◆সন্দীপ দে◆
ক্রীড়া জগতের দুই মর্মান্তিক ঘটনাকে ভুলে যায়নি বাংলা। এখনও মনে রেখেছে। প্রতি বছর শ্রদ্ধার সঙ্গে ফিরে ফিরে আসে। মাঠে এক মর্মান্তিক ঘটনা কেড়ে নিয়েছিল ১৬ টা তাজা প্রাণ। ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট, ইডেনে মুখোমুখি হয়েছিল মোহনবাগান – ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ। সেই ম্যাচেই রেফারির দুটি লাল কার্ডকে কেন্দ্র করে সেদিন ইডেনে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে শুরু হয়েছিল চরম গন্ডগোল। মৃত্যু হয়েছিল ১৬ জন ফুটবল সমর্থক।
দ্বিতীয় মর্মান্তিক ঘটনা (ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ) ঘটেছিল ১৯৬২ সালের ৭ মার্চ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বার্বাডোজে। সেই ম্যাচে একটি প্রাণ বেঁচে ফিরেছিল। প্রথম ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু। দ্বিতীয় ঘটনা হল মর্মান্তিক ও মানবিক। দুটি ঘটনা বিশ্ব ক্রীড়ায় হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। দুটি ঘটনাকেই রক্তদান শিবিরের মাধ্যমে প্রতি বছর স্মরণ করে আসছে আএফএ এবং সিএবি। হ্যাঁ, এমনটা করতে পারে শুধুমাত্র বাংলা। মিলটাও কি অদ্ভুত! এমন দুটি ঘটনার ফিরে দেখার রেওয়াজ শুরু ১৯৮১ সাল থেকে। এখনও চলছে। আগামী দিনেও চলবে।
আজ, বুধবার, ৩ ফেব্রুয়ারি ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের (সিএবি) প্রতিষ্ঠা দিবস। আর এই দিনটাতেই ‘ফ্রাঙ্ক ওরেল ডে’ রক্তদান শিবির হিসেবে বিশ্ব ক্রীড়া জগতের এক উজ্জ্বল মানবিক মুখ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে সিএবি।
কেন ‘ফ্রাঙ্ক ওরেল ডে’ বেছে নেওয়া হল? তাহলে ফিরে যেতে হবে ৫৮ বছর পিছনে। ১৯৬২ সালের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরু। বার্বাডোজে মুখোমুখি ভারত-ওয়েষ্ট ইন্ডিজ। চার টেস্ট সিরিজের তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ। প্রথম ইনিংসে ভারতের হয়ে ওপেন করতে মাঠে নেমেছেন অধিনায়ক নরিম্যান জামসেদজি কন্ট্রাক্টর ও দিলীপ সরদেশাই। নিজের ব্যক্তিগত ২ রানে অপরাজিত অধিনায়ক নরি স্ট্রাইক নেবেন। বল হাতে তৈরি চার্লস গ্রিফিথ। এটি ছিল চার্লসের দ্বিতীয় ওভারের চতুর্থ বল। ভয়ঙ্কর বাউন্সার। চার্লসের বাউন্সার সামলাতে গিয়ে মিস টাইমিং করে ফেলেন হেলমেটহীন (তখন হেলমেট পরা হত না) নরি কন্ট্রাক্টর। বল লাগে সোজা মাথায়। নরি মাটিতে, রক্তাক্ত। আঘাত গুরুতর। সঙ্গে সঙ্গে নরিকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। পরিস্থিতি ভাল নয় দেখে নিউ ইয়র্ক থেকে স্পেশাল সার্জেন উড়িয়ে আনা হল। সেই সার্জেন জানিয়ে দিলেন নরিম্যানকে বাঁচাতে হলে দরকার রক্ত। সেইদিন, সেই সময় ওয়েষ্ট ইন্ডিজের তৎকালীন অধিনায়ক স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল নিজে রক্ত দিয়ে ভারত অধিনায়ক নরিম্যানকে বাঁচিয়েছিলেন। ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেলের এই মানবিকতার পরিচয় পেয়ে গোটা বিশ্ব মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর সেই ওরেলকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৮১ সাল থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি সিএবির প্রতিষ্ঠা দিবসের দিন ‘স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল নামে রক্তদান করা হয়। এই দিন রাজ্যের বহু মানুষ রক্তদান করেন।
আইএফএ-এর অভিশপ্ত ১৬ আগস্ট রক্তদান শিবিরে রক্তদাতাদের যেমন তারকা ফুটবলারের সাক্ষর করা সার্টিফিকেট দেওয়া হয়, তেমনি ‘ফ্রাঙ্ক ওরেল ডে’তেও তারকা ক্রিকেটারের সাক্ষরিত সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।
১৯৮১ সালে ‘ফ্রাঙ্ক ওরেল ডে’তে রক্তদাতাদের দেওয়া সার্টিফিকেটে সই করেছিলেন খোদ কন্ট্রাক্টর। তিনি সেই বার ইডেনেউপস্থিত ছিলেন। ১৯৮২ সালে সার্টিফিকেটে সই করেন ডন ব্রাডম্যান ও ইয়ান বোথাম। ১৯৮৩, ‘৮৪,’৮৫,তে যথাক্রমে সই করেন ইমরান খান, সুনীল গাভাসকার ও কপিল দেব। ২০০৬ সালে সৌরভ গাঙ্গুলি ও ২০১৬ সালে শচীন তেন্ডুলকর রক্তদাতাদের সার্টিফিকেটে সই করেন। এবার সই করছেন ভারতীয় মহিলা দলের ঝুলন গোস্বামী।
উল্লেখ্য, নরিম্যানের সেই টেস্ট ম্যাচ ছিল জীবনের শেষ টেস্ট ম্যাচ। ১৯৬২ সালে চার্লসের বাউন্সার দুর্ঘটনায় প্রাণে বাঁচলেও ক্রিকেটে আর ফিরতে পারেননি নরিম্যান। তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল একটা টেস্ট খেলা। কিন্তু চিকিৎসকরা তাঁকে মাঠে নামার অনুমতি আর দেননি। ৩১ টি টেস্টে রান করেছেন ১৬১১ রান। শতরান একটি, অর্ধ শতরান ১১টি। সর্বোচ্চ রান ১০৮।
আর স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল? ৫১ টি টেস্ট খেলে রান করেছিলেন ৩,৮৬০। গড় ৪৯.৪৮। শতরান ৯টি, অর্ধশতরান ২২টি। সর্বোচ্চ রান ২৬১। সফল ক্রিকেটার। বিশ্ব ক্রিকেটে হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি। কিন্তু তিনি বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারেননি। লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে মাত্র ৪২ বছর বয়সেই মৃত্যু হয়েছিল স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেলের।
আমরা,বাঙালিরা তাঁর ক্রিকেটীয় তথ্য, সাফল্য মনে রাখি না। তাঁর মৃত্যু হয়েছে সেটাও মানিনা। আমরা প্রত্যেক বছর ৩ ফেব্রুয়ারি এক মানবিক ক্রিকেটারকে মনে করি। বার বার, আমাদের মাঝে ফিরে ফিরে আসে স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল, সিএবির হাত ধরে।