ইনসাইড স্পোর্টসের প্রতিবেদন,১ নভেম্ববর,কলকাতা : ওঁরা বলেন জর্জ। ময়দান, জর্জের সঙ্গে আরও একটা কথা বলে – ময়দানের “দত্ত পরিবার”। কেউ বলে গোটা ময়দান “দত্ত পরিবারে”-র কন্ট্রোলে। আবার কেই বলে “দত্ত পরিবার”-কে ভালবেসেই জর্জে ছুটে আসে ময়দানের মানুষ। সেই ভালবাসা থেকেই পুজোর পর ময়দানের সকল ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের নিয়ে বিজয়া সম্মিলনী শুরু করেছিলেন বিশ্বনাথ দত্ত, প্রদ্যোৎ দত্তরা। সেই রীতি এখনও মেনে চলেছেন সুব্রত দত্ত,অনির্বান দত্ত,অধিরাজ দত্তরা। প্রতি বছরের মতো এবারও রবিবার সন্ধ্যায় নিজেদের ৯৬ বছরের জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাব তাঁবুতে হয়ে গেল “দত্ত পরিবারে”এর বিজয়া সম্মিলনী।
আলোর রোশনায় জর্জ সেজে উঠেছিল নব বধূর সাজে। ছোট থেকে বড় ক্লাবের সব কর্তা,কোচ, ফুটবলার জর্জ তাঁবুতে হাজির হন এই বিজয়া সম্মিলনীতে। এ যেন কলকাতা ময়দানের ক্রীড়া জগতের মিলন মেলা।
কবে থেকে এই বিজয়া সম্মিলনী হচ্ছে? জর্জের সর্বময় কর্তা ও বিশ্বনাথ দত্তর পুত্র সুব্রত দত্ত বলছিলেন,”আমি তখন সদ্য মাঠ করা শুরু করেছি। তখন থেকেই এই বিজয়া সম্মিলনী শুরু হয়েছে। এখনও সেটা ধরে রেখেছি। শুধু গত বছর করোনার জন্য এই অনুষ্ঠান করতে পারিনি। ময়দানের সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই অনুষ্ঠানে আসেন। এটা শুধু জর্জের অনুষ্ঠান নয়। গোটা ময়দানের সকল ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের অনুষ্ঠান। কিছু ভাল মুহূর্ত আমরা কাটাই।”
সত্যি বলতে এই অনুষ্ঠানেই একে অপরের সঙ্গে দেখা হয়। সৌরভ গাঙ্গুলির কাকা ও সিএবির ট্রেসারার দেবাশিস গাঙ্গুলি ও যুগ্ম সচিব দেবব্রত দাসকে সঙ্গে নিয়ে বিজয়া করতে জর্জে হাজির অভিষেক ডালমিয়া। প্রায় ঘন্টা খানেক সময় কাটিয়ে গেলেন সিএবি সভাপতি অভিষেক।
সাইয়ের মাঠে ন্যাশনাল হকির ফাইনাল ম্যাচ শেষ হতেই সরাসরি জর্জে পৌঁছে গিয়েজিলেন বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি স্বপন ব্যানার্জি। তিনি বলছিলেন,”জর্জের এই বিজয়া সম্মিলনী খুব ভাল লাগে। সবার সঙ্গে দেখা হয়।”
অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও ছুটে এসেছেন মন্ত্রী সুজিত বসু। তিনিও রবিবাসরীয় সন্ধ্যায় জর্জে কাটিয়ে গেলেন বেশ কিছুক্ষন সময়। জর্জের উঠোনে যাওয়ার আগে ঘরে গিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিলেন সুজিত বসু।
হাওড়া,দুই ২৪ পরগনা জেলার ক্লাব প্রতিনিধিরাও হাজির ছিলেন এই বিজয়া সম্মিলনীতে। এসেছিলেন সিএবির প্রাক্তন যুগ্ম সচিব সুবীর (বাবলু) গাঙ্গুলি। ছিলেন মহমেডান ক্লাবের কর্তাদের। রাত ন’টার দিকে জর্জে এসে ঘুরে যান ইস্টবেঙ্গলের কর্তা দেবব্রত সরকার।
