কবাডি ছেড়ে হ‍্যান্ডবল, দারিদ্রর সঙ্গে লড়াই করে ভারতের হয়ে খেলার লক্ষ‍্যে আনিশা

0

সন্দীপ দে

মাস দুয়েক আগে বেঙ্গল অলিম্পিক অ‍্যাসোসিয়েশনের নতুন সভাপতি স্বপন ব‍্যানার্জিকে এই সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিল, রাজ‍্য কবাডি সংস্থায় তিনটি গ্রুপ। তার মধ‍্যে একটা গ্রুপের মাথা হয়ে বসে আছেন তৃণমূল নেতা সুব্রত মুখার্জি। এই তিনটি গ্রুপকে এক ছাতার তলায় আনতে পারবেন? কারণ কবাডি সংস্থার কর্তদের গদির লড়াইয়ে ভুগতে হচ্ছে জেলার কবাডি খেলোয়াড়দের। সেই দিন বিওএ-এর সভাপতি বলেছিলেন,”আমি জানি, এমন অনেক সংস্থা আছে যাদের একাধিক গ্রুপ। সব এক ছাতার তলায় আনাটাই আমার কাছে নতুন চ‍্যালেঞ্জ।”

আনিশা পারভিন। রাজারহাট বসিনা গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। ভাতেন্ডা আন্নাকালী স্মৃতি মন্দির গার্লস হাইস্কুলের (উচ্চমাধ‍্যমিক) মাধ‍্যমিক পরীক্ষার্থী। অতি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে এই আনিশা। পঞ্চম শ্রেণী থেকেই কবাডি খেলা শুরু আনিশার। তার দুরন্ত পারফরম্যান্স স্কুল ও পরে জেলা দলে সুযোগ পেয়ে যায়। জেলার হয়ে ভাল খেলতে শুরু করে। কিন্তু রাজ‍্য দলের সিলেকশনের সময় ভাল খেলেও অজানা কারণে বাদ পড়ে যায়। এই বাদ পড়াটা একবার নয়,পরপর তিন বছর ধরে আনিশাকে বাদ দেওয়া হয়। অভিযোগ, কবাডির কর্তারা নিজেদের পছন্দের ছেলে-মেয়েদের দলে নেয়। আনিশার কোনও ‘দাদা’ ধরা ছিল না। রাগে, অভিমানে কবাডি খেলা ছেড়ে দিয়েছিল আনিশা। যোগ দেয় হ‍্যান্ডবল খেলায়। তার নিজের দাদা সাগর আলি সাইতে হ‍্যান্ডবল খেলতেন। দাদার পরামর্শে ২০১৮ শেষদিকে আনিশার হ‍্যান্ডবলে আসা। সবাইকে চমকে দিয়েছে রাজারহাটের এই মেয়েটি। আড়াই বছর হ‍্যান্ডবলে এসে আনিশা বাংলা সাবজুনিয়র ও পরে জুনিয়র দলে জায়গা করে নিয়েছে। ২০১৯ উত্তরাখন্ডে সাবজুনিয়র বাংলা দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিল। পরে কানপুরে বাংলার জুনিয়র দলের হয়ে খেলেছে।

যার হাত ধরে আনিশা কবাডিতে এসেছিলেন তিনি হলেন ভাতেন্ডা আন্নাকালী স্মৃতি মন্দির গার্লস হাইস্কুলের (উচ্চ মাধ‍্যমিক) গেম টিচার সবিতা সরকার। তিনি “ইনসাইড স্পোর্টস”-কে বলছিলেন,” ক্লাস ফাইভ থেকে আনিশা খুব ভাল কবাডি খেলত। আমিও কবাডিতেই কোচিং করাই। স্কুল ও জেলা দলে এত ভাল পারফরম্যান্স করার পরও বাংলা দলের সিলেকশনে ওকে অন‍্যায় ভাবে বার বার বাদ দেওয়া হয়েছে। আমিও কিছু করতে পারিনি। আপনারা জানেনই তো, কর্তাদের ধরতে না পারলে দলে যায়গা হয় না। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ও আসলে একজন কমপ্লিট স্পোর্টসম‍্যান। হ‍্যান্ডবলে গিয়েও সবার নজর কাড়ছে। আমি নিশ্চিত আনিশা খুব শীঘ্রই ভারতীয় দলের হয়ে খেলবে। আমাদের স্কুলের গর্ব আনিশা।”

আনিশার দরিদ্র পরিবার। বাবা জিন্নাত আলি কলকাতা শহরে এসে বিভিন্ন জায়াগায় মালির কাজ করেন। মা মঞ্জুরা বিবি বাড়িত অতি ছোট্ট একটা সাজগোজ সামগ্রীর দোকান খুলেছেন। এত অভাব কিন্তু জিন্নাত-মঞ্জুরার দুই ছেলে ও এক মেয়ে খেলোয়াড়। ‘স্পোর্টস ফ‍্যামিলি’। বড় ছেলে সাগর আলি হ‍্যান্ডবল খেলে। ছোট ছেলে ইবরান আলি ফুটবলার। ২০১৯ এ ভবানীপুরে খেলেছে। এখন খেলছে বিধাননগরে। আর ছোট্ট আনিশা দাদা সাগরের মতোই হ‍্যান্ডবলে মন দিয়ে ফেলেছে।

