ফুটবলার তুলে আনতে জেলামুখী জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাব

0

ইনসাইড স্পোর্টসের প্রতিবেদন,১৮ জুলাই : বাংলার ফুটবলের সাপ্লাই লাইন সেই জেলা। কলকাতা লিগে এখনও জেলার ফুটবলাররাই খেলে বেশি। তবে এখনও বাংলার বিভিন্ন জেলায় ছোট ছোট গ্রাম আছে যেখানে বহু ফুটবল প্রতিভা আছে। যা অনেকেই জানে না। কেমন আছে জেলার ফুটবল? বিভিন্ন জেলার ফুটবল নিয়ে “ইনসাইড স্পোর্টস বাংলা” ইউটিউব চ‍্যানেলে শুরু হয়েছে “ফুটবলারের খোঁজে ” বিশেষ সিরিজ। এখনও পযর্ন্ত আমরা বাঁকুড়া,পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুরের ফুটবল তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। বাকি ১৯ টি জেলার ফুটবল আমরা তুলে ধরব। আমাদের সেই চেষ্টা, আবেদনকে মান‍্যতা দিয়েই হয়তো এবার একটু অন‍্যভাবে জেলামুখি হল গড়ের মাঠের ৯৭ বছরের জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাব।

প্রতিবছর দলবদল শুরুর আগে জেলা থেকে নির্দিষ্ট কিছু ফুটবলারকে নিজেদের ক্লাবে সই করান কলকাতার একাধিক ক্লাব কর্তারা। জর্জ টেলিগ্রাফও তার ব‍্যতিক্রম নয়। কিন্তু এবার একটু অন‍্য ভাবে, অন‍্য ভাবনায় জর্জ টেলিগ্রাফ। অতীতে অচ‍্যুত ব‍্যানার্জি, খোকন বসু মল্লিক, দুখীরাম মজুমদার, ভুতনাথ বিশ্বাস, পটা গুপ্তরা বিভিন্ন জেলার গ্রাম ঘুরে ঘুরে ফুটবলার খুঁজে আনতেন। তারপরেও কলকাতার অনেক ক্লাব কর্তারা গ্রামে গিয়েছেন। বর্তমানে জেলায় গিয়ে,থেকে ফুটবলার খোঁজার চেষ্টা কমে গিয়েছে। যদিও ইউনাইটেড স্পোর্টসের অন‍্যতম কর্তা নবাব ভট্টাচার্য এখনও জেলায় জেলায় গিয়ে ফুটবলার তুলে আনার চেষ্টা বজায় রেখেছেন। জর্জ টেলিগ্রাফ ক্লাব এবার সেই পুরনো পদ্ধতিতেই ফুটবলারের খোঁজ শুরু করে দিল।

পুরুলিয়া জেলার মানবাজার থেকে একটু ভিতরে ছোট্ট গ্রাম পিয়ালশোল। জঙ্গল মহলের এই এলাকা গুলি নাকি একটা সময় মাওবাদি উপদ্রুপ ছিল। মাও নেতা কিষেন জির মৃত‍্যুর পর মাওবাদি শক্তি হারিয়েছে। এই পিয়ালশোল গ্রামেই আছে বিবেকানন্দ ফুটবল অ‍্যাকাডেমি। নিজেদের ক্লাব কোচ রঞ্জন ভট্টাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে সেই গ্রামেই পৌঁছে গিয়েছিলেন জর্জ টেলিগ্রাফের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি অধিরাজ দত্ত। গত ১৫ ও ১৬ জুলাই দুদিন ধরে ট্রায়াল নেওয়া হয় প্রায় ২৪০ জন ফুটবলারের। পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ফুটবলার এসে ট্রায়াল দিয়েছে। এমনকি খবর পেয়ে ধানবাদ,জামশেদপুর থেকেও ফুটবলার এসেছিলেন। দুদিন ট্রায়ালে আপাতত ১২ জন ফুটবলারকে নির্বাচিত করেছে জর্জ। নির্বাচিত ১২ ফুটবলার হলেন, বিমল টুডু, কালীচরণ মারান্ডি, রাজেস মারান্ডি, সুজন হাঁসদা, মানবেন্দ্র টুডু, ফিরদৌস আহমেদ, অজিত মাঝি, ফুলচাঁদ হাঁসদা, বিশ্বজিৎ হেমব্রম, সেরমা হেমব্রম, আশোক বাসরা ও মিহির হাঁসদা।

