সন্দীপ দে▪ কুসমুন্ডি (দ:দিনাজপুর)
তিনি সুব্রত ভট্টাচার্য নয়, সুভাষ ভৌমিকও নয়। পিকে ব্যানার্জির মত কলকাতার ক্লাব স্তরে বছরের পর বছর কোচিং করার সুযোগ বা সেই ভাবে সাফল্য, প্রচারও পাননি কোচ জহর দাস। তিনি যেন অমল দত্তর দ্বিতীয় সংস্করণ। অমল দত্তর মতোই ছোটদের নিয়ে কাজ করতে ভালবাসেন। কোনও ক্লাব বিপদে পড়লেই ডাক পরে কোচ জহরের। কখনও মোহনবাগানে কোচিং করিয়েছেন। আবার প্রয়োজন ফুরোলেই তাড়িয়ে দিয়েছেন কর্তারা। তবু অমল দত্তর মতোই স্বাভাবিক থেকেছেন। ফুটবল কোচিংয়ের নেশায় অমলের মতোই ভিন রাজ্যে ছুটে গিয়েছেন তিনি। মিজোরামের আইজলের দায়িত্ব নিয়ে সাফল্য এনেছিলেন। গত বছর এক ঝাঁক বাঙালি নিয়ে কলকাতা লিগে পিয়ারলেসকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন এই জহর দাস। তারপরেও ক্লাবে তাঁর চাকরি থাকে না। তবু অমলের মতোই তিনি নির্বিকার। আজ থেকে ২০ বছর আগে অনূর্ধ্ব-১৭ ভারতীয় দলের কোচ হয়ে দারুন কাজ করেছিলেন। তাঁর পারফরম্যান্স দেখে এআইএফএফের একটা অংশ চেয়েছিল, জহরকে ভারতের সিনিয়র দলের দায়িত্ব দিতে। কিন্তু পিছনের রাস্তা দিয়ে সুখবিন্দর সিংয়ের প্রবেশ। আর জহর? আউট। অমল দত্তর মত জহর আর দেশের হয়ে কাজ করার আর সুযোগই পেলেন না। পিকে, সুব্রত, সুভাষরা চিরকাল তারকা ফুটবলার নিয়ে বাজিমাত করে গিয়েছেন। আর জহর সেখানে অমলের মতোই ছোটদের নিয়ে কাজ করে সাফল্য পেয়েছেন। এআইএফএফ দুরে থাক আইএফএও তাঁকে ব্যবহার করতে পারল না। তিনি বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলে যেন উপেক্ষিত দ্রোণাচার্য। অমলের মতো। আমরা নিশ্চিত জহর দাসের মূল্যায়ন একদিন হবেই।
‘ইনসাইড স্পোর্টস’ অর্থাৎ আমরা, আমাদের ম্যাগাজিন, নিউজ পোর্টাল ও ইউটিউব চ্যানেলের জন্য বাংলার ২২ টি জেলার ফুটবল প্রজেক্ট নিয়ে নতুন ভাবে কাজ শুরু করেছি (জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই আমাদের তিনটি মাধ্যমেই সিরিজ আকারে প্রকাশ করা হবে)।
প্রতিটা জেলায় আমরা পৌঁছে যাচ্ছি। দক্ষিণ দিনাজপুরের একমাত্র অর্গানাইজ ফুটবল কোচিং ক্যাম্প কুশমুন্ডির YMA (ইয়ং মেন্স অ্যাসোসিয়েশন)-এ জহর দাস পৌঁছে গিয়েছেন ফুটবলারের খোঁজে। আমরা (ইনসাইড স্পোর্টস) তাঁর আসার আগেই দক্ষিণ দিনাজপুরে ফুটবলারের সন্ধানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। জহর দাসকে পেয়ে যাব ভাবিনি।
কি ভাবে এলেন জহর? কুশমুন্ডির YMA -এর শীর্ষ কর্তা শিবশঙ্কর পাল ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে জানালেন,”আমাদের ক্যাম্পে বেশ কিছু ভাল ছেলে আছে। আমরা গত বছরই ভেবেছিলাম, কলকাতা থেকে ভাল কোচ এনে পরামর্শ নেব। অনেক কোচের কথা মাথায় ছিল। জহর স্যার ছিল আমাদের প্রথম পছন্দ। তাঁর সাহায্য চাইতেই না করেননি। তিনিও ছোটদের নিয়েই কাজ করতে চান। বিভিন্ন জেলা থেকে ফুটবলার তুলে আনতে চান। তাই এক কথায় আমাদের কুশমুন্ডি আসতে রাজি হয়ে গেলেন। ছেলেরা