সন্দীপ দে
২০১৬ বিধান সভা নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গে নারদা বিতর্কে জড়িয়ে রাজ্য সরকার তখন কোনঠাসা। সেই বছর নির্বাচনের আগে এক প্রচার সভায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন, “নির্বাচনের ২৯৪টি আসনে সব প্রার্থীই আমি। এটা ভেবেই, আমাকে দেখে ভোট দিন।”
আট বছর পর অনেকটা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় এর ঢংয়ে টুটু বসুও মোহনবাগান জনতার উদ্দেশ্য বলেছেন,”সৃঞ্জয়কে ভোট দেওয়া মানে আমাকে ভোট দেওয়া। মোহনবাগান ক্লাবের জন্য যদি কিছু করে থাকি তাহলে আমার জন্য ভোট দিন। আমি ভিক্ষে চাইছি। অনেকে বলছেন, আমি নাকি অথর্ব হয়ে গেছি। হুইল চেয়ারে ঘুরে বেড়াই। মমতাও কিন্তু হুইল চেয়ারে বসে নির্বাচন করেছিল। টাইগার অভি জিন্দা হায়। ”

৭৯ বছরের অসুস্থ টুটু বাবুর ভোট ভিক্ষার কাতর আবেদন এবং প্রচ্ছন্ন হুঙ্কার শোনার পর একটা ঘটনা পরিষ্কার, তা হল, মোহনবাগান ক্লাব নির্বাচনে জিততে সৃঞ্জয় বসুর একার দ্বারা সম্ভব নয়। সেটা বাবাও কি বুঝে গেছেন? দেবাশিষ দত্ত কি খুব শক্তিশালী প্রতিপক্ষ? সৃঞ্জয় যদি যোগ্য হন, বাগান জনতার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব হন , তাহলে চোখে চোখ রেখে বাবা ছাড়া লড়াই করার সাহস নেই কেন? বাবা না থাকলে এগোতেই পারছেন না টুটু পুত্র সৃঞ্জয়। এটা এখন গড়ের মাঠের সবাই বুঝে গেছেন। তাই বৃদ্ধ বাবাকেই আসরে নামতে হল!
দুই সপ্তাহ আগে বালিগঞ্জের নিজের বাড়িতে সাংবাদিক সম্মেলন করে টুটু বসু যে সব মন্তব্য করেছেন তাই নিয়ে ময়দানে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। যেদিন সন্ধ্যায় টুটুবাবু সাংবাদিক সম্মেলন করে পুত্র সৃঞ্জয় বসুর প্রচারে নামার কথা ঘোষণা করেছিলেন, সেইদিন সকালে ‘inside sports বাংলা”য় দেবাশিষ দত্তর একটি বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার প্রকাশ হয়েছিল। বসু পরিবারকে ইঙ্গিত করে মোহনবাগানে “পরিবার তন্ত্র”র কথা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন মোহনবাগানের বর্তমান সচিব দেবাশিস দত্ত। আর সেই রেশ ধরে টুটু বসু বলেছেন,”আমার হাত ধরে ক্লাবে এসেছিস। তখন পরিবার তন্ত্র ছিল না?” টুটুবাবু হয়ত ঠিক কোথায় বলেছেন। হতে পারে। কিন্তু তারপরও উঠছে সেই “পরিবার তন্ত্র” প্রশ্ন। টুটু বসুর বিস্ফোরক সাংবাদিক সম্মেলন করার পরও উঠছে একাধিক প্রশ্ন।

