◆সন্দীপ দে◆
তখন অবিভক্ত দিনাজপুরের রায়গঞ্জ শহরের জনপ্রিয় ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে সেই শহরের ফুটবল উন্মাদনা নিজের চোখে দেখেছিলেন প্রখ্যাত ফুটবলার সামাদ সাহেব। কলকাতা শহরের অনেক প্রতিষ্ঠিত ফুটবলার খেলে এসেছেন রায়গঞ্জের এই ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্টে। এবার সেই ৯০ বছরের প্রাচীন “কুলদাকান্ত শিল্ডে” অংশ নিতে রায়গঞ্জ যাচ্ছে ইমামি ইস্টবেঙ্গল। মূলত সদ্য সমাপ্ত কলকাতা লিগে যে দলটি অংশ নিয়েছিল ইস্টবেঙ্গলের সেই দলটাই “কুলদাকান্ত শিল্ড” খেলতে মাঠে নামবেন লাল-হলুদ ব্রিগেড বাহিনী।
সাম্প্রতিক কালে এই শিল্ডে খেলে এসেছে ইউনাইটেড স্পোর্টস, খিদিরপুর স্পোর্টিং, জর্জটেলিগ্রাফের মতো দল। এবার এই “কুলদাকান্ত শিল্ড”-এ ইস্টবেঙ্গল ছাড়াও অংশ নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বেঙ্গল ফুটবল অ্যাকাডেমি,কলকাতার শতাব্দী প্রাচীন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং এবং ওয়েষ্ট বেঙ্গল পুলিশ স্পোর্টস ক্লাব। টুর্নামেন্ট শুরু ১৬ ডিসেম্বর। ফাইনাল ২৩ ডিসেম্বর। আট দলীয় ইস্টবেঙ্গলের প্রথম ম্যাচ ২১ ডিসেম্বর। শিল্ডের খেলা গুলি হবে রায়গঞ্জের ‘জুবিলি ময়দান’ অর্থাৎ টাউন ক্লাবের মাঠে।
রায়গঞ্জ মানেই যেন বিখ্যাত তুলাই পাঞ্জি চাল আর বিঘোরের বেগুন পোড়া রুটি। উত্তর দিনাজপুরের এই রায়গঞ্জে যারা (খাদ্য রসিক) পৌঁছন তাঁরা এই তুলাই পাঞ্জির চালের ভাত আর বিঘোরের বেগুন পোড়া রুটি না খেয়ে ফেরেন না। রায়গঞ্জের এই দুই বিখ্যাত ‘বিশেষ খাদ্য’-র সঙ্গে খেলাধূলার জগতে বিখ্যাত হল “কুলদাকান্ত শিল্ড।” দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে শুরু হয়েছিল এই টুর্নামেন্ট। দেখতে দেখতে ৯০ বছরে পা রেখেছে।
উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে খেলাধূলার চর্চা মূলত শুরুই হয়েছিল করোনেশন স্কুলের জন্যই। জানা যায়, স্বাধীনতার আগে করোনেশন স্কুলের শারীর শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক অরুণ চন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে সংগঠিতভাবে বিভিন্ন খেলার চর্চা শুরু হয়। আরও জানা যায়, একশো বছর আগে রায়গঞ্জের শ্মশান সংলগ্ন মাঠে ফুটবল খেলা শুরু হয়। পরবর্তীকালে একটা সময় প্রখ্যাত ফুটবলার সামাদ সাহেবও এই মাঠে ফুটবল খেলে গিয়েছেন। সেই সময় এই মাঠেই হত রায়গঞ্জের আর এক বিখ্যাত “সাহা ব্রাদার্স শিল্ড।” পরে যদিও তা বন্ধ হয়ে যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,এই রায়গঞ্জ শহরে কৈশরের বেশ কয়েকটা বছর কাটিয়ে গিয়েছেন প্রাক্তন ফুটবলার প্রয়াত সুভাষ ভৌমিক। এখনও তাঁর আত্মীয় পরিজনেরা থাকেন রায়গঞ্জে।
