◆সন্দীপ দে◆
প্রয়াত অঞ্জন মিত্রর ৭৬ তম জন্মদিন ঘিরে বাগান শিবিরে স্পষ্টতই “ওরা-আমরা” প্রকট হয়ে দাঁড়াল। মুখে অবশ্য কোনও পক্ষই পরস্পরকে বিঁধে কোনও মন্তব্য করেনি। একটা চরিত্রর অনুষ্ঠানকে ঘিরে দুই গোষ্ঠীর একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার “নীরব লড়াই” প্রকাশ্যে শুরু হয়ে গেল। মোহনবাগানের দুই শীর্ষ কর্তা দেবাশিষ দত্ত ও সৃঞ্জয় বসুর (যদিও সৃঞ্জয় কোনও পদে নেই) মধ্যে বিভাজন যে আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে তা প্রয়াত অঞ্জন মিত্রর জন্মদিন পালন অনুষ্ঠানই প্রমাণ দেয়। এই বিভাজন বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
বৃহস্পতিবার সকালে ময়দানের গোষ্ঠপাল মূর্তির পাদদেশে ঘটা করে পালন হল মোহনবাগানের প্রয়াত সচিব অঞ্জন মিত্রর জন্মদিন। এই অনুষ্ঠানের একদিন আগে থেকেই সোসাল মিডিয়ায় ঘুরছিল “অঞ্জনে অঞ্জলি।” স্থান ময়দানের গোষ্ঠপালের মুর্তির পাদদেশে। কিন্তু কারা অনুষ্ঠান করছেন তা ওই “অঞ্জনে অঞ্জলি”-এর কার্ডে উল্লেখ ছিল না। বৃহস্পতিবার দেখা গেল সুসজ্জিত প্রয়াত অঞ্জন মিত্রর ফটো ফ্রেমে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন মোহনবাগানের ঘরের ছেলে সুব্রত ভট্টাচার্য। ছিলেন এবছর ‘মোহনবাগান রত্ন’ গৌতম সরকার,অলোক মুখার্জি, প্রশান্ত ব্যানার্জির মতো প্রাক্তন ফুটবলাররা। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন আইএফএ সচিব অনির্বান দত্ত। ছিলেন মোহনবাগান ক্লাবের কয়েকটা ফ্যানস ক্লাবের সদস্যরাও। এই অনুষ্ঠানে হয়ে গেল একটি রক্তদান শিবিরও। আর গোটা অনুষ্ঠানে মধ্যমনি হয়েছিলেন (অনুষ্ঠান তদারকি করতেও তাঁকে দেখা গেল) মোহনবাগান ক্লাবের প্রাক্তন সচিব সৃঞ্জয় বসুকে। সঙ্গে ছিলেন সৃঞ্জয়ের ছায়া সঙ্গী সিদ্ধার্থ (পপ) রায় ও সঞ্জয় (বাপ্পা) ঘোষ। এই অনুষ্ঠানে ছিলেন মোহনবাগানের ফুটবল সচিব স্বপন ব্যানার্জিও।
সুব্রত ভট্টাচার্য টুটু বসু ও সৃঞ্জয়ের প্রশংসা করে বলছিলেন,”টুটু বসু আর অঞ্জন মিত্র এক সঙ্গে এসে ক্লাবের হাল ধরেছিলেন। শেষ পনেরো কুড়ি বছরে টুটুদা ও সৃঞ্জয় ক্লাবের জন্য যা করেছেন তা ভোলার নয়।”
প্রয়াত অঞ্জন মিত্রর জন্মদিনের এই সকালের এই অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কয়েক ঘন্টা পর মোহনবাগান ক্লাব তাঁবুতে অনুষ্ঠিত হল অঞ্জনের জন্মদিন। এই অনুষ্ঠানে শুরু থেকেই ছিলেন মোহনবাগান আর এক ঘরের ছেলে সত্যজিৎ চ্যাটার্জি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রয়াত অঞ্জনের প্রিয় ফুটবলার আই এম বিজয়ন। এই শিবিরেও ছিলেন স্বপন ব্যানার্জি, অঞ্জন কন্যা সোহিনী মিত্র,মানস ভট্টাচার্য এবং কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাবের সভাপতি সুভেন রাহা। আর ছিলেন তিনি, এই মুহূর্তে মোহনবাগানের সচিব দেবাশিস দত্ত। পূর্বঘোষণা মতোই বিজয়নকে দিয়ে অঞ্জন মিত্রর নামে মোহনবাগান প্রেস সেন্টারের নামকরণ হল। পরে একে একে অতিথিরা অঞ্জনের স্মৃতিচারণ করলেন।
