৯৫ তম জন্মদিবস : বাংলার ফুটবলে আজও উপেক্ষিত সুশীল ভট্টাচার্য

0

সন্দীপ দে ◆

কোনও ব‍্যক্তির মৃত‍্যুর পর আমরা সবাই ভুলে যায় তাকে। সেটা যে মারাত্মক অপরাধ তা হয়তো নয়। সবাই সামনের দিকে ছুটছে। পিছন ফিরে তাকানোর সময় নেই। তা সত্বেও কিছু কিছু ঘটনা, ব‍্যক্তিত্ব থাকেন যাদের ভোলা যায় না। তবুও যেন তাঁদের ভুলে যেতে চাই। কেন এমন হয় এর ব‍্যাখ‍্যা এই উটকো সাংবাদিকের কাছেও নেই।
আজ সকালে (৩১ ডিসেম্বর ২০২০) ফেসবুক খুলতেই প্রাক্তন ফুটবলার অভিজিৎ মন্ডলের একটি পোষ্ট চোখে পড়লো। নিজের পোস্টে তাঁর জীবনের ফুটবল গুরুর জন্মদিনে নমস্কার জানিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন অভিজিৎ। কে এই গুরু? ভারতীয় ফুটবলের কিংবদন্তি কোচ সুশীল ভট্টাচার্য। খোঁজ নিয়ে দেখলাম সুশীলবাবুকে মনে রেখে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন একমাত্র অভিজিৎই। কোনও ক্লাব, আইএফএ বা সুশীলবাবুর হাত ধরে উঠে আসা ভারত বিখ‍্যাত হওয়া ফুটবলার – সবাই নীরব।
সৌরভ গাঙ্গুলির কথা ছেড়েই দিন, তাঁর পত্নী বা কন‍্যার জন্মদিন হলেই সোসাল মিডিয়ায় শুভেচ্ছার বন‍্যা বইতে থাকে। বিরাট কোহলি,অনুষ্কা থেকে সুনীল ছেত্রী এঁদের জন্মদিন জানা যায় খুব সহজে। কিন্তু যারা খেলোয়াড় তৈরি করে গিয়েছেন। তাঁদের আমরা মনে রাখি না।

যারা এই প্রজন্মের ফুটবল প্রেমি তারা অমল দত্ত, পিকে ব‍্যানার্জির নাম জানেন। বড়জোর অচ‍্যুৎ ব‍্যানার্জি, বাঘাসোমের নাম হয়তো জানেন। কিন্তু এঁদের বাইরেও এমন কিছু মানুষ আছেন তাদেরকে আমরা ভুলতে বসেছি। রাজ‍্য ফুটবলের নিয়ামক সংস্থাও যেন আটকে আছে শুধু পিকে-চুনীতেই। বাকিরা সব অতীতের গভীর অন্ধকারে। সুশীল ভট্টাচার্য সেরকমই একজন মানুষ।

শোনা যায়, তাঁর দলের অনুশীলনের শেষে মাঠের একধারে দাঁড়িয়ে থাকতেন খড়দহ থেকে ফুটবল অনুশীলন করতে আসা কবীর বসু। সুশীলবাবু কিছু টাকা কবীরের হাতে গুঁজে দিতেন। আসলে ওই সামান‍্য টাকা দিয়েই বাস ও ট্রেনের টিকিট কাটতেন কবীর। রামকৃষ্ণ মিশনে যখন কোচিং করাতেন তখন তাঁকে কোচিং করার জন‍্য পারিশ্রমিক দিত রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ। তিনি টাকা নিতেন না। সহকারি কোচকে সঙ্গে করে ময়দান মার্কেটে আসতেন। যাদের বুট কেনার সামর্থ ছিল না, তাদের সুশীলবাবু বুট কিনে দিতেন তাঁর কোচিংয়ের টাকায়। এমন বহু উদাহরণ আছে।