খুব উপকৃত। সত্তর বছর বয়সেও যে ভাবে উনি ছেলেদের মাঠে নেমে ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিচ্ছেন জাস্ট ভাবা যায় না। কলকাতার ময়দানে অনেককেই বলতে শুনেছি, জহর স্যার নাকি এই মুহূর্তে বাংলার সব থেকে শিক্ষিত কোচ। আজ আমরা কুশমুন্ডির সবাই সেটা বুঝতে পারছি। আমরা কলকাতা ফুটবলের মূল স্রোত থেকে অনেক দুরে থাকি। সুযোগ সুবিধা পাই না। আমাদের এখানে এসেছেন যখন, তখন আমাদের ক্যাম্পের ছেলেদের নিজের চোখেই দেখে যান।”
দক্ষিণ দিনাজপুরের ছোট্ট গ্রাম কুশমুন্ডি। গঙ্গারামপুর সাব ডিভিশনের মধ্যে পরে। এই গ্রামের ফুটবল বলতে সরলাবালা স্কুলের মহিলা ফুটবল। সাফল্য আছে। কিন্তু পুরুষ ফুটবলে সাফল্য নেই। বালুরঘাট ও মালদা থেকে কুশমুন্ডির দুরত্ব দেড় ঘন্টা। রায়গঞ্জের দুরত্ব ৪৫ মিনিট। পরাধীন ভারতে এই কুসমুন্ডিতে ব্যাপক হারে নীল চাস করাত অত্যাচারী ব্রিটিশরা। সেই নীল কুঠির ধ্বংসস্তুপ আজও আছে এই কুসমুন্ডিতে। আর এখন এই গ্রামে প্রচুর মাছ চাষ হয়। প্রতিদিন ৪৫ লরিরও বেশি মাছ যায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে। এমনকি বিহারেও। এবার কুসমুন্ডি যেন কলকাতায় ফুটবলার সাপ্লাই করতে বদ্ধপরিকর।
এই ক্যাম্পে ফুটবলারের সংখ্যা ৮০। কোনও স্পনসর নেই। নিজের টাকা খরচ করে শিবশঙ্কর পাল একাই চালান এই ক্যাম্প। তাঁর সঙ্গে আছেন স্থানীয় মূদুল ব্যানার্জি, সুমিত বর্মন, সঞ্জিত রায়, নান্টু, বুম্বারা।
কুসমুন্ডির মতো এক অখ্যাত গ্রামে এই ক্যাম্প দেখে খুশি কোচ জহর দাস। তাঁর কথায়,”আমি এখানে না আসলে জানতেই পারতাম না যে এত ভাল একটা ফুটবল কোচিং ক্যাম্প আছে। বেশ কিছু ছেলেকে আমার খুব ভাল লেগেছে। ঠিক ভাবে এই ক্যাম্প চললে বেশ কিছু ফুটবলার উঠে আসবে আমি নিশ্চিত। এই জেলায় যাদের ফুটবল নিয়ে কাজ করার কথা সেই কাজ কুসমুন্ডি গ্রামের এই ছেলেরা করছে। সমস্যা হল, এদের টাকা নেই। শিবশঙ্করকে বলেছি, ক্যাম্পটাকে সুষ্ঠুভাবে চালাতে গেলে একটা ছোট স্পনসর জোগার করুন। আমি ওদের বলেছি কলকাতার ক্লাবে বেশ কিছু ছেলেদের খেলার সুযোগ করে দেব। জেলাতেই তো ফুটবলার আছে। এদেরকেই তো আমাদের তুলে ধরতে হবে।”
কুশমুন্ডি, গঙ্গারামপুর, বুনিয়াদপুর এই সব এলাকায় ক্রীড়া জগতে একতার অভাব। এই বিষয়ে দক্ষিণ দিনাজপুর ক্রীড়া সংস্থার প্রাক্তন সচিব গৌতম গোস্বামী এই জেলার ক্রীড়া সংস্থাগুলিকে এক ছাতার তলায় আনার খুব চেষ্টা করেছিলেন। তিনি জেলা ক্রীড়া সংস্থায় ২৪ বছর সচিব ছিলেন। গৌতম বাবুর কথায়,” আমি বহুবার চেষ্টা করেও পারিনি। বুনিয়াদপুর মানেনা গঙ্গারামপুরকে। আবার গঙ্গারামপুর পাত্তা দেয়না কুশমুন্ডিকে। গঙ্গারামপুর মহকুমার যতক্ষন না একটা পূর্ণাঙ্গ, সক্রিয় ক্রীড়া সংস্থায় পরিনত হচ্ছে ততদিন এমনই চলছে। আমি দায়িত্বে থাকার সময় বহুবার বলেছি। এক ছাতার তলায় আনতে পারিনি। কুশমুন্ডিতে যে এত ভাল কাজ হচ্ছে সেটা পূর্ণতা পাবে যদি সবাই এক হয়ে কাজ করে। ”