প্রসঙ্গত, এই দুই অনুষ্ঠানের একটিতে গরহাজির ছিলেন দেবাশিস দত্ত ও সৃঞ্জয় বসু। অর্থাৎ গোষ্টপাল মূর্তির পাদদেশে সৃঞ্জয়ের অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি মোহনবাগান সচিব দেবাশিস দত্তকে। আবার বিকেলে মোহনবাগান ক্লাবের অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি সৃঞ্জয় বসুকে। বাগানের একদা “বীরু-জয়”-এর একে অপরের অনুষ্ঠানে না যাওয়া অন্যরকম ইঙ্গিত যে দিচ্ছে তা স্পষ্ট।
এই বিতর্ক যে উঠে আসবে জেনেই সৃঞ্জয় বসু সুকৌশলে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে ও পোর্টালে একটি বক্তব্য রেখেছেন,তা হল-“অঞ্জনদার জন্মদিন ক্লাব থেকে আমরা আগেই শুরু করেছিলাম। যখন বেঁচেছিলেন তখন দূর্গাপুরে করতাম। তারপরও করেছি। এখানে একটা ছাতার তলায় একাধিক ফ্যান ক্লাব যুক্ত হয়েছে। আগামী দিনে আরও ফ্যান ক্লাব আসতে পারে। আজকের এটা একটা ছোট চেষ্টা। কারও সঙ্গে তুলনা নেই।”
সৃঞ্জয়ের ঘনিষ্ঠ সঞ্জয় ঘোষ হঠাৎই বলেন,”২০১৮ সালে আমরা যা করেছি তা ঠিক করিনি। টুটুদা ও অঞ্জনদার সঙ্গে বিভেদ করিয়ে ঠিক কাজ করিনি। আজ তার খেসারত দিচ্ছি।” সৃঞ্জয় বসুর ইউটিউব চ্যানেলে সঞ্জয়ের এই মন্তব্য অবশ্যই যে তাৎপর্যপূর্ণ তা বলাই বাহুল্য। প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে মোহনবাগানের নির্বাচনের সময় ক্লাব তাঁবুর লনে বিশাল মঞ্চে প্রকাশ্যে কর্তাদের সেই কুখ্যাত ঝগড়া, ধাক্কাধাক্কি, প্রসূন ব্যানার্জির হাত থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নিচ্ছেন স্বপন ব্যানার্জি, অঞ্জন মিত্রর কান্না, অসুস্থ বাবার কান্না থামাচ্ছেন কন্যা সোহিনী – সেই সব দৃশ্য আজও ময়দান ভুলতে পারেনি। সেই সোহিনীও “ওরা-আমরা” লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন সচেতন ভাবেই। বৃহস্পতিবার অস্থায়ী মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাবা অঞ্জন মিত্রর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সোহিনী বলে উঠলেন,”২০১৯ সালে বাবা একদিন আমাকে একটা কথা বলেছিলেন,-‘মোহনবাগান ক্লাব যদি করিস, তাহলে দেবাশিসের সঙ্গেই থাকিস।’ বাবা হয়তো বুঝেছিলেন দেবাশিসদাই মোহনবাগান ক্লাবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।”
প্রশ্ন হল,প্রয়াত অঞ্জন মিত্র তো মোহনবাগানের। এক ছাতার তলায় অনুষ্ঠান হলে মোহনবাগান ক্লাবে না করে হঠাৎ গোষ্ঠ পালের মূর্তির পাদদেশে করা হল কেন? “আগামী দিনে আরও ফ্যান ক্লাব আসতে পারে” অথবা “এক ছাতার তলায়” বলতে সৃঞ্জয় বসু কি বোঝাতে চায়লেন? কেনই বা তাঁর অনুষ্ঠানে এলেন না দেবাশিস দত্ত? আর মোহনবাগান ক্লাবের অনুষ্ঠানেই বা কেন গেলেন না সৃঞ্জয়? তাহলে কি আগামী দিনে ক্লাব নির্বাচনের জন্য মঞ্চ তৈরি করছেন টুটু পুত্র টুম্পাই? তাই যদি হয়, তাহলে কি ধরে নিতে হবে ভবিষ্যতে মোহনবাগানে “কামব্যাক” করার ইঙ্গিত দিচ্ছেন বাগানের টুম্পাই? এমন বার্তা কি আগেই পেয়ে গিয়েছেন দেবাশিস দত্ত? আর এই বার্তা পেয়েছেন বলেই কি সোহিনী দেবাশিস দত্তর সঙ্গে থাকার বাবার নির্দেশ প্রকাশ্যে বললেন? এমন একাধিক প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়ে গিয়েছে।
ক্ষমতা পাওয়ার লড়াই এক নেশারর মতো। এই লড়াই যদি দুই বাল্য বন্ধুর (টুটু-অঞ্জন) বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারে তাহলে দেবাশিস- সৃঞ্জয়ের সম্পর্ক ভাঙাটা কিছুই নয়। এখন শুধু দেখার পালা।