করোনেশন স্কুলের পর এই ছোট্ট শহরের খেলাধূলার পরিচালনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে রায়গঞ্জ টাউন ক্লাব। এই ক্লাবটির প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২৮ সালে। পরবর্তীকালে ১৯৩৯ সালে কয়েকটি সংগঠন মিলে তৈরি হয় রায়গঞ্জ ইনস্টিটিউট। পরে এই রায়গঞ্জ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত হয় টাউন ক্লাব।
১৯৩২-‘৩৩ সাল নাগাদ শুরু হয় কুলদাকান্ত শিল্ড। ১৯৩৯ সালের আগে পযর্ন্ত এই কুলদাকান্ত শিল্ড পরিচালনা করত করোনেশন স্কুল। তখন এক মাস ধরে এই টুর্নামেন্ট হত। টাউন ক্লাবের সচিব অরিজিৎ ঘোষ প্রাক্তন ফুটবলার। তিনি ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে বলছিলেন,” আমরা সাতের দশকে এই টুর্নামেন্টের জনপ্রিয়তা দেখেছি। উৎসব চলত। মাঝখানে নানান সমস্যার জন্য টুর্নামেন্টটি বন্ধ ছিল। ২০১৪ সাল থেকে আবার শুরু করতে পেরেছি। হয়তো সেই সাতের দশকের মতো বড় করে পরিচালনা করতে পারি না। তবে যেভাবে করা হয় তাতে মাঠে প্রত্যেকদিন প্রচুর মানুষের ভিড় হয়। ভবিষ্যতে টুর্নামেন্টের পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আনার আমরাচেষ্টা করছি। তার জন্য সবার সহযোগিতা চাই। এই বছর ইমামি ইস্টবেঙ্গল দল শিল্ডে অংশ নিচ্ছে। শুধু রায়গঞ্জ নয় গোটা উত্তর দিনাজপুর জেলার ফুটবল উন্মাদনা আরও বেড়ে যাবে।”
প্রসঙ্গত, এই শিল্ডে অংশগ্রহণকারী দলের ফুটবলারদের ‘রায়গঞ্জ ইনস্টিটিউট’-এর কিশলয় স্কুলে বসিয়ে খাওয়ানোর রেওয়াজ আছে। আগে কিশলয় স্কুল ছিল চালের ঘর। এখন বড় পাকা দালান। অতীতের মতো এখনও ফুটবলারদের বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে তুলাইপাঞ্জি চাল আর বিঘোরের বেগুনের রেসিপি থাকবেই। এটা তাঁদের একটি রীতি। সঙ্গে চমৎকার আতিথেয়তা তো আছেই।
রায়গঞ্জ ইনস্টিটিউটের সচিব আদিত্য নারায়ণ দাস বলছিলেন,” আমাদের এই রায়গঞ্জ ইনস্টিটিউট হল সোসাল অর্গানাইজেশন। এই সংস্থার একটা পার্ট হল রায়গঞ্জ টাউন ক্লাব। কুলদাকান্ত শিল্ডকে আমরা কে কে শিল্ড বলে থাকি। এই শিল্ড আমাদের জেলার কাছে আবেগের,গর্বের। ৯০ বছর হয়ে গেল। বড়দের মুখে শুনেছি,অতীতে নাকি মোহনবাগান,মহমেডান,ভ্রাতৃ সংঘ খেলে গিয়েছে। আমাদের জেলার ক্রীড়াপ্রেমিরা প্রতি বছরে এই কুলদাকান্ত শিল্ডের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। এবার ইমামি ইস্টবেঙ্গল আসছে। উন্মাদনা বহুগুন বেড়ে যাবে।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই জেলার ফুটবল প্রতিভা তুলে আনার জন্য একটা ফুটবল অ্যাকাডেমি গড়ে তুলেছেন টাউন ক্লাবের কর্তারা। গত দুই বছর ধরে এই অ্যাকাডেমির চিফ কোচ হিসেবে যুক্ত আছেন ভারতের প্রাক্তন ফুটবলার ও ‘অর্জুন’ পুরস্কারপ্রাপ্ত দীপক মন্ডল। দীপক জানান,”এই রায়গঞ্জে ফুটবলের উন্মাদনা আছে। আছে অনেক ফুটবল প্রতিভাও। সব থেকে ভাল লেগেছে রায়গঞ্জ টাউন ক্লাবের নিজস্ব মাঠ,জিম,ফুটবলারদের থাকার জায়গা আছে। খুব ভাল পরিবেশ। এবার কুলদাকান্ত শিল্ড জমে যাবে।”