পঙ্কজ,সৌরভ,ঝুলন,ডালমিয়ার সঙ্গে বিশ্বনাথ দত্তর মূর্তি বসানোর আবেদন ক্রিকেট মহলের

0

সন্দীপ দে

কেউ বলতেন ‘বিশুবাবু’, আবার কেউ বলতেন ‘বিশুদা’। কিন্তু ক্রীড়া জগৎ-এ তিনি পরিচিত “ময়দানের ভীষ্ম” নামেই। বিশ্বনাথ দত্ত। নিঃসন্দেহে দিকপাল ক্রীড়া প্রশাসক।

দীর্ঘ ১২ বছর দক্ষতার সঙ্গে আইএফএ সংগঠন করার পর সরে এসেছেন। তখনই একদিন ইস্টবেঙ্গলের কালু রায়চৌধুরীর পরামর্শে সিএবির হাল ধরার চেষ্টা শুরু। সালটা ১৯৭৮। সিএবিতে তখন প্রচন্ড দাপট সব লব্ধ প্রতিষ্ঠ কর্মকর্তাদের। অমরেন্দ্রনাথ ঘোষ, এন সি কোলে, নরনারায়ণ চ‍্যাটার্জি, প্রাক্তন ক্রিকেটার শম্ভু পান। তাঁদের পাশে এম দত্ত রায় এবং সঙ্গে পুলিশ, প্রশাসন ও সরকারি প্রভাবশালী কিছু অফিসারও ছিলেন। আর বিশ্বনাথ দত্তর পাশে কালু রায়চৌধুরী, জ‍্যোতির্ময় সেনগুপ্ত, সূর্য বসু, অজয় শ্রীমানি ও জগমোহন ডালমিয়া। সেই বছর নির্বাচনী সভায় হাজির থেকেও বিশ্বনাথবাবুরা অংশ নিতে পারেনি শাসক দলে নোংরা ষড়যন্ত্রের জন‍্য। পরে আদালতে যাওয়া, রিসিভার বসানো, তারও পরে বিরোধী গোষ্ঠীর অন‍্যতম অমরেন্দ্রনাথ ঘোষকে ‘ম‍্যানেজ’ করে শেষ পযর্ন্ত নির্বাচনে জয়। সেই প্রথম সচিব হয়ে সিএবিতে প্রবেশ বিশ্বনাথ দত্তর। বাংলার ক্রিকেট প্রশাসকদের অধিকাংশই আজও বলে থাকেন, সেই বছর সিএবিতে ঢুকে বাংলার ক্রিকেটে নবজাগরণ ঘটিয়ে ছিলেন বিশ্বনাথ দত্ত। পরবর্তীকালে তাঁর হাতে তৈরি হয়েছিলেন জগমোহন ডালমিয়া। সিএবি থেকেই বিসিসিআইয়ের সভাপতি হয়েও সফল হয়েছিলেন বিশুবাবু। ফুটবল ও ক্রিকেট – দুটি বিভাগেই সুদক্ষ ক্রীড়া প্রশাসক ছিলেন তিনি। ময়দান জানে এসব কথা।

বিশ্বনাথ দত্তর মৃত‍্যুর পর তাঁর একমাত্র পুত্র সুব্রত দত্ত,বাবাকে নিয়ে “ময়দানের ভীষ্ম” বই প্রকাশ করেছিলেন। সেই বইয়ে বিশ্বনাথ দত্ত সম্পর্কে সৌরভ গাঙ্গুলি লিখেছিলেন-“প্রকৃত অর্থে অভিভাবক”। চূনী গোস্বামীর লেখায় – “অজাতশত্রু”। বড় আদর করে কপিল দেব ছাপার অক্ষরে বলেছিলেন, “আমার ডাট সাহেব”। তাঁর প্রিয় শিষ‍্য জগমোহন ডালমিয়া মৃত‍্যুর আগে নিজের গুরু সম্পর্কে বলে গিয়েছিলেন,”দেবতুল‍্য।” আর সবাইকে ছাপিয়ে,আত্মসমালোচনার ঢংয়ে প্রাক্তন সাংসদ ও বিধায়ক সোমেন মিত্র জানিয়ে দিয়েছিলেন-“ময়দানের পিতা মহকে আমরা প্রাপ‍্য সম্মান দিইনি।”

