◆সন্দীপ দে◆
২২ সেপ্টেম্বরঃ আগামী সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর ) শ্রীরামপুর সাব ডিভিশন ফুটবল লিগের সুপার ডিভিশনের দুই ম্যাচ ঘিরে স্থানীয় ক্রীড়া মহলে উত্তজনা তুঙ্গে। অভিযোগ শোনা যাচ্ছে এই দুটি ম্যাচের মধ্যে একটি ম্যাচ নাকি গড়াপেটা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এই গড়াপেটার অভিযোগের খবর পৌঁছে গিয়েছে কলকাতার গড়ের মাঠেও। এমনকি আইএফএতেও এই খবর এসে পৌঁছে গিয়েছে। গ্রুপ টু -এর এই দুটি ম্যাচের ফলাফলের উপর নির্ভর করছে কোন দলের অবনমন হবে। অথবা কোন দলটি অবনমন থেকে বেঁচে যাবে।
সোমবার একই সময় (দুপুর আড়াইটে) দুটি ম্যাচ। শ্রীরামপুরে মুখোমুখি হবে রিষড়া স্পোর্টিং ক্লাব ও রিষড়া অরোরা ক্লাব। আর বৈদ্যবাটির BSP@SA মাঠে মুখোমুখি হবে সৌরভ সংঘ ও শক্তি সংঘ। রিষড়া ও অরোরা – এই ক্লাব দুটির মধ্যে রেষারেষি মারাত্মক। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়ে না। আর এই দুটি ক্লাবে জড়িয়ে আছে ভারতের দুই প্রাক্তন বিখ্যাত ফুটবলার সুধীর কর্মকার ও শিশির ঘোষ। রিষড়া স্পোর্টিং ক্লাবের সচিব হলেন শিশির ঘোষ। আর অরোরার ক্লাব মানেই নাকি সুধীর কর্মকার। সেই অতীত কাল থেকেই এই দুটি ক্লাবের রেষারেষি চলে আসছে। অতএব এই ম্যাচে গড়াপেটা হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু সুধীর কর্মকারের অরোরা চায়ছে শিশির ঘোষদের রিষড়া স্পোর্টিংকে হারিয়ে অবনমনের গাড্ডায় ফেলতে। অতএব শিশির ঘোষদের ক্লাব যদি হেরে যায় আর অপর ম্যাচে সৌরভ সংঘর বিরুদ্ধে শক্তি সংঘ জিতে যায় তাহলে অবনমনে চলে যাবে শিশিরের রিষড়া ক্লাব।
সুপার ডিভিশনের অঙ্কটা হল এই রকম, গ্রপ ‘টু’-এর শেষ ম্যাচ। ৭ ম্যাচ খেলে শিশিরের রিষড়া স্পোর্টিংয়ের ৪ পয়েন্ট। আর ৭ ম্যাচ খেলে ৩ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে শক্তি সংঘ। যদি অরোরার কাছে রিষড়া হেরে যায় আর সৌরভ সংঘের বিরুদ্ধে শক্তি সংঘ জিতে যায় তাহলে অবনমন থেকে বেঁচে যাবে শক্তি সংঘ। আর অবনমনে চলে যাবে শিশিরের ক্লাব। স্বাভাবিক ভাবেই শ্রীরামপুর ফুটবল মহলে গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে যে, সৌরভ সংঘ, শক্তি সংঘকে ম্যাচ ছেড়ে দেবে। এমন অভিযোগ উঠছে। পাশাপাশি স্থানীয় ক্রীড়ামহলের একটা অংশ পাল্টা প্রশ্ন তুলেছে, শক্তি সংঘের বিরুদ্ধে জিততে পারলে সুপারের নক আউটে যাওয়ার সুযোগ থাকবে সৌরভ সংঘের। তাহলে কেন শক্তি সংঘকে পয়েন্ট ছাড়বে সৌরভ সংঘ? প্রসঙ্গত, সৌরভ সংঘ ৭ ম্যাচ খেলে ৯ পয়েন্ট। সমসংখ্যক ম্যাচ খেলে রিষড়া অরোরা ১২ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে। সোমবার যদি সৌরভ সংঘ ম্যাচ জিতে যায় তাহলে ১২ পয়েন্ট হবে। আর অপর ম্যাচে রিষড়ার কাছে অরোরা হারলে তারা ১২ পয়েন্টেই থাকবে। অর্থাৎ টাই হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে নক আউটে যাওয়ার জন্য অরোরা ও সৌরভ সংঘের মধ্যে ম্যাচ হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দুটি গ্রুপে ৯ টি করে ক্লাব নিয়ে মোট ১৮ টি দল নিয়ে শ্রীরামপুর সাব ডিভিশনের সুপার লিগ হয়। একেকটি গ্রুপ থেকে চারটি করে দল নকআউটে যাবে।
এখন প্রশ্ন হল, নক আউটে যাওয়ার সুযোগ যদি থাকে তাহলে শক্তি সংঘকে কেন সৌরভ সংঘ পয়েন্ট ছাড়বে? শ্রীরামপুর ফুটবল মহলে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে যে, বিপদের সময়ে “বন্ধু” শক্তি সংঘকে বাঁচাতে নাকি নিজেদের “স্বার্থত্যাগ” করতে পারে সৌরভ সংঘ। অর্থাৎ ম্যাচ ছাড়ার সম্ভবনা। ম্যাচ গড়াপেটা বিষয় নিয়ে সৌরভ সংঘের কর্তা বিভাস মুখার্জিকে ফোন করলে তিনি ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে শুরুতেই বলতে থাকেন,”আগে যে এত গড়াপেটা ম্যাচ হল, কই তখন তো আপনি ফোন করে জানতে চাননি। হঠাৎ সোমবারের ম্যাচ নিয়ে জানতে চাইছেন কেন? শুনুন ভাই, আমরা গড়াপেটা খেলি না। সোমবার ভাল খেলেও যদি হেরে যায় তাহলে তো আপনারাই বলবেন ম্যাচ ছেড়েছি। এগুলো ঠিক নয়।”
