৪ বছর পার,এখনও বসল না সুদীপের মূর্তি, মন্ত্রী অরূপ রায়ের প্রতিশ্রুতি অব‍্যহত

    0

    ◆সন্দীপ দে◆

    ২০২০ সালের ১০ মে মন্ত্রী অরূপ রায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, হাওড়া তথা ভারতের কিংবদন্তি ফুটবলার প্রয়াত সুদীপ চ‍্যাটার্জির মূর্তি বসাবেন। দেখতে দেখতে চার বছর পার। এখনও বসল না সুদীপের মূর্তি। এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে মন্ত্রী অরূপ রায় এখনও প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন। সম্প্রতি হাওড়া ময়দানে স্বপন ব‍্যানার্জি (বাবুন) কালীঘাট লাভার্সের জার্সি উন্মোচনের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অরূপ রায়। সেই অনুষ্ঠানের শেষে মন্ত্রীকে তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে করাতেই ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে বলেছিলেন,”আমরা অবশ‍্যই সুদীপের মূর্তি বসাবো।” চার বছর হয়ে গেল। এখনও সুদীপের মূর্তি বসল না। এই বছর কি বসবে? উত্তরে মন্ত্রী অরূপ বলেন,”এই ভাবে দিন,তারিখ, মাসের কথা বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি মূর্তি বসবে।” বলেই মাথায় হ‍্যাট পড়ে গাড়িতে উঠে বেড়িয়ে গেছিলেন।

    প্রসঙ্গত, ২০২০ সালেই লকডাউনের সময় ‘অবহেলিত সুদীপ চ‍্যাটাজি’ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ‘ইনসাইড স্পোর্টস।’ পরে মোহনবাগানের ঘরের ছেলে সত‍্যজিৎ চ‍্যাটার্জি গিয়েছিলেন মন্ত্রী অরূপ রায়ের কাছে। সত‍্যজিৎ চ‍্যাটার্জির প্রস্তাব ছিল সুদীপ চ‍্যাটার্জির মূর্তি বসানো হোক। হাওড়ার এই মন্ত্রী কথাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই মূর্তি এখনও বসাতে পারেননি মন্ত্রী অরূপ রায়।

    এই ব‍্যাপারে সত‍্যজিৎ চ‍্যাটার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন,”আমরা বলেছিলাম হাওড়া ময়দান চত্বরে সুদীপ চ‍্যাটার্জির মূর্তি বসানো হোক। অরূপদা কথাও দিয়েছিলেন। দেরি তো হয়েছেই। মূর্তিটা বসলে খুশি হব।” ভারতের আর এক প্রাক্তন ফুটবলার বিকাশ পাঁজি জানান,”ভারতীয় ফুটবলে সুদীপ চ‍্যাটার্জি একটা বড় নাম। শুনেছিলাম মন্ত্রী অরূপ রায় সুদীপ চ‍্যাটার্জির মূর্তি বসাবেন। খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু এখনও মূর্তি দেখলাম না। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। কৃশানুর নামে রাস্তা হয়েছে। সুদীপ চ‍্যাটার্জির নামেও কিছু হোক।”

    প্রয়াত সুদীপ চ‍্যাটার্জির পুত্র সোহান চ‍্যাটার্জি চার বছর আগে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন সেটাই তুলে ধরছি – “এই ১৪ বছরে আপনারাই আবার বাবাকে তুলে এনেছেন। আজ আমার বন্ধুরা ফোন করে বলছে,’তোর বাবা এত বড় ফুটবলার ছিল, বলিসনি তো কখনও।’ আসলে বাবা চলে যাওয়ার পর মা আমাকে ও বোনকে সাধারণ ভাবে মানুষ করেছেন। বিখ‍্যাত বাবার ছেলে বা মেয়ে এই ধারণাটাই আনতে দেননি। বিশ্বাস করুন, বাবার মৃত্যুর পর এত প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলাম যার কোনওটাই কিছু হয়নি। মার্জনা করবেন, তাই আমরা আর কোনও কিছুই প্রত‍্যাশা করি না। যদি বাবার মূর্তি বসে তাহলে ভাল লাগবে। আর না বসলেও হতাশ হব না।”