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রয়াত সোমেন মিত্রর কথায় কি মনে করাচ্ছে? গত বছর লকডাউনের আগে সিএবি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পঙ্কজ রায়,সৌরবভ গাঙ্গুলি, ঝুলন গোস্বামী এবং জগমোহন ডালমিয়ার মূর্তি বসাবে। অত‍্যন্ত ভাল উদ‍্যোগ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। করোনার কারণে এখনও সেই চার কিংবদন্তির মূর্তি বসানো যায়নি। এবার আধা লকডাউন উঠে গেলে পরবর্তী পদক্ষেপ করবে সিএবি কর্তারা।

কিন্তু এই চার কিংবদন্তির সঙ্গে বিশ্বনাথ দত্তরও মূর্তি বসানোর আবেদন করল বাংলার ক্রিকেট মহল। এই বিষয়ে প্রথম দাবিটি তুলেছেন সিএবির অ‍্যাপেক্স কাউন্সিল কমিটির মেম্বার দক্ষিণ দিনাজপুরের ( বালুরঘাট) গৌতম গোস্বামী। প্রথমে ফেসবুক পরে ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে গৌতমবাবু দাবি করলেন, ময়দানে বিশুবাবুর বিরাট অবদান। পঙ্কজ রায়, সৌরভ গাঙ্গুলি, ঝুলন গোস্বামী এবং জগমোহন ডালমিয়ার মূর্তি বসানোর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। তবে এঁদের সঙ্গে বিশ্বনাথ দত্তর মূর্তি বসলে খুব ভাল লাগত।”
যে মিটিংয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেখানে আপনিও উপস্থিত ছিলেন। তখন এই প্রস্তাবটা দেননি কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে গৌতমবাবু বলেন,”এটা আমার ভুল হয়েছে। মিটিংয়ে পাশ হওয়ার পর পরে চিন্তা করে দেখলাম বিশুবাবু ডিসার্ব করেন। অন‍্যরাও কেউ বিশুবাবুর নাম বলেননি।”

বীরেন মিত্র। বিশ্বনাথ দত্ত যখন যাদের নিয়ে সিএবিতে ঢুকেছিলেন তাদের মধ‍্যে এই বীরেন মিত্রও ছিলেন। পরে তিনি সিএবির ভাইস প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন। এখন বীরেনবাবুর বয়স ৮৭ বছর। বয়েসের ভারে আর সিএবি যাওয়া হয় না। নিজের “ক্রিকেট ক্লাব অফ ঢাকুরিয়া” নিয়েই থাকেন। ” সাতের দশকের শেষ দিকে বিশুবাবু যখন একঝাঁক কর্তাদের সঙ্গে নিয়ে প্রথম সিএবির নির্বাচনে লড়াই করলেন তখন আমিও ছিলাম। খুব কাছ থেকে ওনাকে দেখেছি। আমি মনে করি, বিশুবাবুই সিএবিতে নবজাগরন ঘটিয়েছিলেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে বিরাট পরিবর্তন এনেছিলেন। বাংলার ক্রিকেটে বিশুবাবুর বিরাট অবদান আছে। সিএবির বর্তমান কমিটি যে চারজনের মূর্তি বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটা ভাল। কিন্তু বিশুবাবু বাদ পড়লেন কেন? অমরেন্দ্র ঘোষের কথাও আসবে। অতীত ছাড়া বর্তমান হয় না। কাজেই অতীতের দিকপালদের অবদানের কথা মাথায় রাখা উচিত ছিল।” ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে কথা গুলি বলছিলেন বীরেন মিত্র।

