◆সন্দীপ দে◆
মামলার ফাঁসে সুব্রত-ভাস্কর-মনোরঞ্জনদের জেলায় ৪ বছর ফুটবল লিগ বন্ধ। এবার সেই জেলার ফুটবল লিগ চালু করতে উদ্যোগ নিয়েছেন সদ্য সাংসদ হওয়া পার্থ ভৌমিক। তিনি নাট্যকার,অভিনেতা, রাজনীতিবিদ হলেও খেলার প্রতি টান প্রবল। নৈহাটিতে স্টেডিয়াম গড়ে ফুটবলের মূল স্রোত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। এবার তাঁর জেলা ফুটবলের সোনালী অতীতকে ফিরিয়ে আনতে পার্থ ভৌমিকের প্রথম পদক্ষেপ হল বন্ধ থাকা ফুটবল আবার শুরু করা। শুধু চিন্তা, ভাবনা করাই নয়, মামলাকারীদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যার জট অনেকটাই খুলে ফেলেছেন পার্থবাবু। সূত্রের খবর, সুব্রত ভট্টাচার্যের একদা শ্যামনগরের যুগের প্রতীক ক্লাব কর্তাদের সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে। তারা মামলা তুলে নিতে রাজি হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। আবার আর এক মামলাকারী মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের পুরনো ক্লাব বেলঘরিয়ার নিমতা মিলন সমিতির কর্তাদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। বড় ধরনের অঘটন না ঘটলে তারাও মামলা তুলে নেওয়ার পথে। সব কিছু ঠিক থাকলে এই মরসুমেই উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় ফুটবল লিগ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
এই জেলায় একটা সময় ভারতীয় ফুটবলের সাপ্লাই লাইন ছিল। এই জেলা থেকে অলিম্পিক ফুটবলে অংশ নিয়েছিলেন মহাবীর প্রসাদ,কেষ্ট পাল। এই জেলা থেকে উঠে এসেছেন সমরেশ চৌধুরী,ভাস্কর গাঙ্গুলি,স্বপন সেনগুপ্ত, চিন্ময় চ্যাটার্জি,সুব্রত ভট্টাচার্য,মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য,মিহির বসু থেকে রঞ্জিত মুখার্জি, কবির বসু, অলোক দাস,দীপেন্দু বিশ্বাস,সংগ্রাম মুখার্জি,লালকমল ভৌমিকের মত কত কত ফুটবলার। তালিকাটা দীর্ঘ। মামলার ফাঁসে আটকে গিয়ে সেই জেলার ফুটবল লিগটাই হচ্ছে না। অভিযোগ,গত চার বছর ধরে উত্তর২৪ পরগনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্তাদের ইতিবাচক ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। বরং সেই সময়ের কমিটির কতিপয় কর্তা নিজেদের ভুল স্বীকার না করে সমস্যাটা বাড়িয়ে তুলেছেন বলে এমনটাই অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।
ঘটনার সূত্রপাত (২০১৯ সালে) ইছাপুর অনুশীলনী ও বেলঘরিয়ার নিমতা মিলন সমিতি ম্যাচকে কেন্দ্র করে। এই ম্যাচে নিমতার মিলন সমিতির ফুটবলার রাজু ভুঁইয়ার বৈধতা নিয়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থায় প্রতিবাদ করে ইছাপুর অনুশীলনী ক্লাব। তাদের প্রতিবাদ খতিয়ে দেখে লিগ সাব-কমিটি সিদ্ধান্ত জানায় যে, ফুটবলার রাজু বৈধ ফুটলার। এর পর ইছাপুর সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ওয়ার্কিং কমিটিতে যায়। এক মাস পর জেলা ক্রীড়া সংস্থার ওয়ার্কিং কমিটি ফুটবলার রাজু ভুঁইয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাসনে পাঠায়। এই সিদ্ধান্তর প্রতিবাদ করে এবার নিমতা মিলন সমিতি আরবিট্রেশনে যায়। আরবিট্রেটর নিয়োগ করা হয় স্থানীয় রবীন্দ্র কুমার দে-কে। এই আরবিট্রেটর ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তকে মান্যতা দেয়। কিন্তু মিলন সমিতি কর্তারা আরবিট্রেটরের নিয়োগ ও স্বচ্ছতাকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করেন। মিলন সমিতি যখন মামলা করে সেই সময় আবার শ্যামনগরের যুগের প্রতীক ক্লাব কর্তারা জেলা ক্রীড়া সংস্থার অন্য একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করে বসে। যুগের প্রতীকের মামলার কারণ হল,২০১৯ এর লিগ শেষ হল না। তাহলে তাদের দলের স্টেটাস কোন জায়গায় থাকল? পরের বছর প্রথম ডিভিশনে খেলবে নাকি সুপার ডিভিশনে খেলবে? সেই সিদ্ধান্ত না নিয়ে পরের বছরের জন্য ট্রান্সফার শুরু করে কোন নিয়মে? জেলা ক্রীড়া সংস্থার তৎকালীন কর্তারা ইতিবাচক উদ্যোগ নেয়নি বলে অভিযোগ। ফলে এই দুই মামলার ফাঁসে আটকে গিয়েছে জেলা ফুটবল লিগ।
২০২২ সালে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার তৎকালীন সচিব রতন সমাজদার সেই সময় এই প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন, একটা লিগ কাম নক-আউট টুর্নামেন্ট করবেন। যা জেলা ক্রীড়া সংস্থার স্বীকৃত টুর্নামেন্ট নয়। জেলার সব ক্লাবদের নিয়ে চারটি জোন ভাগ করে একটা লিগ কাম নক-আউট টুর্নামেন্ট শুরুও করেছিলেন। অন্তত ফুটবল খেলাটা শুরু হোক, এই লক্ষ্য নিয়ে এই টুর্নামেন্ট শুরুও হয়। পরের বছর রতন সমাজদারের মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালে এই জেলা ক্রীড়া সংস্থায় নতুন কমিটি হলেও নানান অভিযোগে সেই কমিটিও মান্যতা পায়নি। শুরু হয় গন্ডোগোল। ফলে সব মিলিয়ে থমকে আছে উত্তর চব্বিশ পরগনার ফুটবল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,জেলার এক কর্তা জানালেন, যুগের প্রতীক ও বেলঘরিয়ার নিমতা মিলন সমিতি যখন মামলা করে লিগ বন্ধ করে তখন জেলা ক্রীড়া সংস্থার ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট ছিলেন তৃণমূল বিধায়ক প্রয়াত কাজল সিনহা। অভিযোগ, কাজলবাবুই নাকি নিজের ঘনিষ্ঠ অঞ্জন দাশগুপ্তকে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সচিব পদে বসিয়েছিলেন। তিনি নাকি কোনও কাজ করেননি বলে অভিযোগ জেলার বিভিন্ন ক্লাবে।
এই জেলার শ্যামনগর থেকে উঠে এসেছেন সুব্রত ভট্টাচার্য। খেলা না হওয়ার জন্য প্রচন্ড বিরক্ত। এই বিষয়ে বেশ কিছুদিন আগে পার্ক স্ট্রিটের এক রেস্তোরাঁয় এই প্রতিবেদককে ‘অর্জুন’ সুব্রত ভট্টাচার্য বলছিলেন,”সংস্থা চালাতে হলে সমস্যা তো আসবেই। তাই বলে ফুটবলটাই বন্ধ হয়ে থাকবে? সমস্যা মেটাতে উদ্যোগী হতে হবে কর্তাদেরই। ভুলে গেলে চলবে না, খেলা আছে বলেই কর্তাদের চেয়ার আছে। আমি যখন মোহনবাগানে টপ ফর্মে খেলছি তখনও সপ্তাহে অন্তত দুটি জেলা লিগের ম্যাচ খেলেছি নিয়ম করে। শুধু আমি কেন,আমাদের সময় সবাই জেলা লিগ খেলত। ভাবতেই পারছি না যে,চার বছর ধরে লিগ হচ্ছে না।”