◆সন্দীপ দে◆
সরকারি ভাবে সচিব হওয়ার পর আইএফএ থেকে ছুটলেন বাড়ি। মাকে প্রণাম করে আর্শীবাদ নেওয়ার পরে অনির্বান দত্ত একান্তে সময় দিলেন “ইনসাইড স্পোর্টস”কে।
প্রশ্ন : গত সাত মাস আগে ময়দানের তৃণমূল স্তর থেকে লড়াই শুরু রছিলেন। এই সাত মাসের মধ্যে রাজ্য ফুটবল নিয়ামক সংস্থার দু-দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসলেন। এমন ঘটনা কোনও সিনেমা জগতের পরিচালকও ভাবার সাহস পাবে না। এ তো পি সি সরকারের ট্রেন ভ্যানিসের থেকেও বড় ম্যাজিক ঘটে গেল! তাই নয় কি?
অনির্বান দত্তঃ (প্রশ্ন শুনেই হেসে উঠলেন) ঠিক বলেছেন,আমি যাত্রা শুরু করেছিলাম তৃণমূল স্তর থেকেই। ম্যাজিক তো মানুষই ঘটায়। একাধিক ক্লাব আমাকে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। সেটাই হয়েছিল। আবার সচিবপদটা যখন খালি হল,তখন ক্লাব কর্তারাই বলেছিলেন, আমাকেই সচিব পদে দেখতে চান। কোষাধ্যক্ষের পদে এনেছিলাম ভবিষ্যতে সচিব দেখব বলে।আমার উপর আস্থা রেখেছেন। তাহলে ওঁরা যা চায়বে তাই হবে। আমি রাজি হয়েছি।
প্রশ্নঃ ২৬ এপ্রিল আপনি কোষাধ্যক্ষ হলেন। ২০ জুন সচিব হলেন। ৫৫ দিনের মধ্যে কোষাধ্যক্ষ ও সচিব। কখনও ভাবতে পেরেছিলেন, এমনটা হতে পারে?
অনির্বান দত্তঃ সত্যি বলছি,ভাবিনি। আমি যখন কোষাধ্যক্ষ পদে কাজ শুরু করলাম তখন জানতাম না যে সচিব চলে যাবেন। ভেবেছিলাম এক বছর থাকবে।
প্রশ্নঃ আপনি কি জানেন একটি রেকর্ড করে ফেললেন?
অনির্বান দত্তঃ কিসের রেকর্ড বলুন তো?
প্রশ্নঃ ৫৫ দিনের মধ্যে কোষাধ্যক্ষ পদ ও সচিব পদে আসা। আইএফএ-র ইতিহাসে আগে কখনও হয়নি।
অনির্বান দত্তঃ প্লেয়াররা যখন খেলতে নামে তখন ভাল খেলার জন্যই মাঠে নামে। রেকর্ডের কথা কেউ ভাবে না। আমার কাজ কাজ করাটাই প্রধান লক্ষ্য। রেকর্ড গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১৯৯৪ সালে বাবার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বাবাকে এখনও মানুষ ভালবাসে। কারণ, কাজের জন্যই বাবাকে এখনও ভালবাসে,শ্রদ্ধা করেন। আমিও কাজের মধ্যে দিয়েই এগিয়ে যেতে চাই। যদি মনে করাতে পারি সেই চেষ্টাই করব।
প্রশ্নঃ মালবিকা দত্ত সাতের দশকের শেষ দিক থেকে ময়দানে তাঁর স্বামীর কঠিন লড়াই দেখেছিলেন। সাফল্যও দেখেছিলেন। আবার এআইএফএফের লড়াইয়ে তাঁর স্বামীকেই কি জঘন্য চক্রান্ত করে আটকে দেওয়া হয়েছিল,তাও জানেন। ময়দানের এমন নোংরা রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা মালবিকা দেবীর আছে। তারপর ২৭ বছর কেটে গেছে। ছেলে যখন তাঁর স্বামীর পথে হাঁটছেন, তখন উনি আপনাকে বাধা দেননি? উনি ঠিক কি বলেছিলেন আপনাকে?
