প্রদ‍্যোৎ দত্তর স্বপ্নের কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম ধ্বংসের পথে

0

◆সন্দীপ দে ▪ শিলিগুড়ি◆

২৪ সেপ্টেম্বরঃ যখন জেলায় জেলায় নতুন নতুন স্টেডিয়াম গড়ে উঠছে তখন শিলিগুড়ির বিখ‍্যাত কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আজ থেকে ৩৭ বছর আগে নেহেরু কাপকে সামনে রেখে অনেকের সাহায‍্য নিয়ে স্বপ্নের স্টেডিয়াম গড়ে তুলেছিলেন তৎকালীন আইএফএ সচিব প্রদ‍্যোৎ দত্ত। নেহেরু কাপ থেকে ফেডারেশন কাপ,রনজি ট্রফি সহ কত বড় মাপের টুর্নামেন্ট হয়েছে শিলিগুড়ির এই কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গনে। এখন সেই কঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম ধ্বংসের পথে।

গত তিন দিন ধরে শিলিগুড়ি ঘুরে ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-এর কাছে উঠে এল একাধিক তথ‍্য। কি অবস্থায় আছে শিলিগুড়ি তথা বাংলার গর্বের কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম? তার নমুনা এই রকম —
(১) একদা আন্তর্জাতিক মানের এই ফুটবল স্টেডিয়াম কয়েক বছর ধরে জরাজীর্ণ অবস্থা। পরিচর্যার অভাবে ড্রেসিং রুম, গ্যালারি সর্বত্রই বেহাল দশা। বহু স্টেডিয়ামের বহু দেওয়াল, ছাদের চাঙর ভেঙে পড়ছে। পিলার ক্ষয়ে গিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে লোহার সিক। ভিত নড়বড়ে। গ‍্যালারির নিচে যে সমস্ত ক্রীড়া সংস্থার অফিস ঘর আছে,বর্সার সময় সেই সব ঘরে টপটপ করে জল পড়ে।

(২) এতদিন যারা স্টেডিয়ামের দায়িত্বে ছিল সেই স্টেডিয়াম কমিটির সদস‍্যরা কোনও কাজই করেননি। এই স্টেডিয়ামে বছরে ৯ থেকে ১০টা মেলা হয়। আর এই মেলা থেকে প্রচুর টাকা স্টেডিয়ামের তহবিলে ঢোকে। স্টেডিয়াম কমিটির কর্তারা বছরের পর বছর ধরে স্টেডিয়ামের কোনও যত্নই নেয়নি। কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গনের এই বেহাল অবস্থার অন‍্যতম কারণ হল,স্টেডিয়াম কমিটির সদস‍্যদের চরম উদাসীনতা। একটি বিশেষ সূত্র থেকে জানা গেল, গত বছর যখন কর্পোরেশনকে স্টেডিয়াম কমিটির দায়িত্ব তুলে দেয় তখন দেখা যায় সেই কমিটির তহবিলে ছিল প্রায় ৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ রেভিনিউ সত্বেও স্টেডিয়ামের যত্ন করেনি।

(৩) এই স্টেডিয়ামের দায়িত্ব ছিল সোসাইটি অ‍্যাক্টের মধ‍্যে রেখে স্টেডিয়াম কমিটির হাতে। এই কমিটিতে ছিলেন ডিএম,এসডিও,মেয়র,ফোসিনের প্রতিনিধি,বিধায়ক,সাংসদ এবং শিলিগুড়ি মহকুমা ক্রীড়া পরিষদের সচিব। গত বছর থেকে স্টেডিয়ামের দায়িত্ব যায় শিলিগুড়ি পুরনিগমের কাছে।

(৪) স্টেডিয়ামে চূড়ান্ত অব‍্যবস্থা ছাড়াও ডার্বির মত গুরুত্বপূর্ণ ম‍্যাচ করলে স্টেডিয়াম সংলগ্ন একাধিক রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বাম জমানায় যখন এই স্টেডিয়াম তৈরি (১৯৮৫) হয় তখন কার পার্কিংয়ের কোনও ব‍্যবস্থায় রাখেনি। বানিজ‍্যিক শহর শিলিগুড়িতে প্রত‍্যেক দিন কয়েক লক্ষ মানুষ বাইরে থেকে আসেন। লোকসংখ‍‍্যা বেড়ে যাওয়ায় আরও সমস‍্যা। নতুন রাস্তা করার জায়গা নেই। ফলে ডার্বি ম‍্যাচ হলে দর্শকদের চাপে রাস্তাগুলো কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

(৫) এই স্টেডিয়ামে এখন আর বড় মাপের টুর্নামেন্ট হয় না। জেলা লিগ আর একটি নাইট ফুটবল টুর্নামেন্ট হয় শুধু। গত বছর আইপিএলের ঢংয়ে হয়েছে বিরাট ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। বেশ কয়েক বছর ধরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের ডার্বি ম‍্যাচও।