তাদের এই অভাবে আনিশার পাশে দাঁড়িয়েছে তার স্কুল। স্কুলের শিক্ষিকারা চাঁদা তুলে আনিশার খাওয়ার খরচ, টিউশন খরচ সব ব‍্যবস্থা করেছেন। গেমটিচার সবিতা সরকারও ব‍্যক্তিগত ভাবে আনিশার বাড়ি গিয়ে সাহায‍্য করে আসেন। এখন তার একটা স্পোর্টস শু প্রয়োজন। দাম প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। আনিশার স্কুলের শিক্ষিকারা চাঁদা তুলে এই স্পোর্টস শু কিনে দিতে চলেছেন।

সুবিনয় ঠাকুর। বাংলা জুনিয়র হ‍্যান্ডবল দলের কোচ। রাজারহাট এলাকার বিষ্ণুপুরে গ্রামের প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দেন এই সুবিনয়বাবু। অভিমানে কবাডি খেলা ছাড়ার পর এই সুবিনয় ঠাকুরের কাছে আনিশাকে নিয়ে গিয়েছিলেন গেম টিচার সবিতা সরকার।

“আমার এখানে বেশ কিছু ভাল প্লেয়ার আছে। আনিশা তাদের মধ‍্যে মোস্ট ট‍্যালেন্টড। ওর মাথা না ঘুরে গেলে একদিন ভারতীয় দলে খেলবে মাথা উঁচু করেই। মিলিয়ে নেবেন।” “ইনসাইড স্পোর্টস’-কে বলছিলেন হ‍্যান্ডবল কোচ সুবিনয় ঠাকুর।

সুবিনয়বাবু আরও জানান,”অনেকেই জানেন না, হ‍্যান্ডবল খেলেও চাকরি পাওয়া যায়। “কত ভাল ভাল খেলা আছে। অথচ মিডিয়াতে আপনারা তুলে ধরেন না। আপনি কি জানেন, এই বাংলা থেকে নীনা শীল, মামনি মন্ডল, বিথিকা রাভা, মন্টু সরকারের মত কত ছেলে-মেয়ে দেশের হয়ে খেলেছে। এরা সবাই কিন্তু জেলার ছেলে-মেয়ে। খেলার জন‍্য রেলে, ইন্ডিয়ান নেভিতে চাকরিও পেয়েছে।” তিনি আরও জানান, হ‍্যান্ডবলে এই মুহূর্তে ভারতে দুজন কোচ আছেন যাদের বি লাইসেন্স আছে। এই দুইজনের মধ‍্যে অতনু মজুমদার সাইয়ের কোচ। বাংলার হ‍্যান্ডবলের প্রতিভা তুলে আনার ক্ষেত্রে বড় ভুমিকা আছে এই অতনু মজুমদারের।

আর আনিশা কি ভাবছে? এত দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে এগিয়ে যেতে পারবে? “আমি কবাডি নিয়ে খুব স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু যেভাবে আমাকে বার বার বাদ পড়তে হয়েছিল, মনটা ভেঙে গিয়েছিল। খেলা ছেড়ে দিতে চেয়েছালাম। দাদা বলেছিল, হ‍্যান্ডবল খেল। ভাল খেললে সুযোগ দেয়। দল নির্বাচনে কবাডির মতো হ‍্যান্ডবলে নোংরামি হয় না। সুবিনয় স‍্যার আমাকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করেন। ভাল প্র‍্যাকটিশের মধ‍্যে রাখেন। করোনার জন‍্য প্র‍্যাকটিশ বন্ধ হয়ে গেল। স‍্যার যেমন বলবেন সেই ভাবে চলব।” বলছিলেন আনিশা পারভিন। তোমার স্কুলও নাকি তোমাকে সাহায‍্য করে? “খুব সাহায‍্য করে। সবিতা ম‍্যামতো কতরকম ভাবে সাহায‍্য করেছেন তা বলে বোঝাতে পারবো না। শুধু সবিতা ম‍্যাম একা নন, আমার স্কুলের প্রতিটা ম‍্যাম লকডাউনের সময় আমাদের পরিবারের পাশে না দাঁড়ালে দুবেলা খাবার জুটতো না। এই সাহায্য কখনও ভুলতে পারবো না। শুধু তাই নয়, আমার এক জোড়া স্পোর্টস শু লাগবে। টাকার জন‍্য কিনতে পারছি না। স্কুলের ম‍্যামরা বলেছেন, চিন্তা না করতে, স্পোর্টস শু কিনে দেবেন। সবার সাহায‍্য পাচ্ছি। এখন ভাল খেলে বাংলার সিনিয়র দল এবং অবশ‍্যই ভারতীয় দলের খেলতে চাই। পারব। দেখা যাক।” বলছিলেন আনিশা।

এমন আনিশা বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শুধু দরকার কর্তাদের ‘অন‍্যায় কর্তৃত্ব’ না দেখিয়ে বাংলার ক্রীড়ার স্বার্থে ওদের ঠিক ভাবে তুলে এনে তালিম দেওয়া।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here