প্রশ্নঃ মা বাধা দেননি। মা যেমন ময়দানের নোংরা রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল,পাশাপাশি ময়দানের ভালবাসাও দেখেছেন। যেদিন বাবা চলে গেলেন,সেদিন মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমেছিলেন। চোখের জল ফেলেছিলেন। খারাপটা আমিও দেখেছি কিন্তু ভালটা বেশি দেখেছি। আর এটাও বুঝেছি,ভাল কাজ করলে মানুষের ভালবাসা পাওয়া যায়। মা আমাকে একটা কথায় বলেছিলেন,”তোর বাবার সুনাম আছে। সেটা মাথায় রেখে চলবি। ভাল কাজ করবি। এমন কিছু করবি যাতে ফুটবলের লাভ হয়।”
প্রশ্নঃ বিশ্বনাথ দত্ত, অশোক ঘোষ, রঞ্জিত গুপ্ত, সুব্রত দত্তদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, অগ্রজদের মুখে শুনেছি আইএফএ-অন্যতম সফল সচিবের কথা উঠলেই আপনার বাবা প্রদ্যোৎ দত্তর কথা উঠে আসে। এবার কিন্তু প্রতিনিয়ত বাবার সঙ্গে আপনার তুলনা টানবে। বিখ্যাত বাবার ছেলে হওয়াটা এটা কি বিরম্বনা?
অনির্বান দত্তঃ বাবা আমার জীবনে হিরো। বাবা আমার কাছে বিরম্বনা নয়,অনুপ্ররণা। বাবাকে দেখেই আমি ফুটবল মাঠে এসেছি। বাবার আদর্শ মেনে বড় হওয়ার চেষ্টা করেছি। ফুটবলের প্রতি আমার ভাললাগা,ভালবাসা,আগ্রহ-সবই তো বাবাকে ঘিরে। তাছাড়া বাবার সময় আর এখনকার সময় অনেক ফারাক। বাবার সঙ্গে আমার তুলনা করবেন না।
প্রশ্নঃ আপনার বাবার মতোই কোষাধ্যক্ষ থেকে সচিব হলেন। এটা একটা মিল পাওয়া গেল। অমিল হচ্ছে,আপনার বাবা ভোটে জিতে সচিব পদে বসেছিলেন। আপনার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হল না। সর্বসম্মতিক্রমে সচিব হলেন।
অনির্বান দত্তঃ আপনি খুব ভাল করেই জানেন,আমি যখন কোষাধ্যক্ষ পদের জন্য লড়াই শুরু করেছিলাম তখন কনটেস্ট হবে ধরে নিয়েই নিজেকে তৈরি রেখেছিলাম। কিন্তু যিনি কনটেস্ট করছিলেন তিনি শেষ মুহূর্তে আর কনটেস্ট করেননি। সচিবের ক্ষেত্রে কোনও কনটেস্ট হল না। ক্লাবের সিংহভাগ আমাকেই চেয়েছে। তাই হয়তো কেউ কনটেস্ট করেননি। তার দায়ভার আমার? তবে আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি,শক্ত বিরোধী দল থাকা জরুরি। বিরোধী দল থাকলে নিজেদের ভুল শুধরে নিতে পারব। সতর্ক থাকতে পারবো। আর কনটেস্ট হওয়াটাও দরকার।
প্রশ্নঃ ময়দানের ক্রমশ চরিত্র বদলে যাচ্ছে। ভাল,ভদ্র মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। আমরা হারিয়ে ফেলছি নীতি। সুস্থ লড়াই হারিয়ে ফেলছি। একটা চরম অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি। প্রদ্যোৎ বাবু এই সময়ে সচিব হলে সফল হতেন কি না জানি না। কিন্তু আপনি কাঁটার মুকুট নিয়ে যে সিংহাসনে বসলেন তা আগামী চার বছর থাকতে পারবেন তো? কি ভাবে ট্যাকল করবেন?