ভারতীয় দলের জার্সি গায়ে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তাঁদের একটা বড় অংশ সুশীল ভট্টাচার্যর হাত ধরে উঠে এসেছেন। বড় ফুটবলার হওয়ার ক্ষেত্রে এঁদের নেপথ‍্যে সুশীলবাবুর বিরাট ভূমিকা আছে। দীর্ঘ তালিকাটা হল এই রকম – পিকে ব‍্যানার্জি, সুকুমার সমাজপতি, রাম বাহাদুর, তুলসীদাস বলরাম, ভাস্কর গাঙ্গুলি, সুধীর কর্মকার, সমরেশ চৌধুরী, গৌতম সরকার, শিবাজি ব‍্যানার্জি, সুভাষ ভৌমিক, প্রশান্ত ব‍্যানার্জি, অরুণ ব‍্যানার্জি, কৃশানু দে, কবীর বসু, অচিন্ত বেলেল, অভিজিৎ মন্ডল, কুন্তলা ঘোষদস্তিদার, শান্তি মল্লিক।

সুশীল ভট্টাচার্যই হলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রথম কোচ। ১৯৬১ সালে লাল-হলুদকে লিগ দেওয়ার পাশাপাশি ভারতীয় ফুটবলে সুশীলবাবু চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন মহিলা ফুটবলের উত্থানের জন্য৷ ১৯৭৫ সালে শান্তি মল্লিক, কুন্তলা ঘোষদস্তিদার, শুক্লা দত্তদের নিয়ে শুরু হয় বাংলার প্রথম মেয়েদের ফুটবল টিম৷ সুশীলের কোচিংয়ে সে বার বাংলা জাতীয় চ্যাম্পিয়ন৷ পরের বছর সুশীল জাতীয় দলের কোচও হন৷ গতবছর এক অনুষ্ঠানে সুশীলের ছাত্রী ‘অর্জুন’ শান্তি মল্লিক বলছিলেন, ‘স্যর আমার কাছে সব ছিলেন৷ খেলা শেখানো থেকে শুরু করে আমার ভালো-মন্দ সবই দেখতেন উনি৷’ আর কুন্তলা বলেছিলেন,”সুশীলস‍্যার তো আমার বাবার মতো ছিলেন। আজ ময়দানে ফুটবলে যতটুকু কাজ করে খাচ্ছি ওই মানুষটার জন‍্য।”

১৯৫৮ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা পঞ্চাশ বছর কোচিং করেছেন সুশীলবাবু। ভাবা যায়!