    চার বছর পর বুধবার সেই সোহান ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে বলছিলেন,”বাবাই তো পৃথিবীতে নেই। আমাদের কারও প্রতি অভিযোগ নেই। মূর্তি না বসলেও, তিনি যে ভেবেছেন এটাই অনেক বড় ব‍্যাপার। উনি জনপ্রতিনিধি। দশটা কাজ নিয়ে ব‍্যস্ত থাকেন। তাই হয়তো এখনও মূর্তি বসানো যায়নি। এই নিয়ে আমাদের পরিবারে কোনও ক্ষোভ নেই। তবু বাবাকে, এখনও আপনারা মনে রেখেছেন এটাই আমাদের কাছে অনেক বড় পাওয়া।”

    সোহান অত‍্যন্ত ভদ্র ছেলে। কোনও বিতর্ক পছন্দ করেন না। ‘যান্ত্রিক’ সমাজে সবাই ব‍্যস্ত। এই ঘোর বাস্তবটা মেনে নিয়েছেন। তবে সুদীপ চ‍্যাটার্জি তাঁর বাবা। কাজেই সোহান ৩৬৫ দিন বাবাকে নিয়ে থাকেন, নিজের মতো করে। তার জ্বলন্ত উদাহরণ হল সোহানের হাতে চমৎকার ট‍্যাটু। “Youill never walk alone” – সঙ্গে বাবার মৃত‍্যুদিনের সাল তারিখ। বাবা কখনও একা নেই। তাঁরাও সঙ্গে আছেন। এই ভাবেই বাবাকে প্রতিটা দিন স্মরণ করেন সোহান।

    ভারতীয় ফুটবলের ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ সুদীপ চ‍্যাটার্জিকে আজ আর কেউ মনে রাখেনি। এটাই কি তাঁর প্রাপ‍্য ছিল? নতুন প্রজন্ম কৃশানু-বিকাশকে যতটা চেনে,জানে ততটা কি সুদীপকে জানে? হাওড়ার সহযাত্রী ক্লাবে শুরু। ভারতের প্রাক্তন ফুটবলার অরুণ ঘোষের নজরে পড়ে যায়। তাঁর হাত ধরে টুলু ওরফে সুদীপ সই করেন বিএনআরে (১৯৮১)। তাঁর দুরন্ত ফুটবল দেখে পরের বছরে মোহনবাগান তুলে নেয়। ১৯৮২,’৮৩ মোহনবাগানে খেলার পর সুদীপ ১৯৮৪ সালে সই করেন ইস্টবেঙ্গলে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সুদীপ তাঁর ফুটবল শুরু করেছিলেন সেন্ট্রাল ব‍্যাকে। মোহনবাগানে এসে হয়ে গেলেন রাইট ব‍্যাক। কিন্তু ‘৮৪ তে ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেওেয়ার পর তৎকালীন কোচ অমল দত্ত ব‍্যাবহার করলেন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে। কোনও সন্দেহ নেই, সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হওয়াটাই ছিল সুদীপের ফুটবল জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
    আটের দশক থেকে নয়ের দশকের শুরুটা একটা দুর্দান্ত বৃত্ত ছিল। কৃশানু-বিকাশ জুটির যুগ। আর এই জুটির মাথায় ছিলেন সুদীপ। সেই অর্থে ময়দানে একটা চমৎকার ত্রিভুজ ছিল। আর এই বৃত্তের, ত্রিভুজের অলিখিত নেতা ছিলেন সুদীপ।

    ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ এই ১১ বছর দুই প্রধান,বাংলা ও দেশের হয়ে দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। ভারতের হয়ে অধিনাকত্ব করেছেন, সাফ গেমস (১৯৮৫), প্রি-ওয়ার্ল্ড কাপ (১৯৮৬), এশিয়ান গেমস (১৯৮৬), মারডেকা কাপ (১৯৮৬), নেহেরু কাপ (১৯৮৫,১৯৮৮) এবং এশিয়া কাপ (১৯৮৮)। অবসর ১৯৯২ সালে। দু বছর পর কোচ হিসেবে অভিষেক ঘটে যুগশান্তি ক্লাবে। পরবর্তীকালে বাংলার কোচ হয়ে (১৯৯৫,’৯৬,’৯৭) সন্তোষ ট্রফিতে চ‍্যাম্পিয়ন করেছিলেন সুদীপ। সেই বছর মহমেডানেরও কোচ হয়েছিলেন।

