▪সন্দীপ দে▪
১৬ নভেম্বর ১৯৯৪ সাল। রাত ১০ টা। সেই শীতের রাতে কলকাতা বিমানবন্দরের বাইরে হাজার হাজার মানুষ। কারও মুখে কোনও কথা নেই। সবাই যেন মৌনব্রতে মগ্ন। কিন্তু যখন দিল্লি থেকে নিয়ে আসা ৫৪ বছরের দীর্ঘকায় মানুষটার নিথর দেহটা বিমান বন্দরের বাইরে আনা হল,তখন সেই শীতের রাতে অপেক্ষায় থাকা হাজার হাজার মানুষগুলো হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আছড়ে পড়লেন নিথর দেহটির উপর। যেন সেই সব মানুষ গুলোর কাছে নিজ আত্মীয় বিয়োগের সমান। উচ্চশিক্ষিত, বিচক্ষন, আপসহীন, দোর্দ্যন্ডপ্রতাপ এবং চূড়ান্ত সফল আইএফএ সচিব প্রদ্যোৎ দত্তর মরদেহ দেখে দিশাহীন হয়ে পড়েছিলেন বাংলার ক্রীড়াপ্রেমিরা।
পরের দিন সকালে প্রদ্যোৎবাবুর মরদেহ নিয়ে মহানগরে যে মিছিল বেড়িয়েছিল তা নজির বিহীন। শুধু ক্রীড়া জগত নয়, সব মহলের মানুষ সেদিন পথে নেমেছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বাংলার ফুটবল সেদিন সুযোগ্য অবিভাবককে হারিয়েছিল। আজও তা টের পাওয়া যায়।
আজ প্রদ্যোৎবাবুর ২৬তম মৃত্যু বার্ষিকী। তাঁর অমর কীর্তি পুরোটা এই নিউজ পোর্টালের কম্ম নয়। যতদুর সম্ভব তুলে ধরার চেষ্টা করা হল।
সাতের দশকে বাংলার ফুটবলকে স্বর্ণযুগ বলা হয়। সেই সময় আইএফএতে কি সব ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অতূল্য ঘোষ, হেমন্ত দে, রঘুনাথ দে, স্নেহাংশু আচার্য, অশোক মিত্র, পঙ্কজ গুপ্ত, এম দত্ত রায় (বেচু), অজিত সেনগুপ্ত, আদিত্য কাশ্যপ, বিশ্বনাথ দত্ত – তালিকাটা দীর্ঘ। বিশুবাবু যদি আইএফএ-র ভীত শক্ত করে থাকেন, তাহলে তাঁর ভাই প্রদ্যোৎবাবু সমাজে আইএফএকে একটা উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। এমন উদাহরণ একাধিক।
১৯৮৮ সাল। কলকাতার ‘হোটেল হিন্দুস্তান’-এর পাশের বাড়ি জনৈক জয়ন্ত রায়ের। তখন সন্ধ্যা ছাড়িয়ে রাত। জয়ন্ত রায়ের বাড়ির সামনে পুলিশ বাহিনী। আর সেই বাড়ির বিপরিতে (রাস্তার ওপারে) একটা মারুতি ভ্যানে টেনশন নিয়ে বসে আছেন আইএফএ-এর তৎকালীন সচিব প্রদ্যোৎ দত্ত। তিনি অপেক্ষা করে বসে আছেন মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করার জন্য। শিলিগুড়িতে ভারত বিখ্যাত নেহেরু কাপ। কিন্তু ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর নানান ‘প্যাঁচের খেলায়’ নো অবজেকশন লেটার পাননি প্রদ্যোৎবাবু। তিনি জেনে গিয়েছিলেন, সেই রাতে জয়ন্ত রায়ের বাড়ি যাবেন জ্যোতি বসু। তাই বাধ্য হয়েই তাঁর সঙ্গে দেখা করাটা খুব জরুরি ছিল। উল্লেখ্য, সেদিন রাতে মূখ্যমন্ত্রী যে বাড়িতে উঠেছিলেন সেই জয়ন্ত রায় ছিলেন জ্যোতিবাবুর আত্মীয়।
সেই রাতে না পেলেও পরের দিন প্র্দ্যোৎ দত্তকে নেহেরু কাপ খেলার ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু।
আইএফএ-র আপসহীন, ডাকাবুকো সচিব প্রদ্যোৎ দত্তর উপর ফুটবল নিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত আইএফএর উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মন্ত্রী সুভাষ। