◆সন্দীপ দে◆
সবার সমর্থন নিয়ে অবশেষে IFA-এর কোষাধ্যক্ষ পদে এলেন অনির্বান দত্ত (জয়)। আজ,মঙ্গলবার IFA-এর গভর্নিং বডির সভায় সর্বসম্মত ভাবে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে অনির্বান দত্তকেই বেছে নিলেন কমিটির সদস্যরা। বাংলা ফুটবলের কিংবদন্তি প্রশাসক প্রয়াত প্রদ্যোৎ দত্তর জৈষ্ঠ পুত্র জয় ওরফে অনির্বান। ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে মৃত্যু হয়েছিল প্রদ্যোৎবাবুর। এখন ২০২২ সাল। দীর্ঘ ২৭ বছর পর প্রদ্যোৎ দত্তর পরিবার থেকে কোনও সদস্য IFA -এর কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে বসলেন।
অনির্বানের এই কোষাধ্যক্ষ পদে আসার পথটা মসৃণ ছিল না। যারা ভেবেছিলেন ময়দানের ‘দত্ত পরিবার’-এর ছেলে হওয়ার সুবাদে অনির্বান লাল কার্পেটের উপর হেঁটে IFA-তে ঢুকবেন তাঁরা ভুল ভেবেছিলেন। বরং উল্টো হয়েছে। লাল কার্পেটের বদলে অনির্বানের রাস্তায় বিছানো ছিল শুধুই কাঁটা।
পাঁচ মাস আগে কোষাধ্যক্ষ কৃষ্ণেন্দু ব্যানার্জির মৃত্যুর পর সেই জায়গায় আসতে চেয়ে দাদা সুব্রত দত্ত ও সচিব জয়দীপ মুখার্জির কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন অনির্বান। দাদা সুব্রত দত্ত ভাই অনির্বানকে পরিস্কার বলে দিয়েছিলেন,”তোর জন্য আমি ভোট চাইতে পারব না। ক্লাব যদি তোকে চায় তাহলে আসবি”। অর্থাৎ অনির্বানের শুরু থেকেই ‘একলা চলো রে’। জয়দীপ অনির্বানে আতঙ্কিত। তিনি কোষাধ্যক্ষের পদে দেখতে চেয়েছিলেন সহসভাপতি পার্থসারথী গাঙ্গুলিকে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। পরে জয়দীপের সমর্থনে কোষাধ্যক্ষ পদের লড়াইয়ে নেমে পড়লেন হাওড়ার রবীন ঘোষ (ময়দানের অভিজ্ঞ কর্তা)। অনির্বানকে আটকাতে রবীন ঘোষই ছিল জয়দীপের ঘোড়া। ময়দান জানে এসব কথা।
এই পরিস্থিতিতে বেশি সমস্যায় পড়ে গেলেন সুব্রত দত্ত। তিনি কাকে সমর্থন করবেন? জয় নাকি জয়দীপকে? একদিকে নিজের কাকার ছেলে ভাই অনির্বান,অন্যদিকে জয়দীপকে তিনিই সচিবের চেয়ারে বসিয়েছেন। ভাইকে সমর্থন করলে প্রশ্ন উঠবে ময়দানে। তাই দাদার সমর্থন পেলেন না। চার মাস আগে এই উটকো সাংবাদিককে সুব্রত দত্ত বলেছিলেন,”কোষাধ্যক্ষ পদে কে আসবে জানি না। তবে ভোট হতে দেব না। ভোট হলে দলের উপর প্রভাব পড়ে।” ময়দানের রাজনীতির অঙ্ক তখন জটিল আকার ধারণ করেছে। অনির্বানকে আটকাতে এত মরণপন লড়াই কেন? অনির্বান পদে বসলে আইএফএ-এর ক্ষতি হবে? নাকি কোনও ব্যক্তির ক্ষতি হবে? তাহলে কি আটের দশকের শেষ দিকে ময়দানের সেই বিখ্যাত লড়াই “দত্ত ভার্সেস দত্ত” ফিরে আসছে? এমন হাজারো প্রশ্ন।
অনির্বানকে, জয়দীপ আটকাতে চেয়ে পারলেন না। আর সুব্রত দত্ত যেটা চেয়েছিলেন সেটাই হল – ভোট করতে দিলেন না। অর্থাৎ ইলেকশন নয়, সিলেকশন।
সত্যি কথা বলতে, অনির্বান ‘দত্ত পরিবার’-এর প্রভাব না খাটিয়ে নিজের পরিশ্রম, নিষ্ঠা,সততা,কঠিন লড়াই করে IFA -এর থিঙ্ক ট্যাঙ্ককে বাধ্য করাতে পেরেছেন। গত পাঁচ মাসে সকাল থেকে রাত পযর্ন্ত ক্লাবে ক্লাবে ঘুরেছেন। সমর্থনের আশায়। ছোট,বড় সব ক্লাবে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন। জয়দীপ যেখানে ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’-এর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন, সেখানে অনির্বান ময়দানের তৃণমূল স্তরে নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন। এই ব্যাপারে অনির্বান বলছিলেন,”আমি বিশ্বাস করি ক্লাবই শেষ কথা। আমি ৩৬৫ দিন সমস্ত ক্লাব জেলার সঙ্গে থাকতে চেয়েছি। ভবিষ্যতেও থাকব। বিশ্বাস যোগ্যতা তৈরি করতে হবে। ক্লাব যদি আমাকে যোগ্য মনে করে আমাকেই রাখবে। মাঠ করব আর মাঠের লোকের সঙ্গে থাকবো না এটা হতে পারে না। সুষ্ঠুভাবে,নিয়ম মেনে ভোট হোক। তাতে যদি আমি হারি তাহলে মেনে নেব। হারতে হারতেই একদিন জিতব। তবে ময়দানের আসরে যখন নেমে পড়েছি হারলেও পালিয়ে যাব না।”
গুরুত্বপূর্ণ কোষাধ্যক্ষ পদে অনির্বানকে বসতে না দেওয়ার জন্য জয়দীপরা কি কি পদক্ষেপ করেছিলেন? তার নমুনা এই রকম -১) অনির্বানকে সহ সভাপতি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অনির্বান।
২) রবীন ঘোষকে অনির্বানের বিরুদ্বে লড়াইয়ে নামিয়ে দেওয়া।
৩) সংবিধান লঙ্ঘন করে এক মাসের মধ্যে কোষাধ্যক্ষ পদের নির্বাচন না করে ঝুলিয়ে রাখা।
৪) বর্তমান গভর্নিংবডির সদস্যদের মধ্যে অধিকাংশই অনির্বানকে সমর্থন করে বসে আছে। যদি ভোট হত তাহলে একটি ভোট হলেও অনির্বানের জয় নিশ্চিত ছিল। পাশাপাশি ‘থিঙ্কট্যাঙ্কের’ দল ভাঙতে শুরু হয়ে গেল। তাই বর্তমান গভর্নিং বডির সদস্যদের দিয়ে কোষাধ্যক্ষ নির্বাচন না করিয়ে নতুন গভর্নিং বডির সদস্যদের দিয়ে নির্বাচন করার পরিকল্পনা করা হয়। যা একেবারেই অবৈধ ছিল।
এই তথ্যগুলি পৌঁছে গিয়েছিল অনির্বান দত্তর শিবিরে। ঠিক সেই সময় কয়েকজন গভর্নিং বডির সদস্য সচিব জয়দীপকে চিঠি দিয়ে অবিলম্বে কোষাধ্যক্ষ পদের নির্বাচন করার আবেদন করলেন। পাশাপাপাশি সংবিধান না মেনে নির্বাচন করার বিরোধীতা করে আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেললেন অনির্বান দত্ত। এত অন্যায়ের মোকাবেলা করার জন্য আদালতই শেষ অস্ত্র ছিল তার। পাশাপাশি হঠাৎ কোষাধক্ষের লড়াই থেকে সরে দাঁড়ালেন রবীন ঘোষ। একদিকে আদালত অন্যদিকে রবীনের সরে দাঁড়ানো সব মিলিয়ে চাপে পড়ে যায় জয়দীপরা। ঠিক সেই সময় সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন চেয়ে পর পর দুটি চিঠি জমা পড়ে IFA-তে। একজন বিশ্বরূপ দে দ্বিতীয়জন অজিত ব্যানার্জি। যিনি আবার আইএফএ-এর সভাপতি।
অজিত ব্যানার্জি, আসরে অনেক পড়ে নেমেই পাশার দান উল্টে দিলেন। অজিতবাবু কোনও বিতর্কের মধ্যে থাকতে পছন্দ করেন না। কিন্তু এই ইস্যুতে অনির্বান দত্তকে সম্পূর্ণ ভাবে সমর্থন করলেন। একটা সময় ফিনান্স কমিটি থেকে অনির্বানকে সরিয়ে দিয়েছিলেন জয়দীপরা। একবছর আগে (যখন জয়দীপ পদত্যাগ করে আইএফএ আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন) আইফএ অফিসে নিজের চেম্বারে বসে এক আড্ডায় সেই বিষয়ে এই সাংবাদিক অজিতবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিল, প্রদ্যোৎ দত্তর ছেলে অনির্বানকে সরিয়ে দেওয়া হল? আফটার অল তিনি প্রদ্যোৎ দত্তর ছেলে। কাজের ছেলে। কথাটা শুনে অজিতবাবু সেদিন বলেছিলেন,”সন্দীপ,তোমার কথাটা মানতে পারলাম না। প্রদ্যোৎ দত্তর ছেলে বলে অনির্বানের যোগ্যতাকে তুমি ছোটো করলে। আমি জানি অনির্বান ময়দানে অনেকের থেকে বেশি কাজের ছেলে,যোগ্য। কোনওদিন সুযোগ এলে অনির্বানকে যোগ্য পদে আনার চেষ্টা করব।” মোক্ষম সময়ে সেই সুযোগ এসে গেল।