তিনি ছিলেন কমপ্লিট খেলোয়াড়। ক্রিকেট, হকি এবং ফুটবল দক্ষতার সঙ্গে খেলতেন।
১৯৪৫ থেকে ৪৮ সাল ইস্টবেঙ্গলে খেলেছেন সুশীল ভট্টাচার্য৷ খেলতেন রাইট ইন পজিশনে৷ প্রথম ম্যাচেই ডালহৌসির বিরুদ্ধে হ্যাটট্টিক ছিল তাঁর৷ শুধু ফুটবল নয়, ইস্টবেঙ্গলের হয়ে ক্রিকেট ও হকিও খেলেছেন। ব্যাটসম্যান সুশীল ভট্টাচার্যর পাঁচটা সেঞ্চুরিও ছিল সিএবি লিগে৷ পরে রেলের হয়ে ফুটবল খেলেন৷ কোচিংও করান৷ ১৯৪৫-৪৮ খেলেছেন ইস্টবেঙ্গলে সব মিলিয়ে ছিল ১০ গোল৷ ৮টি কলকাতা লিগে৷ ২টি আইএফএ শিল্ডে ১৯৪৬ ভারতীয় দলের হয়ে ইউরোপিয়ান টিমের বিরুদ্ধে খেলেছেন ১৯৪৮ সালে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে মায়ানমার যান। পরবর্তীকালে তিনি ইস্টার্ন রেল ও জর্জটেলিগ্রাফের হয়েও খেলেছেন।
প্লেয়ার সুশীলের তুলনায় কোচ সুশীল অনেক বেশি পরিচিত ছিলেন ময়দানে৷ ১৯৫২ সালে শেষ বার কলকাতা লিগ জিতেছিল ইস্টবেঙ্গল৷ পরের বছর থেকে বুট পরে খেলা শুরু হয় ময়দানে৷ তার পর থেকে সাফল্য ছিল না লাল-হলুদের৷ ১৯৬১ সালে সুশীল দায়িত্ব নেওয়ার পর ওই বছর লিগ জেতে ইস্টবেঙ্গল৷ ওই টিমে ছিলেন তুলসীদাস বলরাম, অরুণ ঘোষ, সুকুমার সমাজপতি, , শ্রীকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, বিক্রমজিত্‍ দেবনাথ, অবণি বসুর মতো ছয়ের দশকের নামী ফুটবলাররা৷ তাঁর কোচিংয়েই প্রথম ডিভিশনে উঠেছিল টালিগঞ্জ অগ্রগামী৷ ১৯৭১ সালে টালিগঞ্জকে আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে তুলেছিলেন সুশীলবাবু, ইস্টবেঙ্গলকে সেমিফাইনালে হারিয়ে৷
ইস্টবেঙ্গল তাঁর কাছে ছিল প্রাণের ক্লাব৷ ইচ্ছে ছিল, তাঁর শেষ যাত্রায় যেন থাকে ক্লাবের সদস্য কার্ডটাও৷ ২০১৫ সালে ক‍্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে যখন তাঁর মৃত‍্যু হয় তখন সুশীলবাবুর মরদেহে লাল-হলুদ পতাকার সঙ্গে মোড়া বুকে ইস্টবেঙ্গলের ওই সদস্য কার্ডটাও রেখেছিলেন ইস্টবেঙ্গলের কর্তারা।

সুশীল বাবুর জন্ম দার্জিলিং জেলার বাগডোগরায়। বাবার বদলির চাকরির ফলে বিভিন্ন জায়গায় তাঁকে থাকতে হয়েছিল। সুশীলবাবু যখন বহরমপুরে ছিলেন তখন পড়াশোনা করতেন কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলে। তখনই প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে খেলোয়াড় জীবন শুরু হয়। পরে তাঁর বাবা রাঁচিতে বদলি হলে পড়াশোনার জন‍্য সুশীল সহ বাকি ছেলেমেয়েদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেন তাঁর বাবা। ঢাকা জুবিলি স্কুলে সুশীল ভট্টাচার্য যখন ভর্তি হন তখন তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর। ওই জুবিলি স্কুলে ফুটবল চর্চা ছিল। তাঁর ফুটবলে ঝোঁকটা আসে ঢাকার জুবিলি স্কুল থেকেই। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে আসেন ১৯৪১ সালে। তারপর থেকে কলকাতাতেই তিনি ফুটবল নিয়ে মেতে ওঠেন।

সাতের দশকে বাংলায় শান্তি, কুন্তলা, শুক্লাদের নিয়ে তৈরি করলেন মহিলা ফুটবল দল। শুধু বাংলা নয়, ভারতীয় ফুটবল দলের প্রথম কোচ হলেন এই সুশীল ভট্টাচার্য। গতকাল (৩০ ডিসেম্বর) মহিলাদের কন‍্যাশ্রী কাপ হয়ে গেল। এই টুর্নামেন্টে তাঁর নামে কোনও পুরস্কার দিয়ে সুশীল ভট্টাচার্যকে সম্মান জানানোর সুযোগ ছিল আইএফএ-এর। কিন্তু সেই সম্মান দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়নি নাকি সুশীলবাবুর কথা মনেই ছিল না আইএফএ কর্তাদের? কেউ মনে রাখে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here