সন্দীপ দে ◆
আইএফএ সচিব হওয়ার পর (২০১৯ ৯জুলাই) এই সাংবাদিক, জয়দীপ মুখার্জিকে বলেছিল, কোটি কোটি টাকার দেনায় ডুবে আইএফএ। তোমার স্পনসর আনাটা যদি চ্যালেঞ্জের হয় তাহলে, সচিব হিসেবে তার থেকেও বড় চ্যালেঞ্জ হল, ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানকে সামলানো। বছরের পর বছর এই দুই প্রধান আইএফএ-এর উপর ছড়ি ঘুরিয়ে গিয়েছে। সেদিন হাসতে হাসতে জয়দীপ বলেছিলেন,”সন্দীপ, আমি সহজে মাথা নিচু করব না। ভবিষ্যতেই তার প্রমাণ পাবি। সময় কথা বলবে। মিলিয়ে নিস।” উল্লেখ্য, জয়দীপের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের দেবব্রত সরকারের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে এক বছর আগেই। অজিত ব্যানার্জির সঙ্গেও গত তিন মাস ধরে সম্পর্ক ভাল যাচ্ছিল না।
শনিবার দুপুরে যখন আইএফএ-এর সচিব পদ থেকে ইস্তফার কথা শুনলাম তখন ২০১৯ এর ৯ জুলাই জয়দীপের সেই মন্তব্যটাই মনে পড়ছিল বারবার।
জয়দীপ কি তাহলে হেরে গেলেন? নাকি কৌশলে মোক্ষম সময়ে পাল্টা চাপে ফেলে দিলেন মুখ্যমন্ত্রীর দাদা, আইএফএ সভাপতি অজিত ব্যানার্জিকে? নিজে কারও বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি চতুর জয়দীপ। বলেছেন,”স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছি না। আমার কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই….” অথচ কৌশলে ময়দানের বিভিন্ন জায়গায় অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে প্রচার করে দিয়েছেন যে, অজিত ব্যানার্জির জন্যই আইএফএ সচিব পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন। কাজেই আপাতত দৃষ্টিতে জয়দীপ হয়ে গেলেন মহান, যেন উপেক্ষিত বীর নায়ক। আর খলনায়ক বনে গেলেন অজিত ব্যানার্জি।
আসলে জয়দীপ আইএফএ সচিব হিসেবে ব্যক্তিত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে সরে দাঁড়ালেন। ব্যক্তিত্বহীনতার পরিণতিই হল এই পদত্যাগ। লজ্জার মাথা খেয়ে অজিত ব্যানার্জি দিনের পর দিন ইস্টবেঙ্গলের পক্ষেই কথা বলে গিয়েছেন। তিনি একদিকে ইস্টবেঙ্গলের কার্যসমিতির সদস্য। একই সঙ্গে আইএফএ-র সভাপতি। আইএফএ-এর সভাপতি হয়ে এখনও পযর্ন্ত এক টাকাও আনতে পারেননি (পড়ুন আনেননি)। অজিত পদলোভী। ময়দানের কারও জন্য তিনি কিছু করেছেন (শুধু এবার ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার -মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়া ছাড়া) এমনটা শোনা যায় না। বোন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বিওএ ও আইএফএ -এর সভাপতি পদে বসেছেন। এবার তাঁর ছোট ভাই স্বপন ব্যানার্জি বিওএ নির্বাচনে অজিত বাবুকে হারিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর দাদা হওয়ার জন্য ময়দানের বেশিরভাগ কর্তা, খেলোয়াড় অজিতের ছায়াকে যেন অনুসরণ করেন। এ হেন ক্ষমতাবান ব্যক্তির সামনে জয়দীপ লড়াইটাই করতে পারলেন না।
আইএফএ -এর সব ক্ষমতা সচিবের হাতে থাকে। তিনিই শেষ কথা। কন্যাশ্রী কাপের পুলিশ দলের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলের অবৈধ ফুটবলার খেলানোর ঘটনায় অজিত ইস্টবেঙ্গলের পক্ষ নিলেন বলে অভিযোগ। সেই কারণেই জয়দীপ সচিব পদ থেকে ইস্তফা দিলেন। সচিবের হাতে সমস্ত ক্ষমতা। যুক্তি দিয়ে অজিতের এই অন্যায়কে জয়দীপ আটকাতে পারলেন না কেন? তিনি সব দোষ অজিতের ঘাড়ে চাপিয়ে পদত্যাগ করে বোঝাতে চাইলেন, ‘আমি কত সৎ। আমি এই নোংরামির মধ্যে নেই’। এটা হয় নাকি? ইস্টবেঙ্গল-পুলিশ নিয়ে যা ঘটল তা তো আইএফএ-এর লজ্জা।এর দায় তো সচিবকেই নিতে হবে। অন্যায়কে সচিব আটকাতে পারলেন না কেন? সুবিধা পেয়ে গেল ইস্টবেঙ্গল। তিনি যদি অন্যায়কে আটকে পদত্যাগ করতেন তাহলে সত্যিকারের বাংলার ফুটবল প্রশাসনে নায়কের মর্যাদা পেতেন জয়দীপ। সামনে থেকে লড়াই না করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। অথচ আটকানোর যে লড়াই সেটা নেই। আরও হাস্যকর, জয়দীপ বলেছেন, সামনে আই লিগ। তাঁর উপর দায়িত্ব দিয়েছে ফেডারেশন। সেটা শেষ করেই আইএফএ ছাড়বেন। মানে কি? তিনি কি নিজেকে আইএফএ-র উর্ধ্বে ভাবছেন? তিনি না থাকলেও আইএফএ অন্য কর্তারা আই লিগ করতে পারবে না? সচিব পদ যদি ছাড়তেই হয় তাহলে আই লিগ দেখিয়ে চার মাস অপেক্ষা কেন? এখনই নয় কেন? কি অঙ্ক কষছেন তিনি? সব মিলিয়ে আইএফএ সচিব পদের যোগ্য মর্যাদা দিতে ব্যর্থ জয়দীপ। সবাই কি আর প্রদ্যোৎ দত্ত হয়? প্রদ্যোৎ দত্ত একটাই হয়।