অনির্বান দত্তঃ আমি এসেছি কাজ করার জন্য। কাঁটার মুকুট বলে কিছু হয় না। জীবনে ঝুঁকি তো থাকবেই। পছন্দ,অপছন্দ তো থাকবেই। চ্যালেঞ্জ থাকলেই কাজ করার আনন্দ। মানুষ তাকেই সেলিব্রেট করে যে শৃঙ্গে পৌঁছয়। আমার ৪৩ বছর বয়সে অনেক লড়াই করেছি। আমি লড়াইকে ভয় পাই না। আমি একটা জিনিস জানি,ভাল কাজ করতে হবে, ক্লাব,জেলার পাশে থাকতে হবে। তাদের সাহায্য নিয়ে ফুটবলের উন্নতি করতে হবে।
প্রশ্নঃ সচিবের চেয়ারে বসে, এই মুহূর্তে আপনার মতে প্রথম তিনটি কঠিন অ্যাসাইনমেন্ট কি কি?
অনির্বান দত্তঃ এই মুহূর্তে বলতে পারি, কলকাতা ফুটবল লিগ, কলকাতা ফুটবল লিগ, কলকাতা ফুটবল লিগ। এক বছর লিগ হয়নি। গত বছর শুধু প্রিমিয়ার লিগ হয়েছে। এতগুলো ক্লাব,ফুটবলার ফুটবল থেকে দুরে সরে আছে। ফুটবলে ফেরানোটা আমার প্রথম লক্ষ্য। এবার বয়স ভিত্তিক লিগ হবে। খুবই ইতিবাচক দিক। আইএফএ শিল্ড আছে। স্কুল ফুটবলকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। স্পনসর আনতে হবে। অনেক পরিকল্পনা আছে। সবে তো সচিব পদে বসলাম। সময় খুব কম। খুব চেষ্টা করছি। দেখা যাক কতটা কি করতে পারি।
প্রশ্নঃ আমার তো মনে হয় একজন সচিবের কাছে স্পনসর আনার থেকেও মোহনবাগান,ইস্টবেঙ্গলকে সামলানো সব থেকে কঠিন কঠিন কাজ। আপনি সামলাতে পারবেন?
অনির্বান দত্তঃ তিন প্রধান ক্লাবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল। মোহনবাগান,ইস্টবেঙ্গল,মহমেডান ভারতীয় ফুটবলের অহঙ্কার,গর্ব। তিন প্রধানকে বাদ দিয়ে ফুটবল হতে পারে না। ওরা কিন্তু ফুটবলের ভালোর জন্যই কাজ করে। আমরাও তাই করি। আশাকরি তিন প্রধান সহযোগিতা করবে।
প্রশ্নঃ আইএফএ- গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রতিযোগিতা। লিগ আর শিল্ড। আইএসএল হওয়ায় দুই প্রধান প্রথম টিম লিগে খেলবে না। লিগ তো কোনঠাসা! আর হাতে রইল শিল্ড। কি ভাবে বিক্রি করবেন? উন্মাদনা ফিরিয়ে আনতে পারবেন?
অনির্বান দত্তঃ এই ব্যাপারটা আমি মানতে রাজি নয়। আমি মনে করি এই ক্রেজটা তিন প্রধানের জার্সির ক্রেজ। কোনও ব্যক্তির ক্রেজ হতে পারে না। সদস্য-সমর্থকরা মাঠে আসেন জার্সির রংয়ের টানে। এটাও বলে রাখি, এই তিন প্রধানের জার্সি গায়েই তারকা ফুটবলার হয়ে ওঠে। আর এই তিন প্রধান ক্লাব কর্তারা হারার জন্য মাঠে নামবে না। সব সময় জিততে চায়। ফুটবলের বাজার শেষ হয়ে যায়নি। বি পজিটিভ।
প্রশ্নঃ যারা বাংলার ক্রীড়া জগতের নিয়ন্ত্রণ করে তারা বড্ড বেশি কলকাতা কেন্দ্রিক। কলকাতাকেই পশ্চিমবঙ্গের খেলাধূলা ভাবে। অথচ জেলাকে যে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল সেই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সব সময় জেলা অবহেলিত। আপনি জেলার জন্য কি ভাবছেন?