১) টুটু বসু বলেছেন, তাঁর তিনটি সন্তান – টুম্পাই, টুবলাই এবং মোহনবাগান। বাগান সদস্য -সমর্থকরা থেকে কর্তারা মোহনবাগান ক্লাবকে মা বলে মনে করেন। সেখানে টুটু বাবু মোহনবাগান ক্লাবকে সন্তান বলে, নিজেকে অভিভাবক বলে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অর্থাৎ তিনি নিজেকে শতাব্দী প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানের উর্দ্ধে ভাবছেন।
২) অঞ্জন মিত্রর বিরুদ্ধে যখন দেবাশিস -সৃঞ্জয় চলে গিয়েছিলেন তখন তো টুটু বসুও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। তিনিও তো বাল্য বন্ধুর বিরুদ্ধেই ছিলেন!
৩) দেবাশিস দত্ত যদি পদলোভী হয় তাহলে একই দোষে দুষ্ট টুটু বাবুও। ৭৯ বছর বয়েসও সভাপতির পদ আগলে থাকাটা কি নির্লভ এর প্রমান?
৪) অভিযোগ,গত ৩ বছর ধরে দেবাশিস দত্ত নানান ভাবে টুটুবাবুকে অসম্মান করেছেন। তাহলে তখন পদত্যাগ করে ক্লাব থেকে বেরিয়ে এলেন না কেন? নিজের কনিষ্ঠ পুত্র সৌমিক বসু হটাৎ দেবাশিসের প্রচার মঞ্চে ওঠাটার কারণেই পদত্যাগ?
৫) মোহনবাগান ক্লাবের জন্য তিনি সত্যিই অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু ক্লাবকে যত দিয়েছেন তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছেন। ক্লাবে আসার আগে ব্যবসায়ী টুটু বসুকে কয়জন চিনতেন? মোহনবাগান ক্লাবে এসে টুটু বাবু পেয়েছেন সামাজিক প্রতিষ্ঠা। মোহনবাগান যতদিন থাকবে ততদিন টুটু বসু নামটাও ইতিহাসের পাতায় থাকবে। এটা তাঁর বেশি পাওয়া নয়?

৬) ছেলের পক্ষে বাবা একশোবার প্রচার করতেই পারেন। সমস্যা নেই। কিন্তু ছেলেকে জেতাতে যে ভাবে আসরে নামলেন তিনি, তাতে গড়ের মাঠে পুত্র সৃঞ্জয়ের সীমাবদ্ধতা নিয়েই তো প্রশ্ন তুলে দিলেন।
৭) টুটু বাবু বলেছেন, সৃঞ্জয় যোগ্য। তিনি যদি যোগ্যই হবেন তাহলে তাঁকে অসুস্থ শরীর নিয়ে আসরে নামতে হল কেন? নিজের ক্ষমতায় লড়াই করার সেই আত্মবিশ্বাস সৃঞ্জয়ের মধ্যে দেখা যায় না কেন?
৮) এই নির্বাচনে যদি দেবাশিস দত্ত জয় পায় তাহলে মুখ পুড়বে পিতা -পুত্রের। আর যদি সৃঞ্জয় জয়লাভ করে তাহলে সেই জয় গৌরবের হবে না। কারণ সবাই তখন বলবে এই জয় টুটু বসুর জয়। উনি ছিলেন বলেই সৃঞ্জয় জিতেছেন। ফলত, সৃঞ্জয়ের কেরিয়ারে “বাবার দ্বারা জয় ” – তকমাটা লেগে যাবে।
৯) যখন টুটু বসু থাকবেন না, তখন এই সৃঞ্জয়কে কে টেনে নিয়ে যাবে?
টুটুবাবু বলেছেন, তিনি মানুষ চিনতে ভুল করেছেন। শেষ তিন বছর দেবাশিসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। তাহলে সভাপতির পদ থেকে তখন কেন পদত্যাগ করেননি টুটুবাবু? বিপ্লব করে কমিটি থেকে কেন বেরোননি? গত বছর ভবানীপুর মাঠে কলকাতা লিগের একটি ম্যাচে উপস্থিত ছিলেন টুটু বসু। কেন তাঁকে মোহনবাগান ক্লাবে দেখা যায় না? সেইদিন উত্তরে টুটুবাবু বলেছিলেন, “আগের মত পরিবেশ নেই তাই যাই না।” তখনও তো পদত্যাগ করে বেরিয়ে আসেননি? ফর্মে থাকতে থাকতে সরে গেলে টুটু বাবু এতো প্রশ্নর মুখে পড়তেন?

৭৯ বছর বয়স। অসক্ত শরীর। সভাপতির পদ আঁকড়ে বসে ছিলেন কেন? নতুন মুখ কি আনা যেত না? মোহনবাগান ক্লাবে টুটু বসুর অবদান ভোলার নয়। তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এতদিন ধরে পদে থাকার লোভটা কি তাহলে টুটু বসুরও আছে? এখন পদত্যাগ করা মানে পুত্র সৃঞ্জয়ের হয়ে ভোটের পেট ভরাতেই আসরে নামার অর্থই হল “বসু পরিবার’-এর প্রতিনিধিকে মোহনবাগান ক্লাবে জায়গায় করে দেওয়া। অর্থাৎ সেই “পরিবার তন্ত্র” শব্দটাই ঘুরে ফিরে আসছে।