আপনি নিজেই স্বীকার করলেন শ্রীরামপুর সাবডিভিশন লিগে গড়াপেটা হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন তো উঠবেই। উত্তরে বিভাসবাবু তখন বলেন,” আপনি শ্রীরামপুর সাব ডিভিশন স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের জয়েন্ট সেক্রেটারি সন্তোষ সিংয়ের সঙ্গে কথা বলুন।” প্রসঙ্গত, এই বিভাস মুখার্জি আবার শ্রীরামপুর সাব ডিভিশনাল স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের সহসচিব।
পয়েন্ট পাওয়ার জন্য যাদের বিরুদ্ধে গড়াপেটার অভিযোগ উঠছে সেই শক্তি সংঘের সচিব সুহেল সরকার বলেন, “আমি এই ব্যাপারে কিছু জানি না। আপনি আমাদের ফুটবল সচিবের সঙ্গে কথা বলুন।” পরে শক্তি সংঘের ফুটবল সচিব জয়ন্ত ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, “কোথা থেকে এই সব খবর পান বলুন তো! আমাদের ছোট্ট লিগ। আমাদের বহু পুরনো ক্লাব। আমরা গড়াপেটা খেলি না।”
শ্রীরামপুর সাব ডিভিশন রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের সচিব বিপ্লব গোস্বামীকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন,”আমাদের রেফারিদের উপর কোনও চাপ বা অনুরোধ আসেনি। তবে সোমবার দুটি ম্যাচই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্ব বুঝেই আমাদের সেরা রেফারিদের দিয়েই ম্যাচ পরিচালনা করা হবে।”
শ্রীরামপুর সাব ডিভিশন লিগ নিয়ে খোঁজ করতে গিয়ে যে তথ্য উঠে আসছে তা ভয়ঙ্কর। এখানকার লিগে একাধিক গড়াপেটা ম্যাচ হয়েছে। যেমন, অভিযোগ উঠছে, ১২ সেপ্টেম্বর গ্রুপ – ওয়ানের চারটি ম্যাচ ছিল। মাহেশ ছাত্র সমাজ – নেতাজি ব্রিগেড, চলমান সমিতি – দ্য শ্যাওড়াফুলি ক্লাব, নবসমাজ – জগন্নাথ এবং ইউনাইটেড অ্যাথলেটিক – মিলন সংঘ। ওই দিন এই চারটি ম্যাচের মধ্যে তিনটি ম্যাচই নাকি গড়াপেটা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এক বছরের উপর হয়ে গেল শ্রীরামপুর সাব ডিভিশনাল স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের নতুন কমিটি হয়েছে। শোনা যায়, অতীতেও এমন গড়াপেটা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। জেলার ফুটবলকে শুদ্ধিকরণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন সংস্থার যুগ্ম সচিব পাপ্পু ওরফে সন্তোষ কুমার সিং। তিনিই নাকি শ্রীরামপুর সাব ডিভিশন স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের মুখ। সেই সন্তোষ কুমার সিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে বলছিলেন,”দেখুন দাদা,আমরা এই বছর মরসুম শুরুর আগেই ম্যাচ গড়াপেটা রুখতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ক্লাব কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। এরপরও যদি এমন চলতে থাকে তাহলে তো সংস্থাটাকেই তুলে দিতে হয়। আমরা চাই স্বচ্ছ ভাবে ফুটবল হোক। আমরা কমিটিতে প্রখ্যাত ফুটবলার শিশির ঘোষকে নিয়েছি। শিশিরদাও স্বচ্ছ ফুটবল ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট। তবে আপনাকে জানিয়ে রাখি, সোমবারের দুটি ম্যাচে অবজার্ভার রাখা হবে। আমি নিজেও মাঠে থাকব।”
রিষড়া স্পোর্টিং ক্লাবের সচিব ও ভারতের প্রাক্তন স্ট্রাইকার শিশির ঘোষ বলেন,”তুমি খুব ভাল করে জানো, আমার খেলোয়াড় জীবনে গড়াপেটাকে গুরুত্ব দিইনি। এখন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও একই অবস্থান আমার। আমার দল, হারা জেতার থেকেও বড় হল ফুটবলকে সুস্থ রাখা। স্বচ্ছতা না রাখতে পারলে ফুটবল থেকে নতুন প্রজন্মরা মুখ ফিরিয়ে নেবে। ফুটবলকে বাঁচাতে হলে আমাদের স্বচ্ছতা আনতেই হবে।”
কলকাতা ফুটবল লিগে গড়াপেটা ও ম্যাচ ফিক্সিং রুখতে বিশেষ নজর দিচ্ছেন আইএফএ সচিব অনির্বান দত্ত এবং সভাপতি অজিত ব্যানার্জি। শ্রীরামপুর সাব ডিভিশন ফুটবলে গড়াপেটার খবর আইএফএ সচিব অনির্বান দত্তর কাছেও পৌঁছে গিয়েছে। এই বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চায়লে ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে অনির্বান দত্ত বলেন,”এই গড়াপেটা,ম্যাচ ফিক্সিং সমাজে একটা বড় রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যারা ফুটবলকে ভালবাসে সংগঠন করি,ক্লাব চালাই তাদের এক কাট্টা হয়ে এই রোগকে প্রতিরোধ করতেই হবে। না হলে ফুটবল শেষ হয়ে যাবে। ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।”