◆সন্দীপ দে◆
গত বছরেই ‘ভারত পেট্রোলিয়াম’ থেকে অবসর নিয়েছেন। তখন তিনি থাকতেন যোধপুরপার্কে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর শিকড়ের টানে ফিরে গিয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার হরিনাভির পৈতৃক বাড়িতে। তারপর থেকেই এক অনামি,অখ্যাত ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছেন নিজেকে। তিনি অমিত ভদ্র। ভারতের প্রাক্তন ফুটবলার। একটা সময় মোহনবাগান,ইস্টবেঙ্গলে চুটিয়ে খেলেছেন। সোনারপুর ইয়ং মেনস স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশন ক্লাবের হাত ধরে নিজের জেলা থেকে ফুটবলার তুলে আনার লক্ষ্যে অমিত ভদ্র।
অমিত ভদ্রর সঙ্গে আরও এক ভারতের প্রাক্তন গোলরক্ষক এই ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন,তিনি হলেন প্রতাপ ঘোষ। দুজনেরই লক্ষ্য নিজের জেলা থেকে বাঙালি ফুটবলার তুলে আনতে হবে। ফুটবলার তুলে আনতে গেলে ফুটবলারদের একটা ভাল প্লাটফর্মের প্রয়োজন। সেই প্লাট ফর্ম দিচ্ছে সোনারপুর ইয়ং মেনস স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশন। কারণ,এই ক্লাবটি কলকাতা লিগের তৃতীয় ডিভিশনে খেলে। জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে তুলে আনা ফুটবলাররা এই ক্লাবের হয়ে কলকাতার গড়ের মাঠে খেলার সুযোগ পাচ্ছে। এই মঞ্চটাকে সামনে রেখেই জেলা ফুটবলের সেই অতীতের সাপ্লাই লাইন ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা শুরু করে দিয়েছেন অমিত-প্রতাপ। অমিত ভদ্রর অনেক আগে থেকেই এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত প্রতাপ ঘোষ। এঁরা কখনও আত্মপ্রচার চায়নি। সেলিব্রিটির তকমা ঝেড়ে ফেলে সোনারপুরের বৈকুন্ঠপুর তরুণ সংঘের মাঠে আসেন,এলাকার তৃণমূল স্তরের ফুটবলার,অভিভাবকদের সঙ্গে মিশতে পারেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই ফুটবলার তুলে আনার জন্য সোনারপুর ইয়ং মেনস স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশন থেকে কোনও পারিশ্রমিক নিচ্ছেন না অমিত ভদ্র ও প্রতাপ ঘোষ। বরং নিজেদের সামর্থমত এই ক্লাবের ফুটবলারদের পাশে,ক্লাবের পাশে দাঁড়িয়েছেন ওঁরা। এই ক্লাবকে উৎসাহ দিতে এগিয়ে এসেছেন সোনারপুর এলাকার একাধিক প্রাক্তন ফুটবলাররা। শুক্রবার বিকেলে সোনারপুর ইয়ং মেনস স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশনের জার্সি উন্মোচনের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন সুভাষ রায়, সুখেন চক্রবর্তী,অশোক গুপ্ত,প্রদ্যোৎ বসু, ফরিদ আলি মোল্লারা। এত মানুষের ভিড় দেখে আপ্লুত ফুটবলাররাও। জানা গেল,এই জার্সি উন্মোচনের অনুষ্ঠানে সকল ফুটবলারদের সামিল করার পরিকল্পনা অমিত ভদ্রর।
অমিত ভদ্র ও প্রতাপ ঘোষ ছাড়াও এই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা থেকে উঠে এসেছেন মানস ভট্টাচার্য, কৃষ্ণেন্দু রায়,অতনু ভট্টাচার্য,গৌরাঙ্গ ব্যানার্জি, রূপক চৌধুরী, মেহেতাব হোসেন, অমিত দাস,চন্দন দাস, প্রশান্ত চক্রবর্তী, মতো ফুটবলাররা। কিন্তু সেই ভাবে এই জেলা থেকে আগের মতো ফুটবলার উঠে আসছে না।