(৬) গত বছর স্টেডিয়ামটি সংস্কার করে নতুন করে সাজিয়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরনিগম। সংস্করণের জন‍্য স্টেডিয়ামে বিভিন্ন খেলার যতগুলি অফিস এবং জার্নালিস্ট ক্লাব আছে প্রত‍্যেককে উঠে যাওয়ার চিঠি দিয়েছে পুরনিগম। কিন্তু স্টেডিয়ামের একটি বড় ক‍্যান্টিন রয়েছে,তাদের কিন্তু উঠে যাওয়ার কোনও চিঠি পাঠানো হয়নি। প্রশ্ন উঠছে, সংস্করণের কাজে সব অফিসকে যখন উঠতে হবেই তখন ক‍্যান্টিনকে কেন উঠে যাওয়ার চিঠি ধরানো হচ্ছে না। শুধু তাই নয়,এই কলকাতা ক‍্যাটারারকে নতুন করে লিজ বাড়িয়ে নাকি রিনিউ করে দেওয়া হয়েছে। এটা নিয়েও শিলিগুড়ি ক্রীড়া মহলে বিস্তর সমালোচনা চলছে।

(৭) দার্জিলিং জেলা ক্রীড়ার প্রধান সংস্থা হল শিলিগুড়ি মহকুমা ক্রীড়া পরিষদ (SMKP)। এই সংস্থার প্রধান কার্যালয় এই স্টেডিয়ামের ৯ নম্বর গেটের পাশে। এই সংস্থাকেও উঠে যাওয়ার চিঠি ধরানো হয়েছে। কারণ স্টেডিয়াম সংস্করণ।

(৮) কর্পোরেশন এই চিঠি দিয়েছে প্রায় এক বছর আগে। অথচ এখনও সংস্করণের কাজই শুরু হয়নি। স্টেডিয়ামের কাজ করবে পূর্ত দফতর। হেলথ চেক আপ হয়েছে। কিন্তু এখনও ডিপিআর না আসায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।

(৯) পুরো স্টেডিয়াম সংস্করণের জন‍্য নাকি কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন হল এত টাকা কে দেবে? পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত কর্পোরেশনে অর্থের প্রচন্ড অভাব। সুষ্ঠুভাবে কোনও কাজই করতে পারছেন না কোনও মেয়র। সেই যায়গায় দাঁড়িয়ে শিলিগুড়ি পুরনিগমের কাছে এত টাকা জোগাড় করে স্টেডিয়াম সংস্করণ করাটা কঠিন চ‍্যালেঞ্জ।

(১০) অশোক ভট্টাচার্য যখন মেয়র ছিলেন,তখন তিনি বিরোধী দলের প্রতিনিধি হওয়ায় অর্থের দাবি নিয়ে ধর্নায় বসতে পারতেন। কর্পোরেশন চালানোর জন‍্য ব‍্যক্তিগত ভাবেও বিভিন্ন ব‍্যক্তিদের কাছ থেকেও অর্থ নিয়ে আসতেন বলে শোনা যায়। কিন্তু শিলিগুড়ি পুরনিগমের বর্তমান মেয়র গৌতম দেবের অর্থ জোগাড় করার ক্ষেত্রে নানান বাধ‍্যবাধকতা আছে। তিনি শাসক দলের প্রথম সারির নেতা। স্টেডিয়াম সংস্করণের জন‍্য বিজেপি মন্ত্রী নিশীথ প্রামানিকের ( কেন্দ্রীয় যুব ও ক্রীড়া উন্নয়ন মন্ত্রী ) কাছেও রাজনীতিগত ভাবে সাহায্য চায়তে পারবেন না।

