◆সন্দীপ দে◆
“পলাশ, আমি সুবীর বলছি রে। তোর আজকে ছুটি আছে? আজ খোকন আমাকে দেখতে এসেছে। তুই আজ বিকেলে আই। আসতে পারবি? একটু গল্প করবো।”
রবিবার সকালে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছোট্ট মুঠো ফোনে কথা গুলি যখন তিনি বন্ধু পলাশকে বলছিলেন তখন তাঁর চোখ চিক চিক করছিল। সঙ্গে মনের মধ্যে তীব্র হাহাকার। একটু কেউ আসুক। গল্প করুক। কিন্তু কেউ আসে না। খোঁজও নেয় না। গত ১৪ বছর ধরে শরীরের সঙ্গে মনটাও পঙ্গু হয়ে গেছে।
না। বন্ধু পলাশ রবিবার আর আসতে পারেননি। এই সাংবাদিক যখন ‘ভাল থাকবেন’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন, বিছানায় পড়ে থাকা প্রাক্তন ফুটবলারটি শিশুর মতো বলে উঠলেন,”ভাই তোমার নাম সন্দীপ তো? মাঝে মাঝে আমার কাছে এসো না গো। কেউ আসে না। কেউ এলে, কথা বললে অক্সিজেন পাই। প্লিজ এসো।”
তাঁর এমন আর্তি মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। ভাল লাগে না কিছু। নিজের পেশার কাজে গিয়েও এমন দৃশ্য,কথা শুনলে ভাল লাগার কথা নয়। মনকে কষ্ট দেয়। গড়িয়ার ৩০ নম্বর ভ্যালি পার্কের তিন তলার বাড়ি থেকে বেরোনোর পর থেকেই ভাবতে ভাবতে এসেছি, একটা মানুষ ১৪ বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছেন। চূড়ান্ত অসহায় হয়ে কি ভাবে জীবন কাটছে তাঁর। ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়।
কে এই সুবীর? কোনও বিখ্যাত ফুটবলার নয়। সুবীর সাহা। কলকাতা ময়দানের ভ্রাতৃ সংঘর প্রাক্তন অধিনায়ক গোলরক্ষক। আটের দশকে গ্রিয়ার, ভ্রাতৃ ও টালিগঞ্জের হয়ে চুটিয়ে ফুটবল খেলেছেন। ওই সময় কলকাতা লিগে বেশ উঠে আসছিলেন তিনি। বাংলা দলে ডাক পেয়েও যেতে পারেননি বাবার ব্যবসার (ট্রানসপোর্ট ব্যবসা) কারণে। তাঁর খেলা দেখে আসানসোলে হিন্দুস্তান কেবল সংস্থা চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিল। বাবার আপত্তিতে সেই চাকরিও গ্রহণ করতে পারেননি।
২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসের বড় দিন। বন্ধুদের সঙ্গে ভাইজ্যাগ ঘুরতে গিয়েছিলেন। সমুদ্র সৈকতে কিছু ছেলে ফুটবল খেলছিল। তাদের সঙ্গে সুবীরও ফুটবল খেলতে শুরু করেন। তিনি খুব ভাল সামারসল্ট করতে পারতেন। সেই দিন বিচ ফুটবল খেলতে খেলতে হাঁটু জলে নেমে সামারসল্ট করছিলেন। একটা প্রচন্ড ঢেউ সুবীরকে ছিটকে ফেলে দেয় পাথরের উপর। সবাই ছুটে গেল তার কাছে। কিন্তু উঠতে পারছেন না। পা অবস হয়ে গিয়েছে। সুবীরের পঙ্গু হওয়া সেই শুরু। কোমর থেকে পা – সব অসাড়। এখনও। ক্যাথিটার লাগানো আছে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হয় বিছানাতেই। হ্যাঁ, গত ১৪ বছর ধরে এভাবেই চলছে।
২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পযর্ন্ত ৩৩ বার নার্সিং হোমে ভর্তি হতে হয়েছেন। ভেলরের বিখ্যাত ডাক্তার শ্রীধর অস্ত্রোপচার করেও ব্যর্থ হয়েছেন। পরবর্তীকালে নিউরোলজিস্ট ডাক্তার সৌম্যজিৎ বসু ও ডাক্তার সন্দীপ চ্যাটার্জি চিকিৎসা করেও আশার আলো দেখাতে পারেননি। জানা গেল, একটা সময় সুবীর নাকি এক বন্ধুকে কাছে পেয়ে নিজের মৃত্যু কামনা করেছিলেন।