অমিত ভদ্র বলছিলেন,”সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই বদলে যায়। আমাদের সময়ে হয়তো ফুটবল উন্মাদনা বেশি ছিল। কিন্তু এখনও ছোট ছোট ছেলেরা বিকেলে মাঠে ফুটবল খেলতে আসে। আমরা এখন প্রাক্তন। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। আমরাও পাড়ার দাদা-কাকাদের হাত ধরে মাঠে এসেছি। তাঁদের স্নেহ,ভালবাসা,শাসনের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছি। আমি এই জেলা থেকে উঠে এসেছি। একজন প্রাক্তন ফুটবলার হিসেবে নতুন ফুটবলার তুলে আনাটাও আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
এই জেলায় ফুটবল নিয়ে আগ্রহ শেষ হয়নি। এই জেলা থেকে এবার তিনটি ক্লাব কলকাতা ফুটবল লিগে অংশ নিচ্ছে। সোনারপুর ইয়ং মেনস স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশন, জ্যোতির্ময়ী এবং ডায়মন্ড হারবার এফসি। শুধু এই জেলা থেকে প্রায় ৮০ জন ফুটবলার গড়ের মাঠে খেলার সুযোগ পাচ্ছে। এটা খুবই ইতিবাচক দিক। শুধু প্রাক্তনরা নয়, এলাকার সকল ক্রীড়াপ্রেমীরা নিঃস্বার্থ ভাবে যদি এগিয়ে আসেন তাহলে আগামী দিনে এই জেলা থেকে ভাল ফুটবলার উঠে আসবেই।”
প্রতাপ ঘোষ বলছিলেন,”আমি এই ক্লাবে কয়েক বছর ধরে যুক্ত আছি। সবাই এগিয়ে এলে ভাল কিছু হবে। এবার আমরা গড়িয়া থেকে ক্যানিং,নামখানা এলাকার ছেলেদের নিয়ে দল গড়েছি। লক্ষ্য দ্বিতীয় ডিভিশনে ওঠা।” এই অমিত ভদ্র,প্রতাপ ঘোষরা নাম করা কোনও ক্লাব বা অ্যাসোসিয়েশনের ভাল পদের মোহে না ছুটে গ্রামীণ ফুটবলের পিছনে ছুটছেন। যা জেলা ফুটবলে ভাল বিজ্ঞাপন।
জ্যোতির্ময়ী ক্লাবের কর্ণধার আইএফএ-এর সদ্য প্রাক্তন সহ-সভাপতি পার্থসারথী গাঙ্গুলি। তিনি ২০১৮ সাল থেকে সোনারপুর ইয়ং মেনস স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশনকেও স্পনসর করে আসছেন। তিনি সোনারপুর ইয়ং মেনসের সভাপতি। এই দুটি দলই কলকাতা লিগের তৃতীয় ডিভিশনে খেলবে। একই ডিভিশনে দুটি দলই তাঁর। এ যেন – “দো ফুল,এক মালি”।
ইয়ং মেনস স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশন ক্লাবটি আগে ছিল রবি কর্মকারের ক্লাব। ৬ বছর আগে এই ক্লাবের ঠিকানা ছিল কলকাতায়। খেলত দ্বিতীয় ডিভিশনে। ২০১৭ সালে রবি কর্মকারের থেকে হাত বদল হয়ে ক্লাবটির পুরো দায়িত্ব নিয়েছেন সোনারপুরের প্রাক্তন ফুটবলার শঙ্কর বসু। ক্লাবটি নেওয়ার পর আগে ‘সোনারপুর’ শব্দটি ব্যবহার করা শুরু। শঙ্কর বসু যখন (২০১৭) ক্লাবটি নিলেন তখন লিগ শুরুর মুখে। ভাল দল গড়তে না পারার জন্য তৃতীয় ডিভিশনে নেমে যায়। পরের বছর টাকা নেই অথচ দল গড়তে হবে। ঠিক সেই সময় কালিকাপুরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী পার্থসারথী গাঙ্গুলি এগিয়ে আসেন।
সোনারপুর ইয়ং মেনসের সচিব শঙ্কর বসু বলছিলেন,”আমাদের এই অখ্যাত ক্লাবের ফুটবলারদের পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রতাপ ঘোষ,অমিত ভদ্র। তাঁদের পরামর্শে আমরা উপকৃত হচ্ছি প্রতিনিয়ত। আমাদের জার্সি উন্মোচন অনুষ্ঠানে এলাকার প্রাক্তন ফুটবলাররা যেভাবে হাজির থেকে ফুটবলারদের উৎসাহ দিয়ে গেলেন তাতে আমাদের মনের জোর আরও বেড়ে গেল। কোচ সুজিত কর্মকার ও ফুটবল সচিব দেবাশিস মন্ডল এবং ম্যানেজার স্বপন বসু যেভাবে দলটাকে আগলে রাখে তার কোনও প্রশংসায় যথেষ্ট নয়। আর পার্থদা আছেন বলে এখনও দলটা গড়তে পারছি। আমাদের একটাই লক্ষ্য দ্বিতীয় ডিভিশনে ওঠা।”