(১১) স্টেডিয়াম সংস্করণের কাজ শুরু না হওয়ার একটাই কারণ, অর্থের অভাব। ডিপিআর না জমা পড়লে ঠিক কত কোটি টাকার প্রয়োজন সেটাও এখনও স্পষ্ট নয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শিলিগুড়ির ফুটবল উন্মাদনা সেই সাতের দশক থেকেই। কিন্ত নেহেরু কাপকে কেন্দ্র করেই ভারতীয় ফুটবলের মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছিল শিলিগুড়ি। উত্তরবঙ্গের এই বাণিজ্যিক শহরে ফুটবলের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা প্রদ‍্যোৎ দত্তর। ভারতীয় ফুটবল প্রশাসনে এক দোর্দন্ডপ্রতাপ কর্তা ছিলেন। তিনি নেহেরু কাপকে সামনে রেখে শিলিগুড়িতে করেছিলেন আজকের কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গন স্টেডিয়াম। অতীতে এই স্টেডিয়াম ছিল না। ছিল একটা খোলা মাঠ। নাম ছিল ‘তিলক ময়দান।’ মাঠটা ছিল সেনাবাহিনীর অধিনে। প্দ‍্যোৎ দত্তর উদ‍্যোগ নেওয়ার অনেক আগে ১৯৭৬-‘৭৭- এর দিকে ঠিক হল, এই তিলক ময়দানে স্টেডিয়াম গড়া হয়। তৎকালীন ডিফেন্স মিনিস্টার বংশীলালের
অনুমতি পাওয়া গেল। সেই সঙ্গে তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ও অনুমতি দিলেন। স্টেডিয়াম গড়ার জন‍্য তৈরি হল একটি কমিটি। সভাপতি হলেন শিলিগুড়ির ত‍ৎকালিন জেলা শাসক মণীশ গুপ্ত। সচিব কালী ঘোষ। কয়েক বছর পর (তখন সরকারে বামফ্রন্ট) ১৯৮০ সালে মাঠের একটা অংশে কাঠের গ‍্যালারি করে শুরু হয়েছিল শিলিগুড়ি কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম। পরে ১৯৮৫ সালে মেয়র বিকাশ ঘোষদের সাহায্য নিয়ে প্রদ‍্যোৎ দত্তর উদ‍্যোগে পূর্ণাঙ্গ স্টেডিয়াম তৈরি হয়। সেটাই ছিল উত্তরবঙ্গে প্রথম কোনও পূর্ণাঙ্গ স্টেডিয়াম।

ওই সময় নেহেরু কাপের জন‍্য উত্তরবঙ্গের ব‍্যবসায়ী সংগঠন ‘ফোসিন’ (FEDERATION OF CHEMBERS OF COMMERCE AND INDUSTRY NORTHBENGAL) – এর কাছ থেকে স্পনসরবাবদ মোটা টাকা নিশ্চিত করেছিলেন প্রদ‍্যোৎবাবু। অভিযোগ শোনা যায়, সেই সময় সাদা রংয়ের হ‍্যাট পরা প্রভাবশালী মন্ত্রী এই বিষয়ে অসহযোগিতা করেছিলেন। কারণ সেই মন্ত্রীর সঙ্গে প্রদ‍্যোৎবাবুর সম্পর্ক ভাল ছিল না। আরও জানা‍ যায়, উত্তরবঙ্গের প্রথম শ্রেণির এক দৈনিক কাগজে নাকি ‘ফোসিন’-এর আর্থিক সাহায‍্যর কথা আগাম প্রকাশ হয়েছিল। সেখানে নাকি প্রদ‍্যোৎ দত্ত বিবৃতিও দিয়েছিলেন। তাই দেখে প্রভাবশালী মন্ত্রী ভাল চোখে দেখেননি। সেই মন্ত্রী তাঁর ‘দূত’ মারফত প্রদ‍্যোৎবাবুকে প্রকাশিত খবরের রিজয়েন্ডার পাঠাতে বলেন। সেই দৈনিক কাগজের দফতরে রিজয়েন্ডার পাঠালে বিপদে পড়তেন সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক। সেই সাংবাদিক খবরটা পেয়েই প্রদ‍্যোৎ দত্তর কাছে এসে বলেছিলেন,তিনি রিজয়েন্ডার দিলে তাঁর কাগজের অফিস পদক্ষেপ করবে। সেক্ষেত্রে তাঁর সাংবাদিক কেরিয়ারের ক্ষতি হবে। প্রদ‍্যোৎবাবু সেই সাংবাদিককে অভয় দিয়ে বলেছিলেন,তিনি রিজয়েন্ডার দিচ্ছেন না। সত‍্যিই তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অনঢ় ছিলেন।

পরে ফোসিনের কাছে যে টাকাটা পাওয়ার কথা ছিল তার পুরোটা পায়নি। তবে ফোসিন খালি হাতেও প্রদ‍্যোৎ দত্তকে ফেরাননি। কিন্তু বাকি যে অন‍্য কো স্পনসরের সঙ্গে চূড়ান্ত কথা হয়েছিল সেই সব কো-স্পনসর আর এগিয়ে আসেননি। তার কারণ নাকি সেই প্রভাবশালী মন্ত্রী।

পরে তৎকালীন মুখ‍্যমন্ত্রী জ‍্যোতি বসুর কাছে গিয়ে প্রদ‍্যোৎবাবু নেহেরু কাপ আয়োজন করার জন‍্য NOC আদায় করেছিলেন। প্রভাবশালী মন্ত্রীর অসহযোগিতার পরও থেমে থাকেননি প্রদ‍্যোৎ দত্ত। আইএফএ অফিসটাকে ইউনাইটেড ব‍্যাঙ্কের কাছে বন্ধক রেখে শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গনে আয়োজন করেছিলেন ভারতের সব থেকে জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট নেহেরু কাপ। পরবর্তীকালে আইএফএ সভাপতি জাস্টিস অজিত সেনগুপ্তর সাহায্য নিয়ে ব‍্যাঙ্কের ইন্টারেস্ট মুকুব হলে আইএফএ অফিস বন্ধক মুক্ত হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here