অনির্বান দত্তঃ স্কুল ফুটবল,আন্তঃজেলা ফুটবল করতেই হবে। আপনি নিশ্চয় জানেন,জেলার প্রতি আমার আলাদা টান আছে। জেলার কর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবো। তাঁদের সমস্যার কথা তাঁদের মুখ থেকেই শুনতে চাই। জেলা ছাড়া রাজ্য ফুটবল এগোবে না।
প্রশ্নঃ আপনি সচিব হবেন কিনা তাই নিয়ে আইএফএ স্টাফরা টেনশনে ছিলেন। তাঁদের হাতে কোনও ভোট নেই। কোনও ক্ষমতাও নেই। গত এক মাস ধরে আপনাকে নিয়ে টেনশনে ছিলেন স্টাফেরা। কারণ আপনাকেই ওরা সচিব হিসেবে চায়ছিল। কি এমন আপনার মধ্যে আছে যে সকল স্টাফ আপনাকে এই ৫৫ দিনে এত ভালবেসে ফেলেছেন?
অনির্বান দত্তঃ (আবার হেসে উঠলেন। তারপরেই বলতে শুরু করলেন) এটা হয়তো ভগবানের আর্শীবাদ। আমি যেখানেই কাজ করেছি সেখানেই ভালবাসা পেয়েছি। যেখানে কাজ করব সেটা যেন সবাই পরিবার হয়ে কাজ করব। তবে কেউ যদি ভুল করে তাকে বকতে হবে,ভুল ধরিয়ে দিতে হবে। আবার প্রশংসাও করতে হবে। আমি মনে করি প্রত্যেককে তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। যে জল দেয় তাঁরও সম্মান আছে। তাঁকেও সম্মান দিতে হবে। আমি চেষ্টা করি সবাইকে নিয়ে কাজ করা।
প্রশ্নঃ এই যে এখন সবাই অনির্বান দত্ত সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বলছে। কিন্তু এই ভাল লাগাটা, খারাপে বদলে যেতে পারে। যদি একটা ভাল স্পনসর আনতে না পারেন, যদি সুষ্ঠুভাবে লিগ করতে না পারেন তাহলেই ভিলেন হয়ে যাবেন। এই ভাবনায় টেনশন হচ্ছে?
অনির্বান দত্তঃ না, ভিলেন হওয়ার টেনশন আমার নেই। সব কিছু আমার হাতে নেই। আমি চেষ্টা করতে পারি। যে চেষ্টা করে তাকে ভগবান সাহায্য করে। আমার অনেক পরিকল্পনা আছে। সময় কথা বলবে। দেখা যাক না কি হয়।
প্রশ্নঃ আপনার হাতে সময় নেই। এর মধ্যে লিগ শুরু করতে হবে। আবার বকেয়া টাকা না পেলে মোহনবাগান লিগ না খেলার প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছিলেন মাস খানেক আগে। কি করবেন?
অনির্বান দত্তঃ দেখুন টাকা শুধু মোহনবাগান একা পায় তা নয়। অনেক ক্লাব টাকা পায়। আইএফএ-এর আর্থিক অবস্থার কথা সবাই জানে। এর মধ্যে থেকেও আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। সব ক্লাবকে টাকা দিতে হবে। যতদুর জানি, টাকা না পেলে মোহনবাগান খেলবে না- এমন বলেছে বলে শুনিনি। তাদের সদস্য-সমর্থকদের বঞ্চিত করবে না। আমার আশা তারা কলকাতা লিগ খেলবে।
প্রশ্নঃ তিন প্রধান ক্লাবের মাঠে ফ্লাড লাইট আছে। সন্ধ্যায় লিগের খেলা করানো যায় না?
অনির্বান দত্তঃ সব সময় খেলা সম্ভব নয়। কারণ, ফ্লাড লাইটে ম্যাচ করলে খরচের একটা ব্যাপার আছে। যখন ফ্লাড লাইটে ম্যাচ করার প্রয়োজন হবে তখন খেলা হবে।
প্রশ্নঃ আপনার হাতে চারটে বছর। মানুষ পারফর্মারদের মনে রাখে। সামনের চার বছরে পারফরম্যান্স করতে না পারলে ক্লাব আর সুযোগ দেবে না। সেটা নিশ্চয় আপনি জানেন?
অনির্বান দত্তঃ এই নিয়ে আমি চিন্তা করি না। আমার নিজের কিছু নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে। সেই পরিকল্পনা গুলি সঠিক ভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে। তারপর যদি দেখা যায় আমার পরিকল্পনায় ঘাটতি আছে,অথবা কাজ করতে পারছি না,তাহলে অবশ্যই আমার জায়গায় অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত। সেটাই হওয়া উচিত।