পরিস্থিতি মানুষের লক্ষ্য বদলে দেয়। সুবীর এখন হাঁটতে চান, বাঁচতে চান। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দুই মেয়ের বিয়ে দিতে চান। তাঁর এমন ফিরে আসার মরিয়া চেষ্টা দেখে নিজের ঘরের দেওয়াল থেকে যীশু ছলছল চোখে, হাত তুলে যেন সুবীরকে আশ্বাস দেয়।
সুবীর আর চিকিৎসকদের বিশ্বাস করেন না। তিনি বিশ্বাস করেন যীশুকে। আর কবিরাজি শেকড়কে। অলৌকিক কিছু ঘটার অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন সুবীর।
নিজের ঘরে হিন্দুদের কোনও দেব দেবীর ছবি নেই। ঘরের দেওয়ালে আছে শুধু যীশুর ছবি। প্রত্যেক রবিবার সকালে মাথার কাছে বেজে ওঠে গীর্জার প্রার্থণা সঙ্গীত।
হঠাৎ কেন যীশু নির্ভরতা? সুবীর সাহা বলছিলেন,”একদিন টিভিতে ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ অনুষ্ঠানে এক মহিলা এসেছিলেন। তিনি নাকি আমার মতোই পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন। কিন্তু যীশুর কৃপায় এখন সে উঠে দাঁড়িয়েছেন। কিছু কিছু গীর্জায় যীশুর প্রতিনিধি আছেন। তাদের অসীম ক্ষমতা। তাঁরা শরীরে হাত বুলিয়ে দিলে ভালো হয়ে যায়। এমন এক গীর্জা আছে পঞ্জাবের চন্ডীগড়ে। সেখানে আছেন বাজিন্দর সিং। আমি সেখানে যাব। আমি আর কালী,দূর্গা,শিব ঠাকুরদের ডাকি না। যীশুর কৃপায় ভাল হওয়ার পর আমি হিন্দু ধর্ম ছেড়ে খ্রিষ্টান হয়ে যাব।” কথাগুলি বলেই তাঁরই পাশে বসে থাকা ছোট বেলার বন্ধু, প্রাক্তন ফুটবলার খোকন ওরফে দীপ্তিকল্যাণ সেনশর্মাকে (মাঝে মাঝে সুবীরকে দেখতে আসেন এবং তিনিই এই সাংবাদিককে নিয়ে গিয়েছিলেন সুবীরের কাছে) সুবীর বলে উঠলেন, “খোকন,তোর পায়ের অবস্থা খুব খারাপ। লেংচে হাঁটছিস। আগে আমি চন্ডীগড় থেকে ভাল হয়ে আসি। তারপর তোকে নিয়ে যাব। দেখবি তুইও ভাল হয়ে যাবি।” অবাক হয়ে কথা গুলি শুনছিলাম।
অবাক আরও হয়েছিলাম যখন ৫৮ বছরের সুবীর বলে উঠলেন,”গত পাঁচ বছরে আমাকে একবারও নার্সিং হোমে যেতে হয়নি। কেন জানো? আমার এক দাদা আছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। তিনি একটা ১২০০ টাকার শেকড় দিয়েছিলেন। ওই শেকড় ব্যবহার করার পর আমাকে আর নার্সিংহোমে যেতে হয়নি। আর একটা খুব দামি গাছের শেকড় আছে। ওটার দাম কয়েক লক্ষ টাকা। ওই শেকড় যদি শরীরে ব্যবহার করতে পারি তাহলে আমি ২৪ ঘন্টার মধ্যে সুস্থ হয়ে যাব।”
তাঁর কথাগুলি শুনে চুপ করে ছিলাম। “কি সন্দীপ,শেকড়ে বিশ্বাস নেই? আমার চিকিৎসা খরচের সময় বাড়ি বিক্রি করার মতো অবস্থা হয়েছিল। বাবা বলেছিলেন, ছেলেকে বাঁচাতে হলে আরও চারজনকে মরতে হবে। তখন ভেবেছিলাম আমার মরে যাওয়ায় একমাত্র পথ। সেই সময় ১২০০ টাকার গাছের শেকড় বাঁচিয়ে দিয়েছে। ওই শেকড় ব্যবহার করার পর আর নার্সিংহোমে যেতে হয়নি।” চিকিৎসকরা জবাব দিয়ে দিয়েছেন। তবে হাল ছাড়েননি সুবীর। ফিরে আসার জন্য যীশু ও শেকড়কে আঁকড়ে ধরেছেন। এমন ঘটনার ব্যাখ্যা কি হতে পারে? অন্তত এই সাংবাদিকের জানা নেই। শুধু বলি, নিজের এই বিশ্বাস নিয়ে যদি সুবীর ভাল থাকেন, তাহলে সেই বিশ্বাসকে সম্মান করতে সমস্যা কোথায়?
