শিলিগুড়ির টেবল টেনিস নিয়ে চিন্তিত উপেক্ষিত ‘দ্রোণাচার্য’ ভারতী ঘোষ

0

◆সন্দীপ দে◆

শিলিগুড়ি শহরের টিকিয়াপাড়া মোড় থেকে দুই মিনিটের রাস্তা-দেশবন্ধু স্পোর্টিং ইউনিয়ন ক্লাব। তার সামনেই ছোট্ট আবাসন। গ্রাউন্ড ফ্লোর। দশ বাই দশ ফুটের এক কামরা ফ্ল‍্যাট। দরজা খোলা। উঁকি মারতেই দেখা গেল ৭৭ বছরের বৃদ্ধা শুয়ে আছেন। তাঁকে ডাক দিতেই শুয়ে শুয়েই বলে উঠলেন,”কে টিটি খেলবে? তাকে নিয়ে এসেছো? এসো বাবা। ঘরে এসো।”
তার সঙ্গে এই সাংবাদিকের সাক্ষাৎ হয়েছিল গত বছরের ডিসেম্বর মাসে। কেমন আছেন তিনি? আজ,রবিবার কলকাতা থেকে খোঁজ নিতেই তাঁকে ফোন করেছিলাম।

শীর্ণকায় ওই বৃদ্ধা হলেন ভারতী ঘোষ। যার হাত ধরে টেবল টেনিস খেলা শিখেছেন প্রায় দেড় হাজার ছেলে-মেয়ে। তাঁর হাতে গড়া শ‍্যামল দাস, সঞ্জয় দে, প্রসূন অধিকারী, গনেশ কুন্ডুর সফল আত্মপ্রকাশই শিলিগুড়ি টেবল টেনিসে নবজাগরণ ঘটেছিল। উপহার দিয়েছেন ঝাঁকে ঝাঁকে কৃতী খেলোয়াড়। তাঁরই প্রডাক্ট দেশের হয়ে খেলেছেন মাথা উঁচু করে।

শিলিগুড়ি মানেই আমরা জানি টেবল টেনিসের শহর। সেটা তৈরিই হয়েছে ভারতী ঘোষের জন‍্য। শিলিগুড়ির সেই গর্বের টেবল টেনিস এখন পিছনের দিকে। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ক্রিকেট। তার বড় কারণ হল ঋদ্ধিমান সাহা ও রিচা ঘোষের উত্থান। শিলিগুড়িতে বাঙালির সংখ‍্যা কমছে। অবাঙালিদের ভিড়। ‘পান পরাগ’-এর সংস্কৃতি। তারাই আজ ঋদ্ধি, রিচা হওয়ার লড়াইয়ে সামিল হয়েছে। তাই শিলিগুড়ির পাড়াই পাড়াই গজিয়ে উঠেছে ক্রিকেট কোচিং ক‍্যাম্প নামক ব‍্যবসার নতুন ফাঁদ। এই শহরের ফুটবল, টেবল টেনিস থেকেও যেন নেই।

ভারতী ঘোষ চেয়েছিলেন, বাংলার টেবল টেনিসের স্বার্থে বড় মাপের একটি অ‍্যাকাডেমি। তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়নি। গণেশ কুন্ডু থেকে মান্তু ঘোষ সহ এক ঝাঁক খেলোয়াড় তুলে এনেছেন। বাংলার টেবল টেনিসের কর্তাদের,ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াই বহু বছরের অভ‍্যাস। বহু বছর ধরে বাংলার টিটি ভাগ হয়েছিল। সাধারণ ক্রীড়াপ্রেমিরা বিরক্ত। একটা সময় সংবদ্ধভাবে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে আহবান করেছিলেন ভারতী দেবী। কাজ হয়নি। “ওরা-আমরা”-র লড়াই ছিলই। এখনও আছে।
“এই খেলা নিয়ে কর্তাদের এত দলাদলি ভাল লাগে না। এখন তো এক হয়েছে। কিন্তু কতটা ইতিবাচক, জানিনা। দেখো সন্দীপ, আমি এখনও বাচ্চাদের নিয়ে অনুশীলন করাই। এটা আমার নেশা। যতদিন শরীর চলবে ততদিন বাচ্চাদের নিয়েই থাকবো। তবে কি জানো, আগের মতো ছেলে-মেয়েরা টিটি খেলতে আসে না। আর ট‍্যালেন্টও চোখে পড়ছে না। এই ভাবে চললে শিলিগুড়ির টেবল টেনিস শেষ হয়ে যাবে।” ইনসাইড স্পোর্টসে কথাগুলি বলছিলেন ভারতী দেবী।

