ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্যবাহী নবাব কাপ

0

(প্রথম পর্ব)

*সন্দীপ দে
লালবাগ, মুর্শিদাবাদ

পশ্চিমবঙ্গে একাধিক প্রাচীন ফুটবল টুর্নামেন্ট ছিল। তার অধিকাংশ বন্ধ হয়ে গেছে। তার মধ্যেও এখনও উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জের কুলদাকান্ত শিল্ড, বাঁকুড়ার নন্দ শিল্ড প্রতি বছর হয়। আর একটা টুর্নামেন্টও হত, সেটি হত মুর্শিদাবাদের নবাবদের নবাব কাপ। সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৯ সালে নবাব কাপ হয়েছিল। পরে আবার বন্ধ হয়ে যায়। শেষ বার হয়েছিল ২০২৩ সালে। তারপর আবার বন্ধ। মুর্শিদাবাদ জেলার এই প্রাচীন ফুটবল টুর্নামেন্টটি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এই জেলায় আরও দুটি বিখ্যাত দুটি টুর্নামেন্ট হত। বীণাপানি এবং হুইলার শিল্ড। বহু বছর আগেই তা বন্ধ হয়ে গেছে।

Oplus_131072

নবাব কাপে একটা সময় খেলে গিয়েছেন চুনী গোস্বামী, পি কে ব্যানার্জিরা। বিরাট ইতিহাস এই নবাব কাপের। হয়তো নতুন প্রজন্ম জানেই না তার ইতিহাস।

কি সেই ইতিহাস? ১৯০২ (মতান্তরে ১৯১৬) মুর্শিদাবাদের লালবাগ শহরে শুরু হয়েছিল এই নবাব কাপ। ট্রফিটা পুরোটাই রুপোর তৈরি। জনপ্রিয় এই নবাব কাপ শুর করেছিলেন মীরজাফরের বংষধর নবাব ওয়াসেফ আলি মির্জা। তিনি যখন ইংল‍্যান্ডে পড়াশোনা করছিলেন সেই সময় ইংল‍্যান্ডের রানী নবাবের ক্রীড়া নৈপুন‍্যে খুশি হয়ে এই রূপোর ট্রফিটি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। যার একদিকে ব্রিটিশ প্রতীক (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) খোদায় করা আছে। দেশে ফিরে নবাব ওয়াসেফ আলি ট্রফিটির অপর প্রান্তে নবাবের বাসস্থান ‘ওয়াসেফ মঞ্জিল’ -এর প্রতীক খোদায় করেন। তারপর লালবাগ শহরের আস্তাবল মাঠে ‘নবাব কাপ’ নামে ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সিরাজ- উদ -দৌল্লার দাদু নবাব আলীবর্দী খাঁর সময় থেকেই যুদ্ধর বাহন হাতি, ঘোড়ার আস্তানা ছিল লালবাগ শহরের এই আস্তাবলে। তার পাশেই ছিল মাঠ। সেই মাঠেই শুরু হয়েছিল নবাব কাপ। যা ২০২৩ সালেও হয়ে এসেছে।

Oplus_131072

স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ দলগুলি এই নবাব কাপে অংশ নিত। ১৯৪৬ সালে নবাব ওয়াসেফ আলি মির্জা এই নবাব কাপের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন লালবাগ শহরের প্রাচীন ক্লাব বান্ধব সমিতির হাতে। এই বান্ধব সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯১৯ সালে। তখন নাম ছিল টাউন ক্লাব। সাতের দশকে নাম বদলে হয় বান্ধব সমিতি। প্রসঙ্গত, নবাব কাপ করার দায়িত্ব পায় এই বান্ধব সমিতি ক্লাব। এই নবাব কাপ ২০১৪ সালে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ২০১৯ সালে ফের শুরু হয়। কিন্তু কোভিডের কারণে তিন বছর এই টুর্নামেন্ট করা যায়নি। সব বাধা কাটিয়ে ২০২২ সালে ফের শুরু। ২০২৪ সাল থেকে আবার বন্ধ।

নিয়মিত ভাবে কেন নবাব কাপ করা যাচ্ছে না? তা জানতেই মুর্শিদাবাদের লালবাগ শহরে পৌঁছে গেছে inside sports বাংলার এই প্রতিবেদক। নবাব কাপ পরিচালনায় যারা আছেন সেই বান্ধব সমিতি ক্লাবের সচিব বৈকুণ্ঠ মন্ডল বলছিলেন,”টাকার অভাবে নবাব কাপ নিয়মিত করতে পারছি না। খারাপ লাগে। কিন্তু কি করব? আমাদের ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হলেন ইন্দ্রজিৎ ধর। তিনি নবাব কাপটা আবার শুরু করার চেষ্টা করছেন। দেখা যাক কি হয়।”

Oplus_131072

প্রসঙ্গত, এই ইন্দ্রজিৎ ধর হলেন মুর্শিদাবাদ পৌরসভার চেয়ারম্যান। বৃহস্পতিবার দুপুরে নিজের দফতরে বসে এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, “আমাদের এখানে সবাই নবাব কাপের কথা বলে। কিন্তু আর্থিক সাহায্য করার মানুষের অভাব। ২০২৩ সালে ফাইনাল শেষে গভীর রাতে একজন মদ্যপ অবস্থায় আমাকে ফোন করে কৈফিয়ত চাইছেন, “ফাইনাল দেখতে এসে সাইকেলটা অস্থায়ী গ্যারাজে রেখেছিলাম। আমি মেম্বার হওয়া সত্ত্বেও আমার কাছে কেন ৫ টাকা নেওয়া হল?”
বুঝুন অবস্থা। এই মেম্বারটি পাঁচ পয়সা দিয়ে নবাব কাপকে সাহায্য করেনি। আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, নবাব কাপ নিয়ে ইনভলভমেন্টটা কমে যাচ্ছে। এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও এই বছর আবার শুরু করার চেষ্টা করছি। “

মুর্শিদাবাদ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সচিব বিশ্বজিৎ ভাদুড়ী বলছিলেন, “আমাদের জেলার নবাব কাপটা ঐতিহ্যবাহী। সংগঠকরা চেষ্টা করছে শুরু করার।” রাজ্য ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা IFA সচিব অনির্বান দত্ত বলছিলেন,”নবাব কাপের বিরাট ইতিহাস। এমন ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্ট সক্রিয় থাকলে বাংলা ফুটবলের পক্ষে ভাল। আমার বিশ্বাস সংগঠকরা আবার শুরু করবে। ”

Oplus_2228224

টাকার অভাবে নবাব কাপ আটকে আছে। তাহলে এই লালবাগ শহরেই, মুর্শিদাবাদ জেলায় লক্ষ লক্ষ টাকার একাধিক টুর্নামেন্ট হচ্ছে কি করে? তাহলে কি আদি ফুটবল টুর্নামেন্ট বনাম নব্য ফুটবল টুর্নামেন্টের লড়াই? আদি টুর্নামেন্ট ত্যাগ করে মশালা ফুটবলে আসক্ত ফুটবল প্রেমীরা? এই জেলার সিস্টেমটাই কি বদলে দিয়েছেন স্পনসররা? নাকি ঐতিহ্যকে বাঁচাতে উদ্যোগের অভাব? মুর্শিদাবাদ জেলার ফুটবলের এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা পরের প্রতিবেদনে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here