◆সন্দীপ দে◆
২০১৯ সালের ১ এপ্রিল। রাত কেটে সবে মাত্র ভোর হয়েছে। কাকেরাও তখন বাসা ছাড়েনি। ময়দানের মেও রোড থেকে দুই মালির ভয়ঙ্কর আর্তনাদ,চিৎকার। ছুটে আসতে থাকেন টাউন ক্লাব,রাজস্তান ও প্রেস ক্লাবের মালি,কর্মীরা। তারা গিয়ে দেখলেন,দাউ দাউ করে জ্বলছে ১২৩ বছরের উয়াড়ী অ্যাথলেটিক ক্লাব। মালিদের চোখের সামনে পুড়ে খাক হয়ে গেল বাংলার ফুটবলের এক উজ্জ্বল ইতিহাস।
তারপর? কেটে গিয়েছে তিনটি বছর। পোড়া ক্লাব তাঁবুতেই আসতেন উয়াড়ীর কর্তারা। অর্থের কারণে পুড়ে তাঁবুর কাজ শুরু করা যায়নি প্রায় দেড় বছর। মন্ত্রী সুজিত বসু সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর উয়াড়ীর সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে অর্থ জুগিয়েছেন। দারুন ভাবে উদ্যোগ নিয়েছেন উয়াড়ীর সচিব প্রবীর চক্রবর্তী। অবশেষে নতুন করে তৈরি হল সবুজ-সাদা রংয়ের ঝকঝকে উয়াড়ী ক্লাব তাঁবু। আজ,১৫ এপ্রিল পয়লা বৈশাখে নতুন তাঁবুর শুভ উদ্বোধন হল ১২৩ বছরের ক্লাব উয়াড়ীর। নতুন করে ফের পথ চলা শুরু।
উয়াড়ী অ্যাথলেটিক ক্লাব আসলে বাংলাদেশের। পরবর্তীকালে পাখী সেন,পঙ্কজ গুপ্ত, দীণেশ দত্ত সহ বেশ কিছু কর্তারা কলকাতার ময়দানে উয়াড়ী ক্লাব শুরু করেছিলেন। তখন বাংলাদেশের উয়াড়ীর শাখা হিসেবেই কলকাতার উয়াড়ীর পথ চলা (১৮৯৮) শুরু হয়। ওই সময় ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে উয়াড়ীর নামে একটা গ্যালারিও ছিল। তারপর এই ক্লাবকে ঘিরে শুধুই ইতিহাস।
একটা সময় কলকাতা লিগে দাপটের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল,মোহনবাগান এবং মহামেডানকে হারিয়েছে উয়াড়ী। ১৯৪৭ সালের ২১ মে লিগে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়েছিল উয়াড়ী। সেই ম্যাচে আনন্দবাজার পত্রিকায় ম্যাচ রিপোর্টে লেখা হয়েছিল (একটা অংশ তুলে দেওয়া হল) — “উয়াড়ীর স্বপক্ষে বলা যেতে পারে,শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সহিত তাহারা কোনও সময়ই মনোবল হারায় নাই। প্রথম থেকে শেষ পযর্ন্ত অনমনীয় দৃঢ়তার সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়াছে।’
এই ক্লাব বাংলাকে অসংখ্য ফুটবলার উপহার দিয়েছে। এই ক্লাবে অবদান আছে বাঘা সোমেরও। উত্তম চক্রবর্তী, দিলীপ পালিত, সমরেশ চৌধুরী,তুষার রক্ষিত শুরু করে বাসুদেব মন্ডল থেকে আজকের কিংশুক প্রামানিক, প্রীতম কোটাল। কে নেই! একঝাঁক ফুটবলার উঠে এসেছেন।
সেই ক্লাব পুড়ে ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছিল। গত দুই বছরে কেউ ফিরেও তাকায় নি। কয়েকজন ছাড়া সেই ভাবে কাউকেই পাশে পায়নি। পাশেই যদি পেত তাহলে ভারতীয় ফুটবলের ঐতিহ্যবাহী উয়াড়ীকে মাথা তুলে দাঁড়াতে তিনটি বছর অপেক্ষা করতে হল কেন?
উয়াড়ী ক্লাবের ফুটবল সচিব ইন্দ্রনাথ পাল “ইনসাইড স্পোর্টস”কে বলছিলেন,”আমাদের পাশে কে দাঁড়ায়নি বা কে পাশে আছে সেই সব বিতর্কে যেতে চাই না। তিন বছর পর ক্লাবের তাঁবু নতুন করে তৈরি করা গিয়েছে এটাই বড় ব্যাপার। নতুন তাঁবু গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের বাবুদার (প্রবীর চক্রবর্তী) বিশেষ অবদান আছে। ক্লাবের প্রতিটা সদস্য নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী তাঁবু তৈরির কাজে এগিয়ে এসেছেন। তাঁবুতে আধুনিকতার ছোঁয়া আছে। ক্যান্টিন,মালিদের থাকার জায়গা এবং তাঁবু নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। তবে আমাদের পুরনো তাঁবু পুড়ে যাওয়ার সময় আমাদের ক্লাবে বহু দুস্প্রাপ্য ছবি ও নথি পুড়ে গিয়েছে। সেই গুলি আর পাবো না। এটাই দুঃখের।
এদিন সেনা আধিকারিকদের হাত দিয়ে নিজেদের নতুন তাঁবুর উদ্বোধন করেন উয়াড়ী কর্তারা। উপস্থিত ছিলেন ক্লাবের প্রাক্তন ফুটবলাররাও। ছিলেন আইএফএ-এর চেয়ারম্যান সুব্রত দত্ত,সচিব জয়দীপ মুখার্জি। উয়াড়ীর সচিব প্রবীর চক্রবর্তী বলেন,”তাঁবু পুড়ে যাওয়ার পর আমাদের সবার চোখের জল ফেলতে হয়েছিল। অনেকের প্রচেষ্টায় আবার তাঁবু তৈরি করা সম্ভব হল। আমরা নতুন করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।”