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের রোটান্ডায় হওয়া এক মিটিংয়ে মন্ত্রী সুভাষকে মুখের উপর প্রদ্যোৎবাবু বলে দিয়েছিলেন, তিনি সবার আগে আইএফএর স্বার্থ দেখবেন। মন্ত্রীর দাবি মানতে পারবেন না। তারপর থেকেই সুভাষ চক্রবর্তী -প্রদ্যোৎ দত্তর সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। শিলিগুড়িতে নেহেরু কাপ করতে গিয়ে আইএফএ-র প্রায় ২৭ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়। আর এই ক্ষতি করানোর ক্ষেত্রে নাকি ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী অদৃশ্য ‘কালো হাত’ ছিল। শুধু তাই নয়, অভিযোগ, এই সুভাষের মদতে শিলিগুড়ির সিপিএম পার্টির একটা বড় অংশ আইএফএ-এর প্রতি চূড়ান্ত অসহযোগিতা করেছিল। কয়েকটা ভাল স্পনসর বন্ধ হয়ে গেল। শুধু FEDERATION OF CHEMBERS OF COMMERCE AND INDUSTRY থেকে কয়েক লক্ষ টাকা পেয়েছিল আইএফএ। কিন্তু শুরুতেই অর্থাভাব। তবুও প্রদ্যোৎবাবুকে দমানো যায়নি। আইএফএ অফিস বন্ধক রেখে শিলিগুড়িতেই নেহেরু কাপ করেছিলেন প্রদ্যোৎ দত্ত।
শিলিগুড়ির ফুটবল উন্মাদনা সেই সাতের দশক থেকেই। কিন্ত নেহেরু কাপকে কেন্দ্র করেই ভারতীয় ফুটবলের মানচিত্রে জায়গা করে নিতে পেরেছিল শিলিগুড়ি। উত্তরবঙ্গের এই বাণিজ্যিক শহরে ফুটবলের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা এই প্রদ্যোৎ দত্তর। তিনি নেহেরু কাপকে সামনে রেখে শিলিগুড়িতে করেছিলেন আজকের কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম। অতীতে এই স্টেডিয়াম ছিল না। ছিল একটা খোলা মাঠ। নাম ছিল ‘তিলক ময়দান।’ মাঠটা ছিল সেনাবাহিনীর অধিনে। ১৯৭৬-‘৭৭- এর দিকে ঠিক হল, এই তিলক ময়দানে স্টেডিয়াম গড়া হয়। তৎকালীন ডিফেন্স মিনিস্টার বংশীলালের
অনুমতি পাওয়া গেল। সেই সঙ্গে তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ও অনুমতি দিলেন। স্টেডিয়াম গড়ার জন্য তৈরি হল একটি কমিটি। সভাপতি হলেন শিলিগুড়ির তৎকালিন জেলা শাসক মণীশ গুপ্ত। সচিব কালী ঘোষ। কয়েক বছর পর ১৯৮০ সালে মাঠের একটা অংশে কাঠের গ্যালারি করে শুরু হয়েছিল শিলিগুড়ি কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম। পরে ১৯৮৫ সালে মেয়র বিকাশ ঘোষদের সাহায্য নিয়ে প্রদ্যোৎ দত্তর উদ্যোগে পূর্ণাঙ্গ স্টেডিয়াম তৈরি হয়। সেটাই ছিল উত্তরবঙ্গে প্রথম কোনও পূর্ণাঙ্গ স্টেডিয়াম।
ওই সময় নেহেরু কাপের জন্য উত্তরবঙ্গের ব্যবসায়ী সংগঠন ‘ফোসিন’ – এর কাছ থেকে প্রায় ২১ লক্ষ টাকা নিশ্চিত করেছিলেন প্রদ্যোৎবাবু। কিন্তু একদিন ‘উত্তরবঙ্গ’ সংবাদপত্রে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল। তাই দেখে ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী তাঁর ডান হাত আশু করকে দিয়ে প্রদ্যোৎবাবুর কাছে খবর পাঠালেন, প্রকাশিত খবরের প্রেক্ষিতে তিনি যেন একটা রিজয়েন্ডার দেন। “আমি কিছুই বলিনি” -এই কথা বলতে হবে। না হলে ফোসিনের টাকা দেওয়া যাবে না। প্রদ্যোৎবাবু রিজয়েন্ডার দেননি। শেষে আইএফএ অফিসটাকে ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের কাছে বন্ধক রেখে নেহেরু কাপ করেছিলেন প্রদ্যোৎ দত্ত। পরবর্তীকালে আইএফএ সভাপতি জাস্টিস অজিত সেনগুপ্তর সাহায্য নিয়ে ব্যাঙ্কের ইন্টারেস্ট মুকুব হলে আইএফএ অফিস বন্ধক মুক্ত হয়।
আইএফএর স্বর্ণযুগ কার সময়? এই বিতর্ক উঠলে দাদার আগে ভাই প্রদ্যোৎ দত্তর নামটাই আগে উঠে আসে। আইএফএ থেকে সিএবি, বিসিসিআই চলে গিয়েছিলেন বিশ্বনাথ দত্ত। ক্রিকেটেও তিনি সফল।
আইএফএ সচিব পদে বসে প্রদ্যোৎ দত্ত ফুটবলে নবজাগরন এনেছিলেন। কি কি করেছিলেন?