একটা সময় দেশবন্ধু স্পোর্টিং ইউনিয়ন ক্লাব থেকেই শিলিগুড়িতে টেবল টেনিসের জোয়ার এনেছিলেন তিনি। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে প্রতিভা তুলে আনতেন। তাঁর নামের পরে পেশাদারি কোচিংয়ের কোনও তকমা নেই। তাঁরই ছাত্রী শিলিগুড়িতে কোচিং ক‍্যাম্প করে দিব্বি ব‍্যবসা করছেন বলে অভিযোগ। অথচ ভারতী দেবী খেলা শিখিয়ে কোনও টাকা নেন না। “কাদের কাছ থেকে টাকা নেব? কারও বাবা নেই। কারও বাবা রিকশা চালায়। কারও মা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করে। এই সব পরিবারের ছেলেরা খেলতে আসছে এটাই অনেক। টাকা নেওয়া যায়? তুমি আমাকে নিয়ে লিখছো কেন? তোমাকে অনুরোধ করবো, যে সমস্ত প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েরা খেলছে, তাদের নিয়ে লেখো। ওরা অবহেলিত। ওদের কেউ দেখে না। পলি সাহা, সোমা কুন্ডু, সুরভী ঘোষরা ডেফ অলিম্পিক, এশিয়ান গেমস ও সাফ গেমসে পদক নিয়ে এসেছে। আশা রায়, মিঠু চাকিরা কেমন আছে কেউ খোঁজ নেয়না। আগের মতোই আমি এখনও প্রতিবন্ধীদের খেলা শেখায়। আমি ওদের অবস্থা জানি। ওদের তুলে ধরো। ওদের সবাই করুনার চোখে দেখে। তাই গুরুত্ব পায় না।” বলছিলেন ভারতী দেবী।

বর্তমান টেবল টেনিস নিয়ে তিনি বিরক্ত। কথায় কথায় বোঝা যায়। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে মুখ খোলেন না। বাংলার টেবল টেনিসকে তিনি দুহাত ভরে দিয়েছেন। পেয়েছেন কি? উপেক্ষা। যোগ‍্য সম্মান পাননি। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় শিলিগুড়ির এক অনুষ্ঠানে ভারতী দেবীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন ‘বঙ্গরত্ন’। সঙ্গে এক লক্ষ টাকার চেক। অনেকেই তাঁকে আর মনে রাখেনি। তবে তার জন‍্য তাঁর কোনও দূঃখ নেই। উপেক্ষা, বঞ্চনা – এই শব্দগুলিকে পাত্তাই দিতে চান না।

‘খেলার আসর’ ও ইংরেজি দৈনিকের এক সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক এই প্রতিবেদককে বলছিলেন,”বাবলিদি (ভারতী ঘোষের ডাক নাম) প্রাপ‍্য সম্মান পাননি। একটা ঘটনা বলি, সম্ভবত ১৯৯৪ সাল। কলকাতার নেতাজি ইন্ডোরে ন‍্যাশনালে চ‍্যাম্পিয়ন হল মান্তু ঘোষ। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, খেতাবটা কাকে উৎসর্গ করছিস? মান্তু বললো, ‘গোপীনাথ জেঠুকে। গোপী জেঠু আমাকে বাড়িতে থাকতে দিয়েছে। আনেক উপকার করেছেন।’
আমি সেদিন মান্তুকে বলেছিলাম, যার হাত ধরে খেলা শিখলি। সেই মানুষটা তো অপেক্ষা করে আছে তোর আজকের সাফল‍্যটা দেখবে বলে। গোপীদা ভাল। কিন্তু ভারতী ঘোষকে উৎসর্গ করবি না। মান্তু অবশ‍্য সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত বদল করে বাবলিদিকেই উৎসর্গ করেছিল। খারাপ লাগে, বলে দিতে হয়, মনে করিয়ে দিতে হয়।”

মফস্বল শহর শিলিগুড়ির মেয়ে ভারতী দেবীর জন্ম ১৯৪৩ সালে। এখন বয়স ৭৭ বছর। লেখাপড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক। নিউ জলপাইগুড়িতে রেলের ডিএমই অফিসে চাকরি করতেন। অবসর নিয়েছেন ১৭ বছর আগে। বিয়ে করেননি। ১৯৭১ সালে দেশবন্ধু স্পোর্টিং ইউনিয়নে শুরু করেন টেবল টেনিস ক‍্যাম্প। প্রথমে ছিলেন তিনি খেলোয়াড় পরে কোচ। কোনও ডিগ্রি নেই। নিজের সঞ্চিত অর্থ খরচ করে প্রতিভা তুলে এনেছেন। এখনও কোচিং করান। ৫০ বছর ধরে কোচিং করাচ্ছেন। তাঁর মূল‍্যায়ন কি হবে? শুনে ভারতী দেবী বলে উঠলেন,”ছাড়ো না অসব কথা। তুমি তো কলকাতায় থাকো। গোপীদা, রবিদারা কেমন আছে বলতে পারবে? ওদের সময় একটা সময় খুব ঝগড়া করতাম। অনেক ঝগড়া করে দাবি আদায় করেছি। ঝগড়া হলেও ওরা আমাকে খুব ভাল বাসতো।”

এই বৃদ্ধার সঙ্গে কি ইন্টারভিউ করব? ভেবেছিলাম বিস্ফোরক ভারতী দেবীকে পাবো। কিন্তু তিনি আগের মতোই আছেন। মায়ের মমতায় যেমন সব খেলোয়াড়দে আগলে রাখেন, তেমনি এত বঞ্চনা, অবহেলার পরও তিনি বিতর্ক থেকে কয়েক হাজার মাইল দুরে। ভেতরে যত যন্ত্রণা থাকুক না কেন, তিনি উপেক্ষিত ‘দ্রোণাচার্য’ হয়েই থেকে যেতে চান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here