    সুদীপ চ‍্যাটার্জি অনেক কিছুই পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। হাওড়ার এক প্রাক্তন ভারতীয় ফুটবলার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলছিলেন, “টুলু বরাবরই অবহেলিত। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির জন‍্যই ‘অর্জুন’ পায়নি টুলু।”
    নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতের সেই প্রাক্তন ফুটবলার ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে এক চাঞ্চল‍্যকর তথ‍্য দিলেন– “১৯৮৪ সাল। আমরা (টুলুও ছিল) ডুরান্ড কাপ খেলতে তখন দিল্লিতে। হঠাৎ একদিন প্রিয়দা এসে বললেন,’শোন,আমি এবার নির্বাচনে হাওড়ার টিকিট পাচ্ছি। তোরা কলকাতায় ফিরে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করিস। দরকার আছে। আমরা কলকাতায় ফিরলাম। কিন্তু দেখা করিনি। সেই সময় ডিসিএম খেলতে গেলাম। আমরা যেদিন ডিসিএম খেলে ফিরলাম, তার পরের পরের দিন ছিল নির্বাচনে নাম জমা করার শেষ দিন। আগের দিন টুলুসহ আমাদের তিন ফুটবলারের বাড়িতে এলেন হাওড়া ইউনিয়নের কর্তা শান্তিরায় চৌধুরী। তাঁর হাতে প্রিয়দার লেখা চিঠি। ডুমুরজলা থেকে হাওড়া ময়দান পযর্ন্ত একটা রাজনৈতিক র‍্যালি হবে। প্রিয়দা থাকবেন। আমাদের সেই র‍্যালিতে হাঁটতে হবে। আমরা সেই র‍্যালিতে যাইনি। তার জন‍্য প্রিয়দা আমার আর টুলুর সঙ্গে ১০ বছর কথা বলেননি। তার পর থেকেই টুলু প্রিয়দার কালো তালিকায় চলে গেল। আমার বিশ্বাস, সেদিন ওই র‍্যালিতে টুলু গেলে শুধু ‘অর্জুন’ কেন,আরও অনেক কিছুই পেত।”
    সুদীপের পরিবারের সদস‍্যদের সঙ্গে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তারা এই বিষয়ে ‘হ‍্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বলতে চাননি। সীমাদেবী ঘনিষ্ঠ মহলে একবার বলেছিলেন, “ও বলতো আমার কাজ হল ফুটবল খেলা। নেতা,মন্ত্রী মিছিলে হাঁটা তাঁর কাজ নয়।”

    সুদীপ চ‍্যাটার্জি বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৭ বছর। স্নায়ু রোগে ভুগছিলেন। ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৬ পেয়ারা খাওয়ার সময় গলায় আটকে যায়। আবার সেই সঙ্গে নাকি একটা স্টোকও হয়ে গিয়েছিল। মৃত‍্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন ভারতীয় ফুটবলের নক্ষত্র সুদীপ। জীবদ্দশায় কি পেয়েছেন তিনি? ফেডারেশনের বিচারে বর্ষসেরা (১৯৮৬) এবং প্লেয়ার অফ দ‍্য ডিকেড (১৯৯৬)। ব‍্যাস এটুকুই। আজ তাকে সবাই ভুলি গিয়েছে।
    আমরা, পেশার তাগিদে যাকে বা যে বিষয় নিয়ে লিখছি, পরের দিন ভুলে গিয়ে নতুন স্টোরির পিছনে দৌড়বো। নেতা মন্ত্রীরা বড় বড় ঘোষণা, প্রতিশ্রুতি দেবেন। আবার ভুলেও যাবেন। সব পিছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন। এই যান্ত্রিক সমাজে ‘উজ্জ্বল অতীত’ ঘাঁটার সময় আমাদের নেই। লজ্জা, কৃতজ্ঞতা,সৌজন‍্য ভুলে আমরা সবাই এখন সামনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। “উন্নয়ন”-এর দিকে।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here