ইনসাইড স্পোর্টসের প্রতিবেদন : প্রয়াত ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রাক্তন সফল ফুটবল সচিব অজয় শ্রীমানী। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। ১৯৭০ থেকে১৯৭৫ সালকেই ইস্টবেঙ্গলের স্বর্ণযুগ বলা হয়। সেই সময়কালে ইস্টবেঙ্গল ছিল অপ্রতিরোধ্য। টানা পাঁচবার লিগ জিতেছিল ইস্টবেঙ্গল। তাঁর জমানাতেই মোহনবাগানকে ৫ গোল দিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। যা আজও রেকর্ড হয়ে আছে। অজয় শ্রীমানীর প্রয়ানে গড়ের মাঠে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া।
তিনি চলে গেলেন একবুক যন্ত্রণা নিয়েই। যে ক্লাবকে ভালবেসে নিজের মন্দির ভাবতেন,সেই ক্লাব তাঁকে নাকি ভুলেই গিয়েছিল। এই যন্ত্রণার কথা প্রায়সই বলতেন অজয় শ্রীমানী। করোনার আগে,২০১৯ সালে ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে এক সাক্ষাৎকারে অজয় বাবু বলেছিলেন,”তুমি কি জানো আমি ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের সদস্য।” এই প্রতিবেদক তখন দুই প্রধান ক্লাবের তাঁর দুটি মেম্বার কার্ডের ছবি তোলার অনুরোধ করেছিল। উত্তরে অজয়বাবু ‘ইনসাইড স্পোর্টস’ বলেছিলেন,”আমি মোহনবাগানের কার্ডটি দেখাতে পারি। কারণ,এখনও আমি মোহনবাগানের কার্ড রিনিউ করি। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের কার্ডটি কাছে রাখিনি। রাখতে চাইনি। ইস্টবেঙ্গল কর্তারা আমায় আজীবন সদস্যপদ দিয়েছিল। সেই কার্ডের ভিতরে একটা ১৫ হাজার টাকার রিসিট রেখে দিয়েছিল। এত অপমান সহ্য করতে পারিনি। এই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব করতে গিয়ে আমার তিনটি বাড়ি চলে গিয়েছে, আর ওরা আমার কাছে টাকা চেয়ে আজীবন সদস্যপদ দিচ্ছে! সেই ঘটনা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল। আর ক্লাবে যেতাম না। আরও অনেক ঘটনা আছে।
পরে আমার ছেলে বলেছিল সব ঘটনা, ক্ষোভ মিডিয়ায় খুলে বলতে। কিন্তু তখন বলিনি। সব কথা বলে আমার ইস্টবেঙ্গলকেই ছোট করা হবে। নিজের মাকে ছোট করতে পারব না।”
অজয় শ্রীমানী হলেন উত্তর কলকাতার বনেদী পরিবারের ছেলে। মানিকতলার কাছে সুকিয়া স্ট্রিটে শ্রীমানী মার্কেট সবার জানা। ১৯৪৯ সালে ১৬ বছর বয়সে ইস্টবেঙ্গলের সদস্য হয়েছিলেন। সেই বছর ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের বার পুজোর অনুষ্ঠানের শেষে একজন অজয়বাবুকে বলেছিলেন,জ্যোতিষ গুহ তাঁকে ডাকছে। ডাক পেয়ে তাঁর কাছে যেতেই জ্যোতিষ গুহ বলেছিলেন,’এই ছেলে,ক্লাব করবে? যদি করো তাহলে মায়ের অনুমতি নিয়ে এসো।’ পরের দিন মায়ের অনুমতি নিয়ে ইস্টবেঙ্গলের সাব কমিটিতে যোগ দিয়েছিলেন অজয় শ্রীমানী। সুধীর কর্মকার, মহম্মদ হাবিব থেকে গৌতম সরকার, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, সুভাষ ভৌমিক – সকল ফুটবলারের খুব প্রিয় কর্তা ছিলেন অজয়বাবু। মোহনবাগানকে পাঁচ গোল দেওয়ার পর নিজেদের বাড়ির দুর্গা পুজোয় দলের ফুটবলারদের সোনার আঙটি উপহার দিয়েছিলেন অজয় শ্রীমানী।
২০১৯ সালেই অজয়বাবু ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে বলেছিলেন,”আমি এপার বাংলার ছেলে। জ্যোতিষদা চেয়েছিলেন আমি ইস্টবেঙ্গলেই যেন কাজ করি। একবার একটি চিঠি নিয়ে মোহনবাগান ক্লাবে গিয়েছিলাম। চিঠিটা ধীরেনদাকে দিতে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখে উনি বলে উঠলেন,’তুমিই শ্রীমানী? ঘটি হয়ে শেষে ইস্টবেঙ্গলে মন দিয়ে দিলে? মোহনবাগানে চলে এসো। আজই মোহনবাগান সদস্যপদ নিয়ে যাও।” আমাকে সেই দিনই ধীরেনদা মোহনবাগানের সদস্য কার্ড দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি ইস্টবেঙ্গল ছাড়তে পারিনি।”
তাঁর ক্রীড়া সংগঠনের জীবনে আরও একটা ঘটনা প্রতিনিয়ত কষ্ট দিয়ে এসেছে। অজয়বাবুই জানিয়েছিলেন,তাঁর সচিব থাকাকালীন সুরজিৎকে সই করানো নিয়ে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। সেই ভুল বোঝাবুঝিতেই ইস্টবেঙ্গলের একটি ছেলে শৈলেন মান্নার নামে থানায় এফআইআর করেছিলেন। কিংবদন্তি শৈলেন মান্নার নামে এফআইআর করা মানতে পারেননি শ্রীমানী। পরে মান্নার কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন অজয়বাবু।
দেড় মাস আগে আইএফএ অজয় শ্রীমানীকে বিশেষ সম্মান দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আইএফএ-এর সেই আমন্ত্রণ পত্র গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি। ইদানিং বাড়ির বাইরে বেড়োতেন না। ছেলে-বৌমা,নাতিদের নিয়েই সময় কাটতো তাঁর। অভিমানে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ছেড়ে দিয়েছিলেন ঠিকই তবে ক্লাবটার প্রতি তাঁর ভালবাসায় কোনও খাদ ছিল না। বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবল এক বরেণ্য কর্তাকে হারাল।