◆মহমেডান সচিব দানিশ ইকবাল◆
◆সন্দীপ দে◆
পাঁচের ও ছ’য়ের দশকে মহমেডান স্পোর্টিংকে ঘিরে একটি ছড়া গানের চল ছিল -“মহমেডান তুমকো লাখো সেলাম….।” পরবর্তীকালে সেই ছড়া গান হারিয়ে গিয়েছে। যত দিন গিয়েছে মহমেডানের ওই সাদা-কালো জার্সি ফিকে হয়ে এসেছে। বিশেষ করে গত তিন দশক থেকে মহমেডান নিজের কৌলিন্য হারিয়ে ফেলেছিল। কলকাতা ফুটবল তথা ভারতীয় ফুটবলের ‘তিন প্রধান’-এর ‘প্রধান তকমাটা হারিয়েই গিয়েছিল। ক্লাবের সাফল্য নেই। শুধুই ব্যর্থতা। কোনঠাসা হয়ে পড়েছিলেন সদস্য-সমর্থকরা। কিন্তু ২০২১ সাল থেকে হঠাৎ যেন নতুন করে জেগে উঠেছে শতাব্দী প্রাচীন মহমেডান স্পোর্টিং। উল্টে দেখুন, পাল্টে গিয়েছে। প্রয়াত সুলতান আহমেদের জমানার প্রায় সেই পরিচিত মুখ গুলোর অনেকেই আজও ক্লাবের কমিটি মেম্বার। পাশাপাশি উঠে এসেছেন কিছু তরুণ কর্মকর্তা। কামরুদ্দিন সাহেবরা মাথার উপর থেকে এই সব তরুণ কর্তাদের স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। ২০২১ সালে ৪০ বছর পর লিগ জয়, পরের বছরও চ্যাম্পিয়ন। ডুরান্ডে রানার্স। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্লাব তাঁবু, মাঠ নতুন করে গড়া হচ্ছে। সবেতেই আধুনিকতার ছোঁয়া। এ যেন পুরনো মহমেডানের ফিরে আসার ইঙ্গিত। তবে এবারের আই লিগে হঠাৎই ছন্দপতন। আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? আইএসএলে খেলতে পারবে? ক্লাব নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? ‘ইনসাইড স্পোর্টসে’র একাধিক প্রশ্নের খোলামেলা উত্তর দিলেন মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের তরুণ সচিব দানিশ ইকবাল।
প্রশ্ন : ২০ মাস হল মহমেডানের সচিব হয়েছেন। এই ২০ মাসেই আপনার জমানায় ৪০ বছর পর কলকাতা লিগ জিতেছেন। পরের বছরও চ্যাম্পিয়ন। ডুরান্ডে রানার্স। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বাঙ্কারহিলের মতো একটা ইনভেস্টর পেয়ে গিয়েছেন। গত তিন দশকে ক্লাব কর্তাদের এমন অ্যাক্টিভ ভাবে কাজ করতে দেখা যায়নি। সচিব পদে এসে বাজিমাত করে ফেলছেন তো! এখন সব কিছুই পাল্টে গিয়েছে। কি ভাবে সম্ভব হল?
দানিশ ইকবালঃ আমাদের ক্লাবের যে পরিবর্তন দেখছেন তা শুধু আমার একার জন্য নয়। আমাদের ৩০ জনের এক্সিকিউটিভ মেম্বার আছে। প্রত্যেকের অবদান আছে। কামার আঙ্কেলদের মতো সিনিয়ররা আমাদের মাথার উপরে আছেন। স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দিচ্ছেন। ভুল হলে শুধরেও দিচ্ছেন। সবার চেষ্টাতে আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। আমায একার কৃতিত্ত্ব একদম ভাববেন না।
প্রশ্নঃ গত দুই বছর ধরে সব ঠিক চলছে। কিন্তু আই লিগে দলের এত খারাপ পারফরম্যান্স কেন? সমস্যা কোথায়?