সোসাল মিডিয়ায় জয়দীপ ঘনিষ্ঠদের আর্তি,”জয়দীপ আপনি ফিরে আসুন, বাংলার ফুটবলের স্বার্থে।” তরুণ সচিব। কাজ করার ইচ্ছে আছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৬ মাস হল আইএফএ সচিব পদে বসেছেন জয়দীপ। এখনও পযর্ন্ত তিনি সেভাবে আইএফএতে টাকা আনতে পারেননি। পাঁচ মাস আগে এই বিষয়ে ‘ইনসাইড স্পোর্টস’ – এ প্রথম বোমাটা ফাটিয়েছিলেন আইএফএ-র প্রাক্তন সহসচিব সুহাস বসু। তিনিই বলেছিলেন, “আইএফএতে যে টাকা আসছে সে তো বাপি দত্ত (সুব্রত দত্ত) আনছেন।” প্রচারে নেই অথচ আইএফএতে ‘লক্ষ্মী’ আনছেন বিশ্বনাথ দত্তর ছেলে, প্রদ্যোৎ দত্তর ভাইপো সুব্রত দত্ত। জয়দীপ সচিব হওয়ার পর সুব্রতবাবুর কি কি অবদান? খোঁজ নিয়ে তার একটা তালিকা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
এখনও পযর্ন্ত দুটি বড় স্পনসর আছে আইএফএ-এর। ১) ভিকি স্পোর্টস। তিন বছরের চুক্তি। প্রথম বছরে ৬০ লক্ষ টাকা। এই ভিকি স্পনসরকে এনেছেন আইএফএ চেয়ারম্যান ও এআইএফএফের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সুব্রত দত্ত।
২) অ্যাকর্ড। চার বছরে ১৪ কোটি টাকা দেবে এই মার্কেটিং সংস্থা। এই অ্যাকর্ডের মালিক নাকি জয়দীপের পূর্বপরিচিত। অথচ তাকে কাজেই লাগায়নি। প্যারালাল স্পোর্টসের কর্ণধার পার্থ আচার্য অ্যাকর্ডরে সঙ্গে কথা বলেন। পরে তাঁর সঙ্গে সুব্রত দত্তর সঙ্গে বসিয়ে ফাইনাল করিয়ে দেন এই পার্থ।
৩) আইএফএ-র কাছে মোটা টাকা পাওনা ছিল ফেডারেশনের। সেও টাকা সুব্রত দত্তর জন্যই মুকুব করে দিয়েছে এআইএফএফ।
৪) ফেডারেশনের কিছু টুর্নামেন্ট আইএফএকে পাইয়ে দিয়েছে এই সুব্রত দত্ত। ফলে ম্যাচ পরিচালনা করার জন্যও আইএফএ টাকা পেয়েছে। সবই সুব্রত দত্তর জন্য।
৫) আইএফএ-র সহসভাপতি হিসেবে ড:পার্থ সারথী গাঙ্গুলিকে এনে দিয়েছেন সুব্রত দত্ত। উল্লেখ্য, এই পার্থবাবু অত্যন্ত ভদ্র ও খেলা পাগল মানুষ। গত এক বছরে আইএফএ- পাশে থেকেছেন, থাকছেনও। শুধু তাই নয়, আইএফএ যে বাস কিনছে সেখানেও ড: পার্থ সারথী গাঙ্গুলির বড় ভূমিকা আছে।
তাহলে জয়দীপ কি কিছুই করেননি? অবশ্যই অ্যাসোসিয়েশনের মার্কেটিং করেছেন। তিনি আসলে মার্কেটিং জগতের ছেলে। মার্কেটটা ভাল বোঝে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মেট্রো স্টেশনে সংস্থার নাম, শহরের বিভিন্ন জায়গায় হোর্ডিংয়ে আইএফএ। এগুলো জয়দীপ করেছে। অফিসকে ঝাঁ চকচকে করেছেন। এমনকি মোহনবাগানের দেওয়া (২০২০ এর বড় বিস্ময় ) সেরা কর্তার পুরস্কার পাওয়াটাকেও বিভিন্ন ভাবে মার্কেটিং করা হয়েছে। প্রচারে, প্রসারের রাস্তা খোলে। অস্বীকার করা যায় না।
এখন প্রশ্ন হল, অজিত ব্যানার্জি কি করবেন? তাঁর সামনে তিনটি রাস্তা খোলা। ১) ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কার্যসমিতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। ২) আই এফ এ সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেওয়া। ৩) মাথা নিচু করে সভাপতি থাকা। কোন রাস্তা বাছবেন অজিতবাবু?
আর জয়দীপ মুখার্জি? চার মাস পর সচিব থেকে যাবেন? নাকি চলেই যাবেন। তাঁর শুভ্যানুধ্যায়ীদের আর্তি শুনে চার মাস পর নিজের কথা রাখতে পারবেন তো জয়দীপ? যদি সত্যি ফিরে না আসেন তাহলে আইএফএ-র ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে থাকবে। প্রতিবাদের মুখ হয়ে থাকবেন জয়দীপ মুখার্জি। কিন্তু ময়দানের যুক্তি, জটিল অঙ্ক অন্য কথা বলছে। আপনাকে আগাম এই উটকো সাংবাদিক জানিয়ে রাখছেন, “জয়দীপ, আপনি থাকছেন স্যার।”