“ট্রায়ালে যে সংখ‍্যায় ছেলেরা এসেছিল তাতে দুদিনে ফুটবলার বাছা খুব কঠিন। এখানে এসে যা দেখলাম তাতে প্রথম ডিভিশন থেকে নিচের ডিভিশনে খুব সহজেই কলকাতা লিগে খেলে দেবে। এবার করোনার কারণে বয়স ভিত্তিক লিগ হবে না। তাই আপাতত আমরা প্রিমিয়ার ডিভিশনের জন‍্য আমরা শুধু আভাদের ক্লাবের জন‍্যই ১২ জন ফুটবলার বেছে নিয়েছি। এবার কলকাতায় আর এক দফা ট্রায়াল, ম‍্যাচ প্র‍্যাকটিস দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে বলছিলেন জর্জ টেলিগ্রাফের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি অধিরাজ দত্ত। জেলায় গিয়ে কি বুঝলেন? উত্তরে অধিরাজ বলেন,”জেলায় ফুটবলার আছে শুনেছিলাম। এবার চোখে দেখলাম। জেলাকে আমাদের গুরুত্ব দিতেই হবে। আমরা সেই ভাবে এগোচ্ছি।”

এই ট্রায়াল ক‍্যাম্প করার জন‍্য এগিয়ে এসেছে পুরুলিয়ার একঝাঁক চিকিৎসকদের নিয়ে গড়া এনজিও ‘অগ্নিভ ফাউন্ডেশন’। তাছাড়া পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ বিদ‍্যাপীঠের প্রাক্তন ছাত্ররাও এগিয়ে এসেছেন। পিয়ালশোল গ্রামের বিবেকানন্দ ফুটবল ক‍্যাম্পটা তৈরি হয়েছে চিকিৎসক প্রশান্ত মাহাত ও সুমন্ত সেনের জন‍্যই। প্রশান্ত মাহাত বলছিলেন,”আমাদের মত গ্রামে এসে দুদিন ট্রায়াল নিয়ে ফুটবলার তুলে আনার জন‍্য জর্জ টেলিগ্রাফ যে ভূমিকা নিয়েছে তা আমাদের কাছে বিরাট ব‍্যাপার। আপনারা,ইনসাইড স্পোর্টস এই ভাবেই জেলার ফুটবলকে তুলে ধরুন। কলকাতার ক্লাব কর্তারা একটু জেলামুখি হলে লাভ হবে বাংলার ফুটবলের।”

পুরুলিয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার অন‍্যতম কর্তা পার্থ মুখার্জি জানান,”ভীষন ভাল উদ‍্যোগ জর্জ টেলিগ্রাফের। আমরা চাই প্রতি বছর জর্জটেলিগ্রাফ ছাড়াও অন‍্য ক্লাব কর্তারাও আসুন।”