দানিশ ইকবালঃ এটাই তো ফুটবল। আমরা যে খারাপ খেলেছি তা নয়। কোচ বদল হয়েছে। নতুন কোচ কম সময়ের মধ্যে মানিয়ে নিচ্ছেন। আমরা কিন্তু হাল ছাড়িনি। এখনও ঘুরে দাঁড়ানোর সময় আছে। আমরা আশাবাদী।
প্রশ্নঃ মহমেডান সদস্য সমথর্করা এই পারফরমেন্স দেখে ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছেন।
দানিশ ইকবালঃ দেখুন, যে কোনও ক্লাবের কাছে সদস্য-সমর্থকরাই সব। আমরা তো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্যই দল গড়েছি। গত দুই বছরে প্লেয়ারদের কি ভাবে আমরা রেখেছি আপনারা সবাই তা জানেন। কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে না যে চ্যাম্পিয়ন হবেই। আমরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আছি বলেই তো নতুন কোচ নিয়োগ করেছি। আমরা শেষ পযর্ন্ত লড়াই করব। সদস্য-সমর্থকদের অনুরোধ করব দলের ফুটবলারদের পাশে থাকুন।
প্রশ্নঃ সদস্য-সমর্থকদের আশঙ্কা একটাই, আই লিগে চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলে আইএসএলে খেলার সুযোগ পাবেন না।
দানিশ ইকবালঃ দেখুন, আমাদের অনেক লক্ষ্য আছে। আপাতত প্রথম লক্ষ্য হল আইএসএলে খেলা। যদি চ্যাম্পিয়ন হতে পারি তাহলে সমস্যা নেই। আর ব্যর্থ হলে তখন আইএসএলে বিড ওপেন করার মরিয়া চেষ্টা করব। প্ল্যান ‘এ’, প্ল্যান ‘বি’ – আমরা দুটোই ভেবে রেখেছি।
প্রশ্নঃ গত বছর মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘মহমেডানও আইএসএলে খেলবে।’ তাছাড়া ভারত জুড়ে আপনাদের ক্লাবের বহু সমর্থক আছে। আপনারা খেললে তো আইএসএলেরও লাভ।
দানিশ ইকবালঃ আমরা অবশ্যই মুখ্যমন্ত্রীর সাহায্য নেব। দিদি ক্রীড়ামনস্ক মানুষ। খেলাকে খুব ভালবাসেন। আমাদের সঙ্গে সব সময় উনি আছেন। তাঁর সাহায্য ছাড়া এগোতে পারব না।
প্রশ্নঃ ইনভেস্টর বাঙ্কারহিলের সঙ্গে আপনাদের কত বছরের চুক্তি? মাঝে একবার একটু সমস্যা হয়েছিল। এখন সব ঠিক আছে নিশ্চয়?
দানিশ ইকবালঃ বাঙ্কারহিলের সঙ্গে আমাদের আট বছরের চুক্তি। ওদের সঙ্গে কোনও সমস্যা হয়নি। দীপক কুমার সিং
খুব ভাল মানুষ। আর উনিও চান মহমেডান আইএসএলে খেলুক। গত দুই বছর ধরে দলের পিছনে প্রচুর টাকা খরচ করেছেন দীপকভাই। খোঁজ নিয়ে দেখুন, দলের পিছনে খরচ করার ক্ষেত্রে ভারতে যত ক্লাব আছে তাদের থেকে মহমেডান কোনও অংশে কম নেই। প্লেয়ারদের থাকা,খাওয়া, পেমেন্ট, ট্রেনিংয়ের খরচ করতে পিছপা হননি দীপক ভাই।
প্রশ্নঃ এই বাঙ্কারহিলের সঙ্গেই তো ৫১ শতাংশ ও ৪৯ শতাংশ নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়েছিল না?
