উৎপল চন্দ্র
ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে বাংলার অ্যাথলেটিক্স। বিভিন্ন গ্রামে খুঁজলে এখনও অনেক প্রতিভা পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই ভাবে প্রতিভা তুলে আনা হয়? বাংলার প্রবীণ অ্যাথলেটিক্সের কোচ কুন্তল রায়ের সঙ্গে আলোচনার মধ্যেই জানা গেল, ১৯০০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পযর্ন্ত বাংলার অ্যাথলেটিক্সের অলিম্পিয়ানের সংখ্যা নাকি মাত্র ৭ জন। ভাবা যায়! যত দিন যাচ্ছে এই আমাদের রাজ্যের অ্যাথলেটিক্সের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রতিবেশি রাজ্য ওড়িশা, বিহার যখন এগিয়ে চলেছে, তখন বাংলা পিছিয়ে পড়েছে।
একটা সময় বাংলার মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন জ্যোতির্ময়ী সিকদার, সোমা বিশ্বাস, সুস্মিতা সিংহ রায়, সরস্বতী সাহা, সঞ্জয় রায়, দেবশ্রী রায় চৌধুরীরা। আর এখন? বর্তমানে বাংলার অ্যাথলেটিক্সে তারকা বা ভবিষ্যতের তারকা কে? কেউ বলতে পারবেন?
দু বছর আগে নতুন করে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন জলপাইগুড়ির মেয়ে স্বপ্না বর্মণ। চাকরির প্রস্তাব থাকা সত্বেও সেই সময় স্বপ্না জানিয়েছিলেন, “আমার লক্ষ্য টোকিও অলিম্পিক। এখনই চাকরিতে যোগ দিতে চাই না। সামনে অনেক পথ। এখন শুধু খেলে যেতে চাই।” সেই স্বপ্না দেড় বছর আগে চোট পেয়ে কিছুদিন ট্র্যাকের বাইরে ছিলেন। তারপরেই চাকরি নিলেন। এখনও কি তাঁর সেই লক্ষ্য আছে?
রাজ্য অ্যাথলেটিক্সের খারাপ অবস্থার জন্য রাজ্য নিয়ামক সংস্থা ও বর্তমান রাজ্য সরকারকেই দায়ী করলেন ২০০২ বুসান এশিয়ান গেমসে রুপো জয়ী সোমা বিশ্বাস। তিনি ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে বলছিলেন,”রাজ্য সংস্থা ঠুঁটো জগন্নাথ। একই সঙ্গে বলতে হবে রাজ্য সরকারেরও অ্যাথলেটিক্স নিয়ে কোনও উদ্যোগ নেই। খোঁজ নিয়ে দেখুন আমাদের বাংলায় ট্র্যাকের সংখ্যা মাত্র ২ টি। আর অন্য রাজ্যে গিয়ে দেখে আসুন, কতটা এগিয়ে গিয়েছে। আমাদের এখানে অ্যাথলেটিক্সের সুষ্ঠু পরিকাঠামোই নেই। রাজ্য সরকার বিভিন্ন ক্লাবকে ২ লক্ষ টাকা করে দিয়েছে। এই টাকা দিয়ে কি উপকার হয়েছে? কোনও প্রতিভা উঠে এসেছে? টাকা গুলো কোথায় খরচ হল? এই টাকার হিসেব কে নেবে? সল্টলেক স্টেডিয়াম ও সাইয়ের মাঠ ছাড়া ভাল কোনও ট্র্যাক নেই। তবুও কিছু মানুষ খেলাটাকে এখনও ভালবাসে বলে এখনও টিকে আছে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে বাংলার অ্যাথলেটিক্স শেষ হয়ে যাবে।”