জর্জ টেলিগ্রাফ মানেই ইতিহাস। যা জেলার নতুন প্রজন্ম হয়তো জানেন না। কত বড় মাপের ফুটবলার খেলে গিয়েছেন এই জর্জ টেলিগ্রাফ ক্লাবে। ছয়ের দশকে জর্জ টেলিগ্রাফে ভারত বিখ‍্যাত চার গোলকিপার খেলেছেন। এঁরা হলেন, মনিলাল ঘটক, সনৎ শেঠ, স্বরাজ চ‍্যাটার্জি এবং অবনী বসু। তারও আগে জর্জে খেলেছেন শাহু মেওয়ালাল, রুনু গুহঠাকুরতা, মানিক গোস্বামী (চুনী গোস্বামীর দাদা), সেলিম, চন্দন ব‍্যানার্জি থেকে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য্য, অলোক মুখার্জি, সত‍্যজিৎ চ‍্যাটার্জি, সঞ্জয় মাঝি, ষষ্ঠী দুলে, সেখ আজিম, সফর সর্দার, বিশ্বজিৎ সাহা, শুভ কুমার সহ কত কত ফুটবলার। কেরিয়ারের শেষের দিকে সুরজিৎ সেনগুপ্ত জর্জে খেলেছিলেন। এই জর্জ টেলিগ্রাফ ক্লাবে জীবনে প্রথম কোচিং শুরু করেছিলেন সুভাষ ভৌমিক ও শান্ত মিত্র।

এই ক্লাব শুধু ফুটবলার, ক্রিকেটার নয়। ক্রীড়া প্রশাসকদেরও আঁতুরঘর। বছরের পর বছর তালিম নিয়ে আঁতুরঘরেই সিদ্ধিলাভ করে গিয়েছেন বিশ্বনাথ দত্ত, প্রদ‍্যোৎ দত্ত, সুব্রত দত্ত। এঁদের উত্তরসুরি হিসেবে ‘আঁতুরঘরে’ নীরবে যোগ‍্য কর্মকর্তা হয়ে উঠেছেন অনির্বান দত্ত (প্রদ‍্যোৎ দত্তর জৈষ্ঠ পুত্র)। আর অনির্বানের জেঠুর নাতি অধিরাজ দত্ত গত চার বছর হল ক্লাব প্রশাসনে যুক্ত হয়েছেন।

জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা হরিপদ দত্ত

এই জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাব ১৯২৫ সালে তৈরি করে ছিলেন বিশ্বনাথ দত্ত, প্রদ‍্যোৎ দত্তর বাবা হরিপদ দত্ত। তিনি জর্জ ক্লাব যখন শুরু করলেন তখন ক্লাব সচিব ছিলেন ব্রিটিশ সাহেব এ এল কর্বেট। তিনি আসলে জর্জ টেলিগ্রাফ ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল ছিলেন। হরিপদবাবু এই কর্বেটকে ক্লাবের প্রথম সচিব করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পরাধীন ভারতে ভারতীয় কোনও কোম্পানিতে (জর্জ টেলিগ্রাফ ইনস্টিটিউট) একাধিক ব্রিটিশ সাহেবরা চাকরি করতেন। কর্বেট সাহেব তেমনি একজন জর্জের চাকুরিজীবী ছিলেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হরিপদ দত্তর পাঁচ পুত্রর (তারাপদ দত্ত,বিশ্বনাথ দত্ত,প্রণব দত্ত, প্রশান্ত দত্ত এবং প্রদ‍্যোৎ দত্ত) মধ‍্যে ময়দানে এসেছেন বিশ্বনাথ দত্ত ও প্রদ‍্যোৎ দত্ত। পরের জেনারেশনেও দুই জন (সুব্রত দত্ত ও অনির্বান দত্ত) মাঠ করছেন। ফোর্থ জেনারেশন হিসেবে চার বছর হল জর্জ ক্লাবে যোগ দিয়েছেন প্রদ‍্যোৎবাবুর দাদা প্রশান্ত দত্তর নাতি ২৫ বছরের অধিরাজ দত্ত।

বাংলার ফুটবলে দত্ত পরিবার এগিয়ে যেতে চায়। বাংলার ফুটবল যখন পিছিয়ে পড়ছে তখন জেলায় গিয়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা কলকাতা ময়দানের “দত্ত পরিবার”-এর। বাংলার ফুটবলে এখনও “দত্ত পরিবার” -এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। উত্তরসূরিদের ব‍্যাটন হাতে এখন এগিয়ে যেতে মরিয়া অনির্বান, অধিরাজ দত্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here