টুটু বসু যাকে নিয়ে এতো লড়াই করছেন তিনি সৃঞ্জয় বসু। তাঁর জ্যৈষ্ঠ পুত্র। কিন্তু সংগঠক হিসেবে কতটা ভাল সেটা টুটু বসুও ভাল জানেন। জানেন মোহনবাগান ক্লাবের একটা বড় অংশও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোহনবাগান ক্লাবের এক প্রবীণ কর্তা (অঞ্জন মিত্রর মৃত্যুর পর তিনি ক্লাবে কম আসেন) ফোনে এই উটকো সাংবাদিককে বলছিলেন,”নির্বাচন নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। তবে এটুকু বলতে পারি,বাবা থাকলেই কি সব পাওয়া যায়? টাকা থাকলেই কি ইচ্ছে মতন ইচ্ছে পুরন হয়? মাঠ করতে হয়। সংগঠন করতে হয়। সেই সঙ্গে থাকতে হয় উন্নত মানের মেধা। মধ্য মেধা নিয়ে বেশিদূর এগোনো যায় না। তবে হ্যা, যে প্রভাবশালীর আশীর্বাদ পাবে সেই জিতবে।”

সৃঞ্জয় জেল যাত্রা কাটিয়ে ফেরার পর একটা সময় এই টুটু বসু বলেছিলেন,”আমার তিনটি ছেলে – টুম্পাই, টুবলাই এবং দেবাশিস। দুই সপ্তাহ আগে টুটুবাবুকে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি তা অস্বীকার করে বলেন,”আমি এমন কথা বলিনি। আমার তিন সন্তান হল, টুম্পাই, টুবলাই আর মোহনবাগান।” সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবৃতিও বদলে যায়।
আসলে টুটু বসুর কনিষ্ঠ পুত্র টুবলাই ওরফে সৌমিক বসুকে নিজেদের নির্বাচন প্রচার মঞ্চে তুলে টুটু -সৃঞ্জয়কে ঘেঁটে দিয়েছেন দেবাশিষ দত্ত। সৌমিক সেদিন শুধু মঞ্চেই ওঠেননি, যেভাবে বর্তমান কমিটি ও দেবাশিষ দত্তর প্রশংসা করেছেন তাতে সৃঞ্জয়ের “যেতা ম্যাচ” অনিশ্চিত করে দিয়েছেন দেবাশিস দত্ত। এই দেবাশিস প্রচন্ড বুদ্ধিমান। কিন্তু দেবাশিস দত্তর বড় শত্রু হল তাঁর মুখের কথা। অহংকারী। অনেকেই তাঁর কথায় আহত হন। তাঁর কথা বলার ধরণ বাদ দিলে কিন্তু ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে যোগ্য। একটা সময় সচিব পদে না থেকেও ১২ বছর ধরে মোহনবাগান ক্লাবটা দেবাশিসই চালিয়ে এসেছেন। তিনি প্যারাসুট করে সচিব পদে বসেননি। গড়ের মাঠে দক্ষ কর্তা (ফুটবল ) যদি এখন থাকে তাহলে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের নিতু সরকারের পর দেবাশিস দত্তর নামটাই আসবে। আর এই দেবাশিসকে নিয়ে অতীতে ক্লাবের ভোট করেছেন টুটুবাবু। কাজেই দেবাশিসের স্কিল সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। টুটু বাবুর সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হল, তাঁর ছোট ছেলে টুবলাইকে “ম্যানেজ” করা। অর্থাৎ ঘর সামলে তারপর দেবাশিস।

আসন্ন ক্লাব নির্বাচনে কে জিতবেন? এখনই বলা যাচ্ছে না। বিশেষ রাজনৈতিক দলের কতটা ভূমিকা থাকবে? বসু পরিবারে যেমন, “কোন পক্ষ” কি চাইছে? তেমনি বিশেষ রাজনৈতিক দলের “কোন পক্ষ” কি চাইছেন? এইসবও বিরাট ফ্যাক্টর কাজ করবে। টুটু বসুর “ভোট ভিক্ষা” অথবা “টাইগার অভি জিন্দা হ্যায়” – এই সংলাপ খুব একটা কাজে আসবে না তা হলফ করেই লিখে দেওয়া যায়। ভোট যদি প্রভাবশালীর প্রভাব মুক্ত হয়,নিরপেক্ষ হয়,তাহলে কিন্তু টুটু বাবু – সৃঞ্জয় কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়ে যাবেন।