শুরু থেকেই হাজির ছিলেন আইএফএ সচিব জয়দীপ মুখার্জি। তবে তিনি ক্লাব ঘরে বসেই কাটালেন। জর্জের বর্তমান কোচ যিনি এখন বাংলা দলের কোচ রঞ্জন ভট্টাচার্য অনুষ্ঠান শুরুর আগে এসেই বাড়ি চলে যান। তবে জর্জের প্রাক্তন কোচ রঘু নন্দী অসুস্থ শরীর নিয়েও এসেছিলেন।
জর্জ টেলিগ্রাফ মানেই ইতিহাস। কত বড় মাপের ফুটবলার খেলে গিয়েছেন এই জর্জ টেলিগ্রাফ ক্লাবে। ছয়ের দশকে জর্জ টেলিগ্রাফে ভারত বিখ্যাত চার গোলকিপার খেলেছেন। এঁরা হলেন, মনিলাল ঘটক, সনৎ শেঠ, স্বরাজ চ্যাটার্জি এবং অবনী বসু। তারও আগে জর্জে খেলেছেন শাহু মেওয়ালাল, রুনু গুহঠাকুরতা, মানিক গোস্বামী (চুনী গোস্বামীর দাদা), সেলিম, চন্দন ব্যানার্জি থেকে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য্য, অলোক মুখার্জি, সত্যজিৎ চ্যাটার্জি, সঞ্জয় মাঝি, ষষ্ঠী দুলে, সেখ আজিম, সফর সর্দার, বিশ্বজিৎ সাহা, শুভ কুমার সহ কত কত ফুটবলার। কেরিয়ারের শেষের দিকে সুরজিৎ সেনগুপ্ত জর্জে খেলেছিলেন। এই জর্জ টেলিগ্রাফ ক্লাবে জীবনে প্রথম কোচিং শুরু করেছিলেন সুভাষ ভৌমিক ও শান্ত মিত্র।
এই ক্লাব শুধু ফুটবলার, ক্রিকেটার নয়। ক্রীড়া প্রশাসকদেরও আঁতুরঘর। বছরের পর বছর তালিম নিয়ে আঁতুরঘরেই সিদ্ধিলাভ করে গিয়েছেন বিশ্বনাথ দত্ত, প্রদ্যোৎ দত্ত, সুব্রত দত্ত। এঁদের উত্তরসুরি হিসেবে ‘আঁতুরঘরে’ নীরবে যোগ্য কর্মকর্তা হয়ে উঠেছেন অনির্বান দত্ত (প্রদ্যোৎ দত্তর জৈষ্ঠ পুত্র)। আর অনির্বানের জেঠুর নাতি অধিরাজ দত্ত। গত চার বছর হল অধিরাজ ক্লাব প্রশাসনে যুক্ত হয়েছেন।
জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা হরিপদ দত্ত।
এই জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাব ১৯২৫ সালে তৈরি করে ছিলেন বিশ্বনাথ দত্ত, প্রদ্যোৎ দত্তর বাবা হরিপদ দত্ত। তিনি জর্জ ক্লাব যখন শুরু করলেন তখন ক্লাব সচিব ছিলেন ব্রিটিশ সাহেব এ এল কর্বেট। তিনি আসলে জর্জ টেলিগ্রাফ ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল ছিলেন। হরিপদবাবু এই কর্বেটকে ক্লাবের প্রথম সচিব করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পরাধীন ভারতে ভারতীয় কোনও কোম্পানিতে (জর্জ টেলিগ্রাফ ইনস্টিটিউট) একজন জর্জের চাকুরিজীবী ছিলেন এই বিদেশি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হরিপদ দত্তর পাঁচ পুত্রর (তারাপদ দত্ত,বিশ্বনাথ দত্ত,প্রণব দত্ত, প্রশান্ত দত্ত এবং প্রদ্যোৎ দত্ত) মধ্যে ময়দানে এসেছেন বিশ্বনাথ দত্ত ও প্রদ্যোৎ দত্ত। পরের জেনারেশনেও দুই জন (সুব্রত দত্ত ও অনির্বান দত্ত) মাঠ করছেন। ফোর্থ জেনারেশন হিসেবে চার বছর হল জর্জ ক্লাবে যোগ দিয়েছেন প্রদ্যোৎবাবুর দাদা প্রশান্ত দত্তর নাতি ২৭ বছরের অধিরাজ দত্ত।
বাংলার ফুটবলে এখনও “দত্ত পরিবার” -এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। উত্তরসূরিদের ব্যাটন হাতে এখন এগিয়ে যেতে মরিয়া অনির্বান, অধিরাজ দত্ত।