সন্দীপ দে
অবশেষে গা ঝাড়া দিয়ে আইএফএ-এর অচলাবস্থা কাটাতে আসরে নামলেন ময়দানের ‘কিং মেকার’ সুব্রত দত্ত। মঙ্গলবার, সন্ধ্যায় নিজেদের জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাব তাঁবুতে ‘দলের’ মিটিংয়ে সুব্রত দত্ত জানিয়ে দিলেন, পুরো বিষয়টা তিনি নিজ দায়িত্বে নিচ্ছেন। প্রয়োজনে আইএফএ প্রেসিডেন্ট অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও কথা বলবেন। সুব্রত দত্ত আশা করছেন, পয়লা বৈশাখের মধ্যেই সব সমস্যা মিটে যাবে।
প্রসঙ্গত, কয়েক মাস আগে অজিত ব্যানার্জিকে ইঙ্গিত করে স্বাধীন ভাবে কাজ না করতে পারার কারণ দেখিয়ে আইএফএ-এর সচিব পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন জয়দীপ মুখার্জি। রহস্যজনকভাবে জয়দীপের সঙ্গে তিন ভাইস প্রেসিডেন্টও পদত্যাগ করেন। আই লিগ শেষ হলে আইএফএতে আসবেন না। আগেই জানিয়েছিলেন। সেই কথা মতো গত ২৭ মার্চের পর থেকে জয়দীপ সহ ৬ পদাধিকারী আইএফএ অফিসে আসছেন না। আর জয়দীপদের ফেরাতে কোনও ক্লাব কর্তাও কোনও অনুরোধ করেননি। এই খবর প্রথম প্রকাশ করে ‘ইনসাইড স্পোর্টস।’

নিয়ম মতে আইএফএ সচিবের চেয়ারে ফের বসতে হলে জয়দীপকে পদত্যাগ প্রত্যাহার করতে হবে। আর এই পদত্যাগ প্রত্যাহার করতে হবে আইএফএ প্রেসিডেন্ট অজিত ব্যানার্জির কাছে। যা করলে মুখ পুড়বে জয়দীপের। এমন অবস্থায় আইএফএ-এর সংবিধান মেনে বাজি মাত করতে চাইছেন সুব্রত দত্ত। কি সেই সংবিধানের নিয়ম? মঙ্গলবার দলের মিটিং শেষে এক তরুন ক্লাব কর্তা ফোনে ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে জানালেন, ১৪ জন গভর্নিং বডির মেম্বার যদি আইএফএ-র বর্তমান অচলাবস্থা কাটাতে চেয়ে চেয়ারম্যান সুব্রত দত্তকে প্রস্তাব দিলে নাকি চেয়ারম্যান নিজে গভর্নিং বডির সভা ডাকতে পারেন। সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের অনুমতি নেওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়। এটা হলে গভর্নিং বডির সদস্যরা জয়দীপকে ফেরাতে চেয়ে ‘পাস’ করে দেবেন। কিন্তু জানা গেল, সুব্রত দত্ত তার আগে আইএফএ প্রেসিডেন্ট অজিত ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলে নিতে চান।
ময়দানের দত্ত পরিবার সব সময় চেয়ে এসেছে তরুণ প্রজন্মর মুখ। বিশ্বনাথ দত্তর পর আইএফএতে তরুণ প্রজন্মর মুখ হয়ে এসেছিলেন প্রদ্যোৎ দত্ত। তিনি বাংলার ফুটবলে আলোড়ন তুলেছিলেন। প্রদ্যোৎবাবুর উত্তরসূরী সুব্রত দত্ত। এক পরিবার থেকে তিন জন সচিব হওয়ার ঘটনা ভারতীয় ক্রীড়া জগতে মনে হয় হয়নি। সেই দত্ত পরিবারের সুব্রত দত্ত নাকি ময়দানের কিং মেকার। আসলে তাঁরই হাতে গড়া জয়দীপও তরুণ মুখ। সুব্রতবাবু তারুন্যকে প্রাধান্য দিলেও জয়দীপ ভুল চাল দিয়ে ফেলেছেন। তিনি ভুল জায়গায় ফোঁস করে ফেলেছেন। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে মাঠ করা অজিত ব্যানার্জি একদিকে আইএফএ-র প্রেসিডেন্ট, অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বড়দা। তাঁকে এইভাবে ফোঁস করাটা সুব্রত দত্ত কি ভাবতে পেরেছিলেন? জয়দীপ বিপ্লব করতে গিয়ে দত্ত পরিবারের ময়দানি ঐতিহ্যকে নজর দিলেন না। খুব সহজে অপ্রত্যাশিত কিছু হাতে পেলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।