বাড়িতে সুবীরের খেলার কোনও ছবি নেই। কোনও ট্রফিও নেই। সব ফেলে দিয়েছেন। ঘরে একটা পোর্টবল টিভি, হুইল চেয়ার আছে। কেউ ধরে বসালে বসতে পারেন। ওই টুকুই। আগে হুইল চেয়ারে বসে বারান্দায় যেতেন। এখন সেটাও হয় না। আস্তে আস্তে এবার হাতের আঙ্গুল গুলোও শক্তি হারাচ্ছে। টিভিতে খেলা দেখেন না। খবর আর সিরিয়াল দেখেন। তাঁর স্ত্রী শিখা সাহার আত্মত্যাগ কম নয়। গত ১৪ বছরে স্বামীর দেখাশোনা, যত্নর পাশাপাশি দুই মেয়েকে মানুষ করেছেন। আজ সুবীর-শিখার দুই মেয়ে ব্যাঙ্কে চাকরি করছেন। প্রতিষ্ঠিত। শিখাদেবী বলেন,”ডাক্তাররা তো বলেই দিয়েছেন, আর কিছু করার নেই। এখন অলৌকিক কিছু ঘটলে যদি দাঁড়াতে পারে।”
ময়দানের কথা বললে যেন খেলা নিয়ে মৌনব্রত ভেঙে ফেলেন সুবীর। ভ্রাতৃ সংঘর কথা উঠলেই বলতে থাকেন,”গগনদার স্নেহ, কাজল গুহর ট্রেনিং, লক্ষ্মণদার পরামর্শ আর আলোদার পরিচর্চা এখনও মনে পরে। ভুলতে পারিনা। আলোদা কেমন আছে?” ময়দানকে ভোলার চেষ্টা করেও ভুলতে পারেন না। গ্রিয়ার থেকে যখন ভ্রাতৃ সংঘে সই করেন, তখন মোহনবাগান থেকে আসা লক্ষ্মণ বেলেল (প্রাক্তন ফুটবলার অচিন্ত বেলেলের কাকা) ভ্রাতৃর এক নম্বর গোলরক্ষক। তাঁর জায়গায় সুবীর খেলেছেন। মনে পড়ে ভ্রাতৃর হয়ে তাঁর প্রথম ম্যাচ। মহমেডান মাঠে। বেহালা ইউথের বিরুদ্ধে। অসাধরণ খেলেছিলেন। অনেক ক্লাবে খেলার প্রস্তাব থাকলেও অন্য ক্লাবে যাননি। ভ্রাতৃ সংঘেই থেকে গিয়েছিলেন (১৯৮৭ সালে এক বছরের জন্য শুধু টালিগঞ্জে গিয়েছিলেন)।
ময়দান থেকে কোনও ফোন পেয়েছেন? “গড়িয়ার বিধানপল্লী স্পোর্টস অ্যান্ড কালচার আমার ক্লাব। ছোট থেকেই খেলে বড় হয়েছি। কোচ অরুণ ব্যানার্জি, চন্দন গুহ, কাজল গুহদের কাছে ফুটবলের তালিম নিয়েছি। আমার পাড়ার এই ক্লাবে এখন যারা আছে তারাই কোনও খবর নেই না। ময়দানের দোষ দিই কি করে। আমার তো টাকা পয়সা চাই না। বন্ধুদের একটু সঙ্গ চেয়েছি। কেউ এসে কথা বললে আমি একটু অক্সিজেন পাই। ১৪ বছরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মনটাই ভেঙে গিয়েছে।”
কলকাতার ময়দান অনেক ভালর সাক্ষী। তিনি তো প্রাক্তন ফুটবলার। ময়দান কী একটু মানবিক হতে পারে না? সুবীর সাহা আর্থিক সাহায্য চান না। শুধু একটু সময় চান। ফোন বা সাক্ষাতের মধ্যে দিয়ে। যদি সুবীর সাহার একদা বন্ধু, ক্লাব সতীর্থরা ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-এর এই প্রতিবেদন পড়ে থাকেন তাহলে তাঁদের কাছে আমাদের অনুরোধ (সুবীর সাহা 96746 54905) এই নম্বরে ফোন করুন। আপনার একটা ফোন বন্ধু সুবীরের মনে একটু শক্তি জোগাতে পারে। চন্ডীগড়ের গীর্জার বাজিন্দার ছোঁয়ায় বাজিমাত করতে আপনার ফোন কলটাই হয়তো সুবীর সাহার মনের শক্তির স্টোরেজ হতেই পারে।