সোমা বিশ্বাসের মতোই এক সুর বাংলার অ্যাথলেটিক্সের সফল কোচ কুন্তল রায়ের গলাতেও। কুন্তলবাবু সরাসরি রাজ্য সরকারকে দায়ী করলেন। তাঁর কথায়, “পঞ্জাব, হরিয়ানা শুধু নয়, বিহারও খুব উন্নতি করছে। আর আমারা পিছিয়ে পড়ছি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার অ্যাথলেটিক্সের জন্য কিচ্ছু করেনি। করছেও না। ফুটবলে দুই প্রধান সহ বহু ক্লাবকে টাকা দিয়েছে সরকার। তারপরেও বাঙালি ফুটবলারের আকাল। আজ আমি আপনাদের মাধ্যমে বলছি এবং কথা দিচ্ছি, রাজ্য সরকার যদি আমাকে সুযোগ দেয়, সাহায্য করে তাহলে শুধু আমাদের রাজ্য নয়, দেশ যে পদক পেতে পারে তা প্রমাণ করে দেব।” রাজ্য সরকারের পাশাপাশি রাজ্য অ্যাথলেটিক্স সংস্থাও যে উদ্যোগী নয় সেটাও জানালেন কুন্তলবাবু। “জ্যোতির্ময়ী, সোমা, সুস্মিতা সহ এক ঝাঁক অ্যাথলিট উঠে এসেছে নিজেদের উদ্যোগে। এখানে রাজ্য সংস্থার কোনও ভূমিকা নেই।” বলছিলেন কুন্তল রায়।
রাজ্য অ্যাথলেটিক্সের সচিব কমল মৈত্র অসহায়। তাঁদেরকেও নানান প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে চলতে হচ্ছে। ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে কমল মৈত্র বলছিলেন,”আমাদের রাজ্য সংস্থার কোনও স্থায়ী অফিস ঘরই নেই। অতীতে ইন্ডোরে একটা জায়গা ছিল। এখন সেটাও নেই। ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্র থেকে ইস্টবেঙ্গল হয়ে পরে অন্যের অফিসে বসে সংস্থার কাজ সামলাতে হয়। সবাই আমাদের দোষারোপ করেন। কিন্তু আজ পযর্ন্ত কোনও সরকারই রাজ্য অ্যাথলেটিক্স সংস্থাকে গুরুত্ব দেয়নি, সাহায্যও করেনি। বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনও কিছু করেনি। আমরা বছরে যে দুটি মিট করি তাও কোনও রকমে স্পনসর জোগাড় করে করি।”
তাহলে আপনারা ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে বলছেন না কেন? প্রশ্নের উত্তরে কমলবাবু হেসে বললেন,”ক্রীড়া মন্ত্রী সব জানেন। আর কি বলব?”
প্রসঙ্গত, ভারত সরকারের ‘খেলো ইন্ডিয়া’ সম্প্রতি একটি TALENT IDENTIFICATION ZONAL COMMITTEE তৈরি করেছে। সেই কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন বাংলার রাজ্য অ্যাথলেটিক্স সংস্থার সচিব কমল মৈত্র। তাঁকে পূর্বাঞ্চলের ১৪টি রাজ্য অ্যাথলেটিক্সের কর্মসূচি, ভাবনা, পরিকল্পনার গুরুদায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে। গত ৭ জানুয়ারি সরকারি ভাবে চিঠি দিয়ে কমল মৈত্রকে জানিয়ে দিয়েছে ‘খেলো ইন্ডিয়া ‘।
এমন দায়িত্ব পেয়ে কমলবাবু জানান,”নিজেদের সামর্থ মতো আমরা সব সময় কাজ করার চেষ্টা করি। এবার এই নতুন দায়িত্ব পাওয়ায় বাংলা সহ পূর্বাঞ্চলের মোট ১৪ টি রাজ্যে ভাল করেই কাজ করবো। আর আমার এই দায়িত্ব পাওয়ার আগেই কিন্তু আমরা বাংলার অ্যাথলেটিক্স নিয়ে বিশেষ ভাবনা চিন্তা করছি। যত প্রতিকূলতা থাক, বাংলার অ্যাথলেটিক্সকে বাঁচাতে হলে এবার আমাদের ঝাঁপাতেই হবে। এবার সেই সময় এসে গিয়েছে।”