দানিশ ইকবালঃ না না। আসল ঘটনা হল, বাঙ্কারহিল একটি স্পনসর এনেছিল। সেই স্পনসর দাবি করেছিল, তাদের ৫১ শতাংশ দিতে হবে। আমাদের ৩০ জনের এক্সিকিউটিভ কমিটির প্রত্যেকে আপত্তি করেছিলেন। সেই আপত্তির কথা আমরা দীপকভাইকে বুঝিয়ে ছিলাম। পরে দীপকভাইও মেনে নিয়েছেন। আমরা তো আনন্দের সঙ্গে কাজ করছি। কোনও সমস্যা নেই।
প্রশ্নঃ গত তিন দশকে মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের প্রতি সদস্য সমর্থকদের একটা বিরক্তি কাজ করত। তাদের অভিযোগ ছিল কর্তারা কোনও কাজ করেন না। কোনও পরিকল্পনা ছিল না। দিশাহীন ভাবে চলত। এখন তো সেটা নেই? এখন তো নতুন কমিটি কাজ করছে।
দানিশ ইকবালঃ প্রথমেই আপনাকে জানিয়ে রাখি, আমাদের আগের কমিটিই আছে। সুলতান আঙ্কলের সময় যারা ক্লাবে ছিলেন তারাই আছেন। ওই সময় নতুন কিছু ছেলেদের ক্লাবে ডেকে নিয়েছিলেন। পরে কামার আঙ্কল আমাদের বলেন, এবার অ্যাক্টিভলি ক্লাবের কাজ করতে হবে। উনারা সুযোগ দিয়েছেন। আসলে আমাদের স্পনসর বা ইনভেস্টর ছিল না। সেটাই বড় সমস্যা ছিল। আগেও ‘এমটা’, রিলায়েন্স সহ কয়েকটা কোম্পানি এলেও এক বছরের বেশি থাকেনি। বাঙ্কারহিলের আসাটা আমাদের কাছে বড় পাওনা। আর আপনি যেটা কর্তাদের উপর বিরক্তির কথা বলছেন তার উত্তরে বলি, মহমেডানের একটা ট্রাস্ট ছিল ফুটবলকে ঘিরে। সেটা তো নষ্ট হয়েছিলই। কেউ ভাবতেই পারেনি সেই ট্রাস্ট ফিরে আসতে পারে। আসল কথা হল টাকা। টাকা থাকলেই ভাল দল হবে। সাফল্য আসবে। বাঙ্কারহিল আসার পর সাফল্য এসেছে। সদস্য সমর্থকদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি। আমাদের যখন সাফল্য ছিল না তখনও সদস্য- সমর্থকরা দলের সঙ্গে ছিলেন। এর জন্য আমরা সবাই সদস্য-সমথর্কদের কাছে কৃতজ্ঞ। আই লিগে খারাপ সময় যাচ্ছে। কাটিয়ে উঠব। আশাকরি সদস্য-সমর্থকরা আগের মতোই পাশে থাকবেন।
প্রশ্নঃ এই যে নতুন মাঠ, ক্লাব তাঁবু ভেঙে দোতলা হচ্ছে। ঝকঝকে কনফারেন্স রুম, ফুটবলারদের ও রেফারিদের ড্রেসিংরুম তৈরি হয়েছে। এটাকি আইএসএলের খেলার জন্য পরিকাঠামো তৈরি করছেন?
দানিশ ইকবালঃ দুটি কারণ। প্রথম অবশ্যই আইএসএলের জন্য আমাদের প্রস্তুতি। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে যারা ক্লাব পরিচালনা করতে আসবে তাদের যেন পরিকাঠামো নিয়ে ভাবতে না হয়।
প্রশ্নঃ আপনাদের নতুন মাঠ অসাধারণ। কিন্তু ফুটবল খেলাই হয় না। নিজেদের মাঠে ফুটবল ফেরাতে না পারলে তো সমস্যা তৈরি হবে।
দানিশ ইকবালঃ আপনার সঙ্গে আমি একমত। আপনি হয়তো জানেন কিনা জানি না, আমরা আইএফএ এবং এআইএফএফকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি যে, পরের মরসুম থেকে আমাদের মাঠেই লিগের ম্যাচ খেলব। মাঠে ফুটবল ফেরাতেই হবে।
প্রশ্নঃ আপনি মহমেডানের তরুণ সচিব। আপনার বাবা মঞ্জার ইকবাল আবার সহসভাপতি। সচিব হিসেবে আপনার লক্ষ্য কি?
দানিশ ইকবালঃ সচিব হিসেবে আমার লক্ষ্য হল আগামী ৪ বছরে মহমেডান স্পোর্টিংকে ভারতের এক নম্বর ক্লাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাটাই লক্ষ্য। ছোট ছোট লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি। আমাদের ‘ভিশন ২০২৭’। এই চার বছরে অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে হবে। আমাদের ২২ টি জেলায় মহমেডানের ফুটবল অ্যাকাডেমি হবে। পুরোটাই রেসিডেন্সিয়াল। ক্লাবে ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিক্স আছে। ভবিষ্যতে হকি ফেরাব। মহিলা ফুটবল টিম ছিল না। আমাদের ক্লাবের ইতিহাসে এই প্রথম মহিলাদের ফুটবল দল গড়ে কন্যাশ্রী কাপে খেলছে। অনেক পরিকল্পনা আছে। এখনই সব বলছি না। শুধু ট্রফি জেতাটাই শেষ কথা নয়। মহমেডানের মত ক্লাব সমাজকে কি দিতে পারবে সেটাও আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে আছে। আগামী চার বছরে অন্য মহমেডানকে দেখতে পাবেন।