সন্দীপ দে ▪ কালিয়াগঞ্জ
২০০৮ সালের দুর্গাপুজোর নবমীর রাত। কালিয়াগঞ্জের নিজেদের আদি বাড়িতে সেই দিন বেশ আনন্দেই কাটাচ্ছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। কিন্তু রাতে হঠাৎই গুরুতর অসুস্থ হন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের উদ্যোগে বিশেষ বিমানে করে দিল্লির এইমসে ভর্তি করানো হয়। তারপর? ৯ বছর কোমায় থাকার পর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর।
দক্ষিণ দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে নিজেদের আদি বাড়িতে ২০০৮ এর অক্টোবরই শেষ যাওয়া ছিল প্রিয়র। তারপর থেকে কালিয়াগঞ্জের এই সুন্দর দোতলা বাড়িটায় শুধুই শূন্যতা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রিয়র ছেলেবেলা কালিয়াগঞ্জের এই বাড়িতে কাটলেও তাঁর জন্ম হয়েছিল বর্তমান বাংলাদেশের চিরিরবন্দর উপজেলায়। পরে তাঁর বাবা পরিবার নিয়ে কালিয়াগঞ্জে চলে আসেন এই বাড়িতে।
প্রিয়বাবুর বাড়ি ঘুরে আসব তা ঠিকই করেছিলাম কুশমন্ডি পৌঁছনোর পর। শুক্রবার সকালে ‘ইনসাইড স্পোর্টসে’র এই সাংবাদিককে বাইকে করে প্রিয় বাবুর বাড়ি পৌঁছে দিলেন কালিয়াগঞ্জের ফুটবল কোচিং ক্যাম্পের কোচ তরুণ গুহ।
বিশাল দোতলা বাড়ি। প্রমাণ সাইজের গেট খুলে ঢুকলেই বাঁদিকে দুর্গা ঠাকুরের মন্ডপস্থল। সামনে বারান্দা। তার ঠিক পিছনেই প্রিয়র ড্রয়িং রুম। যে চেয়ার ও টেবল ব্যবহার করতেন সেটা রাখা আছে। আর প্রিয়র দুদুটি বাঁধানো ফটো। একটি ছবিতে বহুদিনের শুকনো ফুলের মালা ঝুলছে। ঘরের এক কোনে একটি ফুটবল ট্রফি। প্রিয় বাড়ি থাকলে এই ঘরেই নাকি তিল ধরার জায়গা থাকতো না।
কালিয়াগঞ্জের তাঁর এই আদি বাড়িতে এলে স্ত্রী দীপা ও পুত্র মিছিলকে নিয়ে রাত কাটাতেন দোতলায়। এই বেডরুমেই আছে ফুটবলের নানান স্মৃতি। এখন তালা বন্ধ। বাড়ির কেয়ারটেকারের খোলার অনুমতি নেই। দীপা এলে তবেই খোলা হয়। জানা গেল, প্রিয়র ফুটবল জগতের কত সব স্মৃতি আছে ওই তালা বন্ধ দোতলা ঘরে।
রায়গঞ্জ কলেজে ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি শুরু। কালিয়াগঞ্জ ও রায়গঞ্জ ছিল তাঁর শৈশব ও যুবককালের এক স্বরণীয় অধ্যায়। পরবর্তীকালে তিনিই হলেন বাংলা তথা ভারতীয় রাজনীতির এক উজ্জ্বল চরিত্র। তারও পরে, ১৯৮৯ সালে অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের (এআইএফএফ) তৎকালীন কর্তা জিয়াউদ্দিনের জায়গায় এসেছিলেন প্রিয়। পরবর্তীকালে টানা ২০ বছর এআইএফএফের সভাপতি ছিলেন। ভারতীয় ফুটবলের প্রশাসনিক দিকপাল হয়ে উঠেছিলেন।
তাঁদের ‘প্রিয়দা’কে নিয়ে গর্বের শেষ নেই কালিয়াগঞ্জ ও রায়গঞ্জের ক্রীড়াপ্রেমিদের। এই দুটি জায়গা ঘুরে, ক্রীড়া প্রেমি ও প্রাক্তন ফুটবলারদের সঙ্গে কথা বলে বেড়িয়ে এল আক্ষেপ ও গর্ব।
আক্ষেপটা কি? প্রিয় ২০ বছর এআইএফএফ সভাপতি থাকলেন। ফিফা প্রেসিডেন্ট ব্লাটারেরর সঙ্গে এত ভাল সম্পর্ক তবু কালিয়াগঞ্জ ও রায়গঞ্জের খেলা নিয়ে কিছুই করে যাননি। কালিয়াগঞ্জের একদা বিখ্যাত ফুটবলার (একটা সময় জর্জ টেলিগ্রাফের হয়ে খেলেছেন) প্রণব দাস ইনসাইড স্পোর্টসকে বলছিলেন,”প্রিয়দা আমাদের গর্ব। ওঁর কাছে একটা স্টেডিয়াম করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু করেননি। খারাপ লাগে। আক্ষেপ হয়।” ভারতীয় ফুটবলের এক নম্বর লোক হয়েও কালিয়াগঞ্জ ব্রাত্যই থেকে গিয়েছে।
তৃনমূল পরিচালিত রায়গঞ্জ পুরসভা সম্প্রতি রায়গঞ্জ শহরের শিলিগুড়ি মোড়ে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির মুর্তি বসানো হয়েছে। এটা রাজনৈতিক নেতাদের উদ্যোগ। কিন্তু এই জেলার কোনও ক্রীড়া সংস্থা বা কর্তা অতীতে প্রয়াত প্রিয়বাবুকে নিয়ে কোনও উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। এবার সেটাঈ করতে চলেছে রায়গঞ্জের টাউন ক্লাব। এই ক্লাব প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিকে অন্যভাবে দেখে। টাউন ক্লাবের সচিব অরিজিৎ ঘোষ ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে জানালেন,” প্রিয়দা আমাদের গর্ব। আমরা ফুটবল নিয়েই থাকি। আমরা প্রিয়দার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কালিয়াগঞ্জের বাড়িটাকে মিউজিয়াম করার উদ্যোগ নিচ্ছি। এই ব্যাপারে দীপা বৌদির অনুমতির প্রয়োজন। আমরা খুব শীঘ্রই দীপা বৌদির কাছে আমাদের উদ্যোগের কথা জানাব। আমাদের খুব ইচ্ছে এআইএফএফের সভাপতি প্রফুল প্যাটেল, সচিব কুশল দাস ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সুব্রত দত্ত এবং অবশ্যই দীপা বৌদির উপস্থিতিতে প্রিয়দাকে নিয়ে মিউজিয়াম উদ্বোধন করা। আমরা সবাই মিউজিয়ামের অপেক্ষায় আছি।”
প্রিয়বাবুর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য টাউন ক্লাবের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেন এআইএফএফের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সুব্রত দত্ত। ফোনে সুব্রত দত্ত ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে জানান,”প্রিয়দার নামে যদি একটা মিউজিয়াম হয় তাহলে ওনাকে যথাযথ সম্মান জানানো হবে। কালিয়াগঞ্জ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হবে। এতে কালিয়াগঞ্জ আলাদা গুরুত্ব পাবে এবং প্রিয়দার স্মৃতি রক্ষাও হবে। ফুটবল প্রশাসক হিসেবে প্রিয়দা বেঁচে থাকবে এই মিউজিয়ামের মধ্যে দিয়ে। এমন উদ্যোগ নেওয়ার জন্য রায়গঞ্জের টাউন ক্লাবকে সাধুবাদ জানাই।”