জয়দীপ মুখার্জি আরএকটা ভুল ‘খেলা’ খেলেছেন। হয়তো জয়দীপবাবু বুঝতে পারেননি। সেটা হল ওয়েস্টবেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস ফেডারেশন সভাপতি তনুময় বসুকে দিয়ে জেলার ভোট নিজের দিকে টানতে পারবেন। সেটা হয়নি কারণ,২২ জেলার মধ্যে ১৭ জেলায় তনুময়ের ভাবমূর্তি খুব খারাপ। অধিকাংশ জেলার প্রতিনিধিরা তনুময়কে চায় না। এই তথ্য জয়দীপবাবু কেন আগাম পেলেন না সেটা বোঝা গেল না। অন্যদিকে, জেলার অন্যতম অভিজ্ঞ ক্রীড়া সংগঠক ও সিএবির অ্যাপেক্স কাউন্সিল মেম্বার গৌতম গোস্বামী শুরু থেকেই অনির্বানকে সমর্থন করে গিয়েছেন। গৌতমবাবু কলকাতায় এসে প্রকাশ্যে বলেছিলেন,”ময়দানের নতুন নেতা অনির্বান দত্ত।” সব মিলিয়ে এত প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হল যে, আইএফএ-এর থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অনির্বানকেই মেনে নিতে বাধ্য হল। জয়কে (অনির্বান) মেনে নিলেন জয়দীপও। যদিও মেনে নেওয়ার আগে জয়দীপ,তাঁর মাঠের ‘গডফাদার’-এর কাছে বলেছিলেন,”আমাকে ছেড়ে দিন। আর আইএফএ থাকতে চাই না।” উত্তরে তাঁর ‘গডফাদার’ (সুব্রত দত্ত) বলেছিলেন,”টার্ম শেষ না করে চলে যেও না।” এই কথাগুলি “ইনসাইড স্পোর্টস”-কে গতকাল (সোমবার) জয়দীপ নিজেই বলছিলেন। এখন প্রশ্ন, জল আর তেল একসঙ্গে মিশবে কি করে? জয়দীপ বলছিলেন,”সন্দীপ, আমার সঙ্গে জয়দার কোনও সমস্যা হবে না। ২০২৩ আমি চলে যাব। তার আগে যতদিন জয়দার সঙ্গে কাজ করব কোনও সমস্যা হবে না। জল আর তেল থাকবে না। সবটাই জল থাকবে।”(বলেই হাসতে থাকলেন)।
জয়দীপ শুরু থেকেই তাঁর মাঠের গডফাদার ‘বাপীদা’কে সঙ্গে পেয়েছিলেন। আর অনির্বানের পাশে শুরুতে হেবিওয়েট কেউই ছিলেন না। শুরু থেকে একজনই ছিলেন,তিনি হলেন অলোকেশ কুন্ডু। ময়দানের আলো। জয়ের সমর্থন পেতে গতপাঁচ মাস আলোকেশবাবু ছুটে গিয়েছেন পাগলের মতো। ময়দানের ভোট বাজারের ‘অন্ধকার গলিতে’ জয়কে আলো দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে এই অলোকেশ কুন্ডুই। অনির্বান দত্তর জন্য ক্লাবের দ্বারে দ্বারে ঘুড়েছেন। দিন-রাত এক করে দিয়েছিলেন। কেউ কেউ তা দেখে টিপ্পনি কেটে বলেছিলেন, ময়দানে আলোর জমানা শেষ। অলোকেশ আজ আর একবার প্রমাণ করলেন,ময়দানে ‘আলো’ এখনও নিভে যায়নি। আগের মতোই জ্বলছে। আজ অনির্বানকে যে ভোটের মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছেন তাঁর নাম অলোকেশ কূন্ডু তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
পাশাপাশি অলোকেশ কৃতজ্ঞতাবোধটাও বুঝিয়ে দিলেন। অনেকেই অতীত ভুলে যান। কিন্তু তিনি অতীত ভোলেননি। ময়দানে রাতের আড্ডা শেষ করে বাড়ি যাওয়ার আগে অলোকেশের একাধিক ঠাকুর নমস্কার করবেনই। হাত-মুখ ধুয়েপ্রায় আধ ঘন্টাধরে ঠাকুর নমস্কার করে তবে ময়দান ছাড়েন। কিন্তু একেবারে শেষে যার ছবির সামনে হাতজোড় করে নমস্কার করেন সেই ছবিটি হল প্রয়াত প্রদ্যোৎ দত্তর। জর্জ টেলিগ্রাফের ক্লাব তাঁবুতে বহু রাতে এই উটকো সাংবাদিক নিজে কয়েকবার দুর থেকে লক্ষ্য করেছে যে, প্রদ্যোৎ বাবুর ছবির সামনে অলোকেশ কুন্ডু জোড় হাত করে দাঁড়িয়ে নমস্কার করছেন আর বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন। এমন দৃশ্য ময়দান দেখেছে কিনা জানা নেই। যার জন্য ময়দানে ‘আলো’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন,তাঁর সেই গুরু,ঈশ্বর প্রয়াত প্রদ্যোৎ দত্তকে আজ যেন গুরুদক্ষিণা দিলেন আলো।