দলের লড়াই নিয়ে ময়দানে মজার মজার কথাও শুরু হয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, দুই ‘দাদা-ভাই’-এর লড়াই। মোহনবাগান হল ‘দাদা’ আর ‘ভাই’ হল ভবানীপুর। মোহনবানের সচিব সৃঞ্জয় বসু। আর সেই সৃঞ্জয়ের নিজের ক্লাব ভবানীপুর। ময়দানে জোর গুঞ্জন, ‘দাদা’ মোহনবাগান এবার কোনও ট্রফি জিততে পারেনি। ‘ভাই’ ইতিমধ্যে জে সি মুখার্জি ট্রফি জয় করেছে। আবার সিএবি ওয়ানডে ক্রিকেটের ফাইনালেও উঠেছে। ‘দাদা’ অন্তত একটা ট্রফি জিতুক। এই অদ্ভুত অঙ্ক মেলাতে গড়ের মাঠের ক্রিকেট রসিকরা ভাবছেন মঙ্গলবার নাকি ‘দাদা’ই জিতবে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, ‘দাদা’ মোহনবাগান জিতছে -এমন তথ্য ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-এর জানা নেই। এসবই ময়দানি চর্চা, গুঞ্জন। স্বাভাবিক ভাবেই ‘দাদা-ভাই’-এর লড়াইয়ের ফল জানতে মুখিয়ে আছে গোটা ময়দান।

‘দাদা-ভাই’-এর লড়াইয়ে কে জিতবে তা সময় বলবে। কিন্তু যদি ‘ভাই’ ভবানীপুর হেরে যায়, তাহলে ভবানীপুরকে শুনতেই হবে যে মোহনবাগানকে ম্যাচটা ছেড়ে দিয়েছে।
ময়দানের এই মজার,চটকদার ‘ভবিষ্যতবানী’ শুনে প্রচন্ড বিরক্ত ও হতাশ ভবানীপুরের কোচ আব্দুল মুনায়ম। “খোঁজ নিয়ে দেখুন শেষ সিএবি লিগে আমরা কিন্তু মোহনবাগানকে হারিয়েছিলাম। চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলাম। যে বা যারা এসব বলছেন তা ঠিক নয়। খেলা হবে মাঠে। সৃঞ্জয় বসু ফেয়ার প্লে-তে বিশ্বাসী। ফাইনালে যারা ভাল খেলবে তারাই জিতবে। আমার ছেলেরা কিন্তু এক ইঞ্চিও জমি ছাড়বে না।”
মোহনবাগানে বেশির ভাগ তারকা খেলোয়াড়। অনুষ্টুপ মজুমদার, অভিমুন্য ঈশ্বরণ, বিবেক সিং, সুদীপ চ্যাটার্জি – কে নেই! দলের পরামর্শ দাতা পলাশ নন্দী। কোচ সঞ্জীব গোয়েল। ফাইনালের জন্য তারা তৈরি।
এখানেই ভবানীপুরের কাছে অন্য চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জটা বেশি করে সামনে এসে পড়েছে কোচ আব্দুল মুনায়েমের কাছে। অভিষেক রমন, অভিষেক দাস, ঋত্বিক চ্যাটার্জিদের নিয়ে তাঁরও ব্যালান্সড দল।

আজ থেকে চার বছর আগে আই লিগের মূল পর্বে খেলার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু চূড়ান্ত লড়াইয়ে ব্যর্থ হয়েছিল ভবানীপুর। তারপর আর ফুটবলে সেই ভাবে সাফল্য নেই। কিন্তু ক্রিকেটে ভবানীপুর ক্লাব এখন মোহনবাগান,ইস্টবেঙ্গল,স্পোর্টিং ইউনিয়ন, কালীগাটের জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। তার বড় কারণ কোচ আব্দুল মুনায়ম। টানা ১২ বছর ধরে ভবানীপুর ক্লাবের কোচ তিনি। ময়দান বলে আব্দুল মুনায়েম গুড মেন্টর, ম্যান ম্যানেজমেন্ট খুব ভাল। ভাল দল তৈরি করতে পারে। স্থানীয় ছেলেদের সুযোগ দেন।
আব্দুল মুনায়েম ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে বলছিলেন,”আমি যখন প্রথম ভবানীপুরের কোচের দায়িত্বে আসি, তখন আমার একটাই লক্ষ্য ছিল, তরুণ ছেলেদের নিয়ে কাজ করব। ঠিক যেমন টুলটুলদা করেন। আমি যে ভাবে কোচিং করতে চাই সেটাকে দারুনভাবে সমর্থন করে যাচ্ছেন সৃঞ্জয় বসু। ভিন রাজ্যের ক্রিকেটার খেলানো দরকার ঠিকই কিন্তু প্রাথমিক অগ্রাধিকার দিতে হবে বাংলার ভূমিপুত্রদের। আমি সেই বিশ্বাস নিয়ে কোচিং করার চেষ্টা করছি।”