১) তিনিই প্রথম ফুটবলে স্পনসর এনেছিলেন (চার্মস,ফিলিপস,লাইফবয়)। এই চার্মস কোম্পানি প্রদ্যোৎবাবু আনতে পেরেছিলেন মমতা ব্যানার্জির জন্যই। উল্লেখ্য, মমতা ব্যানার্জি প্রদ্যোৎবাবুকে দাদার মতো ভীষন শ্রদ্ধা করতেন।
২) প্রথম ফুটবল অ্যাকাডেমি শুরু করেছিলেন। হাওড়া ইউনিয়নের সাহায্যে ও পিয়ারলেসের পৃষ্ঠপোষকতায়। অাইএফএর প্রথম অ্যাকাডেমমি শুরু হয়েছিল। পরে এই অ্যাকাডেমিকে সুব্রত দত্ত হলদিয়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
৩) সব ক্লাবকে সমান অধিকার তিনিই দিয়েছিলেন।
৪) লিগের ম্যাচে মাঠে অ্যাম্বুলেন্স, ওয়াকিটকি ও জলের ব্যাবস্থা করা হয়।
৫) দলবদলে প্রথম টোকেন সিস্টেম তিনিই চালু করেন।
৬) ময়দানে অনেক ছোট ক্লাব ছিল যাদের ড্রেস করার জায়গা ছিল না। বিভিন্ন ক্লাব তাঁবুতে সেই সব ছোট ক্লাবের ড্রেস করার ব্যবস্থা করেছিলেন।
৭) প্রথম মহিলা ফুটবল,নার্সারি এবং সাবডিভিশন ফুটবল শুরু করেছিলেন।
৮) বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে সবুজ বাঁচাও আন্দোলন করে (মমতা ব্যানার্জি সহ সমাজের সকল স্তরের মানুষকে পাশে নিয়ে) রবীন্দ্র সরোবরকে বাঁচিয়ে ছিলেন।
৯) তাঁর জীবনের সেরা সাফল্য শিলিগুড়িতে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম করে নেহেরু কাপ করা।
প্রদ্যোৎ দত্ত ছিলেন দাপুটে সচিব। মহমেডান স্পোর্টিংয়ের মতো টিমকে সাসপেন্ড করতে ভয় পাননি। দোর্দন্ডপ্রতাপ মীর মহম্মদ ওমরকেও শাসনে রেখেছিলেন। মহমেডানকে নির্বাসনে পাঠানো নিয়ে তুমুল বিতর্ক বাংলার ফুটবলে। তাঁর এমন সিদ্ধান্ত দেখে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু একদিন প্রদ্যোৎবাবুকে বাড়িতে ডেকে বিষয়টা জানতে চেয়েছিলেন। শুনে জ্যোতিবাবু বলেন,”সবই বুঝলাম। ওরা অন্যায় করেছে। কিন্তু প্রচুর চাপ আসবে। মিস্টার দত্ত, আপনার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকতে পারবেন?”
উত্তরে সেদিন প্রদ্যোৎবাবু বলেছিলেন, “স্যার, আপনার আশীর্বাদ থাকলে নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকতে পারবো।” কথাটি শুনে, কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে জ্যোতিবাবু বলেছিলেন,”গো অ্যাহেড”। তাঁদের এই কথোপকথনের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন প্রদ্যোৎবাবুর ভাগ্নে দীপু বাবু। তিনিই ‘ইনসাইড স্পোর্টস” ঘটনাটি জানান।
কত ঘটনা আছে। লিখে শেষ করা যাবে না। এমন ডাকাবুকো আইএফএ সচিব আর বাংলা পাবে না। তিনি কখনও রিপোর্টার ধরে নিজের ও আইএফএ-র প্রচার পাওয়ার চেষ্টা করেননি। তিনি কাজে বিশ্বাস করতেন। আজ অসহায় বাংলার ফুটবলে প্রদ্যোৎবাবুকে আমরা সবাই মিস করছি।