সচিব পদে জয়দীপকে ফেরাতে গত সাড়ে তিনমাসে কোনও ক্লাব কর্তা সরকারি ভাবে কোনও চিঠি আজিত ব্যানার্জি বা সুব্রত দত্তকে পাঠায়নি। শুধু গত সপ্তাহে চাঁদনি ক্লাবের জনৈক কর্তা এবং গত সোমবার রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে জয়দীপের সমর্থনে চিঠি দিয়েছে। এই ঘটনা ময়দানে জয়দীপের জনপ্রিয়তা কতটা তলানিতে তা স্পষ্ট। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, দলের মিটিং ডেকে জয়দীপের সমর্থনে ১৪টি গভর্নিং বডির মেম্বারের চিঠি পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে হল। আরও অবাক কান্ড, জয়দীপের সমর্থনে দলের মিটিংয়ে গরহাজির অনেক কর্তা। মিটিংয়ে কর্তাদের সংখ্যা ২০ জনও হয়নি। অর্থাৎ জয়দীপে সমর্থন নেই বেশিরভাগ ক্লাবের। ময়দানে জয়দীপের জনপ্রিয়তা পরখ করে নিতেই কি শেষ মুহূর্তে আসরে নামলেন সুব্রত দত্ত?
বিদ্রোহ করতে পারতেন অজিত ব্যানার্জি। কিন্তু তিনি সেই রাস্তায় হাঁটেননি। আইএফএ-র অচলাবস্থার হাল ধরতে গত শুক্রবার থেকে আইএফএ অফিসে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট অজিতবাবু। কিন্তু আইএফএতে তাঁর উপস্থিতি আরও ঘোঁট পাকিয়ে দিয়েছে। পরপর দুদিন আইএফএ অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়েছে ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-এর এই সাংবাদিক। আইএফএ সূত্রের খবর, প্রেসিডেন্ট অজিত ব্যানার্জি শুক্রবার আইএফএ দফতরে গিয়ে কিছু নথি দেখতে চেয়েছিলেন। অভিযোগ, সেই নথি অজিতবাবুকে দেওয়া হয়নি। যেহেতু সচিব আসছেন না, তার জায়গায় প্রেসিডেন্ট এসে কাজ করতে চাইছেন। আর কাজ করতে হলে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে বলেই অ্যাকাউন্টস সহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে চেয়েছিলেন অজিতবাবু। কখনও তাঁকে বলা হয়েছে কম্পিউটার খারাপ বা কখনও বলা হয়েছে সব তথ্য না দেওয়ার নির্দেশ আছে। কে নির্দেশ দিয়েছে? কি এমন আছে সেই হিসেবে যা প্রেসিডেন্টকে দেখানো যায় না? সত্যিই কি এমন ঘটেছে? প্রশ্ন শুনে অজিত ব্যানার্জি বলেন,”এই মুহূর্তে আমি কিছু বলতে চাই না।” সচিব ফোন ধরেন না। মঙ্গলবার অফিস সুপারেন্টেন সব্যসাচী মল্লিক অফিসে আসছেন না। অ্যাকান্ট্যান্ট বিদ্যুৎকেও মঙ্গলবার অফিসে দেখা যায়নি। ফলে এই বিষয়ে আইএফএ-র প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।

১৯৬২ সালে আইএফএতে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। তৎকালীন অ্যাকাউন্টেন্ট স্বপ্নদিষ্ট হয়ে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য আইএফএ-র তহবিল থেকে ৮০ হাছার টাকা গঙ্গায় বিসর্জন দিয়েছিলেন। সেই অ্যাকাউন্টেন্টের দায়িত্বজ্ঞানহীন শিশুসুলভ কার্যকলাপ মানতে পারেননি আইএফএ-র তৎকালীন প্রেসিডেন্ট অতুল্য ঘোষ। সময় আইএফএ-র কোষাধ্যক্ষ ছিলেন গ্রিয়ার ক্লাবের এস কে সিনহা। সচিব বেচু দত্ত নাকি হিসাব ঠিক ভাবে দেখতেন না। সেই বছরই অ্যানুয়াল রিপোর্টে আইএফএ-র আর্থিক বার্ষিক জালিয়াতির অভিযোগ এনে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার পি কে সেন বেচু দত্তকে গ্রেফতার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট অতুল্য ঘোষ আটকে দিয়েছিলেন।
ফুটবলের স্বার্থে, আইএফএ-র স্বার্থে সেই কলঙ্কিত ইতিহাস আর যেন ফিরে না আসে।