বীরভুম জেলার সিউড়ির ছেলে এই মুনায়ম। সিউড়ির শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠের তাঁর ক্রিকেট শুরু। জোরে বল করতেন। কলকাতায় এসে বড় ক্লাবে চুটিয়ে খেলেছেন। সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৯ বাংলা দলে খেললেও রনজি খেলা হয়নি মুনায়মের। একবার রনজি দলে স্কোয়াডে ছিলেন, কিন্তু খেলা হয়নি তাঁর। শোনা যায়, সাগরময় সেন শর্মা, দত্তাত্রেয়, সতিন্দর সিংরা যখন খেলছেন তখন পরের ব্যাজ উঠে আসছিলেন আব্দুল মুনায়ম, অরিন্দমরা। কিন্তু তখন বাংলায় খেলতে আসেন তিন জোরে বোলার সুব্রত ব্যানার্জি, প্রশান্ত বৈদ্য এবং চেতন শর্মা। এরা আসার ফলে বাঙালি পেসারদের আর সেই ভাবে সুযোগই দেওয়া হয়নি। ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবে হারিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সেই সময়টাই হয়তো মুনায়েম, অরিন্দমদের একটা বাঁক।
সেই অতীত নিয়ে প্রশ্ন করলে মুনায়ম বলেন, “ওসব নিয়ে আর ভাবি না। ভাবতেও চাই না। আমি কোচিং নিয়ে ভাবি। কোচিংটা আমার কাছে একটা প্যাশন বলতে পারেন।”

ময়দান ক্রিকেট মহল বলে, আব্দুল মুনায়েম গুড মেন্টর, ম্যান ম্যানেজমেন্ট খুব ভাল। ভাল দল তৈরি করতে পারে। স্থানীয় ছেলেদের সুযোগ দেন। তাঁকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দিচ্ছে ভবানীপুর ক্লাবের কর্তা সৃঞ্জয় বসু। দল গড়ার ক্ষেত্রে মুনায়েম যা চেয়েছেন সৃঞ্জয় তাই দিয়েছেন। সৃঞ্জয়-মুনায়েমের সুন্দর বোঝাপড়ার জন্যই ক্রিকেটে ভবানীপুরের উত্থান। সিএবির প্রথম সারির ক্লাবে টানা বারো বছর কোচিং করছেন এমন নজির শুধু টুলটুল ওরফে প্রণব নন্দীর আছে। তিনি যেমন নতুন ছেলেদের নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন, মুনায়মের কাজের ধরনটাও তাই। আজ মুনায়মের হাত ধরে একাধিক ক্রিকেটার বাংলা দলে সুযোগ পেয়েছেন। হারিয়ে গিয়েও কামব্যাকের লড়াইয়ে কোচ মুনায়মের জন্যই বাংলা দলে ফিরে এসেছেন সৌরাশিস লাহিড়ী, শিবশঙ্কর পাল ও অর্ণব নন্দী। মোহনবাগানে যে দু বছর কোচিং করিয়েছেন তখন কাছে খেলেছেন ঋদ্ধিমান সাহা। পি সেন ট্রফিতে যখন বিরাট কোহলি খেলতে আসেন তখনও মুনায়েম তাঁর কোচ।
ক্লাব ক্রিকেটে যার এত সাফল্য তখন বাংলা দলে কোচ হিসেবেও মুনায়েম ব্রাত্য। সিএবি সূত্র থেকে জানা গেল, যারা রনজি খেলেছেন তারাই নাকি বাংলা দলের কোচিং করার ছাড়পত্র পাবেন। এমন নিয়ম হাস্যকর। কোনও উঠতি ক্রিকেটার ক্লাব খেলে, ভাল পারফরম্যান্স করলে যদি বাংলা দলে সুযোগ পেতে পারে তাহলে একজন কোচ ক্লাব স্তরে পারফরম্যান্স করেও কেন জায়গা পাবেন না? চরনজিত সিং, শিবশঙ্কর পাল বাংলার মহিলা দলের কোচ। সৌরাশিস লাহিড়ী আগে ছিলেন অনূর্ধ্ব-২১ বাংলা দলের কোচ। এখন তো তিনিও সিনিয়র দলে ঢুকে পড়েছেন। এদের ক্লাব স্তরে কোনও সাফল্য নেই। চরনজিত, সৌরাশিস, শিবশঙ্কররা যদি বাংলার কোচ হতে পারেন তাহলে আব্দুল মুনায়েম সুযোগ পাবে না কেন? এই প্রশ্ন ময়দানে উঠতে শুরু করেছে।

আপনি রনজি খেলেননি। তার জন্য বাংলার কোচ হতে পারছেন না। ক্লাব স্তরে এত ভাল পারফরম্যান্স করার পরও আপসোস হয় না? উত্তরে মুনায়েম বলেন,” এব্যাপারে কি বলি বলুন তো। কোচ হওয়ার ক্ষেত্রে আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। ভেবে কি করব। আমি আমার ক্লাব কোচিংটা মন দিয়ে করতে চাই। বাকিটা সিএবি কর্তারা দেখবেন।”