অলোক নন্দী। আইবিএসির প্রাণপুরুষ। সিএবির প্রাক্তন সহসচিব ও সহসভাপতি অলোক নন্দীও ‘ইনসাইড স্পোর্টস”কে সাফ জানিয়ে দিলেন,”বিশুবাবু সত‍্যিকারের মাঠের লোক। মাঠ থেকে উঠে এসেছেন। আইএফএ, সিএবি ও বিসিসিআই -তিনটি জায়গায় সফল। বিশুবাবু ছাড়া মাঠ চেনা যায় না। তিনি সেই সম্মান এখনও পেলেন না। খারাপ লাগে। ওনার মূর্তি বসলে খুব ভাল হত।”

বিশ্বনাথ দত্তর হাত ধরে মাঠ করেছেন। পরে জগমোহন ডালমিয়ার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন গৌতম দাশগুপ্ত। তাঁর কথায়,”আমরা কিন্তু সবাই বিশুদার হাত ধরেই উঠে এসেছি। আমরা তো এখন আর কমিটিতে নেই। তবে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হলে একটা ভিত্তি রেখে করা দরকার ছিল। বিশুদা ছাড়াও পি সেনের(খোকন) নামটাও ভাবা উচিত ছিল।”

সিএবির আর এক প্রাক্তন যুগ্ম সচিব সুবীর গাঙ্গুলি (বাবলু) ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে বলছিলেন,”দেখুন ভাই, বিশ্বনাথ দত্তকে আমাদের প্রজন্ম দেখেছে। এমন দক্ষ ক্রীড়া সংগঠক দেখিনি। তাঁকে কখনও ভুলতে পারব না। বিশুবাবুর নামে ইডেনে স্ট‍্যান্ড আছে। এবার যদি এই কমিটি বিশুবাবুর মূর্তি বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমরা খুব খুশি হব।”

সিএবির প্রাক্তন কোষাধ‍্যক্ষ বিশ্বরূপ দে জানান, “বিশ্বনাথ দত্ত খেলার দুনিয়ায় নিঃসন্দেহে দিকপাল ব‍্যক্তিত্ব। আমি যতদুর জানি যে চার কৃতির মূর্তি বসানো হচ্ছে তাদের আন্তজার্তিক সাফল‍্যকে মাথায় রেখেই মনে হয় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কখনও সখনও শিষ‍্যও গুরুকে ছাপিয়ে যায়। এখন যদি সিএবি এনাদের সঙ্গে বিশ্বনাথ দত্তর মৃর্তিটাও বসায় তাহলে কেউ আপত্তি করবে না।”

সিএবির অ‍্যাপেক্স কাউন্সিল কমিটির আর এক সদস‍্য প্রবীর চক্রবর্তী জানান,”ওই মিটিংয়ে আমিও ছিলাম। এটা সিএবির প্রথম প্রচেষ্টা। নিশ্চয় ধাপে ধাপে হবে। বিশুবাবু আমার মেন্টর ছিলেন। আমি যদি পরের বার কমিটিতে থাকি তাহলে বিশুবাবুর মূর্তির জন‍্য আমিই প্রস্তাব রাখবো।”

বিশ্বনাথ দত্তর মূর্তি বসানো হচ্ছে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে সিএবির সভাপতি অভিষেক ডালমিয়া ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে জানান,”ইডেনে ঢুকলেই আপনারা দেখতে পাবেন এই এই চার কিংবদন্তির ছবি। তাঁদের আন্তর্জাতিক সাফল‍্যর কথা মাথায় রেখেই এই চার কিংবদন্তির ছবিই শুধু আছে। আমাদের সেই থেকেই ভাবনা। বৈঠকে ঠিক হয়েছিল যাদের আন্তর্জাতিক সাফল‍্য আছে তাদের মূর্তি গড়ে সম্মান জানানো। এটা কিন্তু সবে শুরু হচ্ছে। ভাববেন না এটাই শেষ। সিএবি যখন লাইফটাইম অ‍্যাচিভমেন্ট পুরস্কার দেওয়া শুরু করে তখন কি সব কৃতিদের একসঙ্গে দেওয়া হয়েছিল? বাংলার ক্রিকেটে যাদের অবদান আছে তাদের সিএবি সব সময় সম্মান করে, মনে রেখেছে,মনে রাখবে। আপনি দেখবেন পঙ্কজ রায়, সৌরভ গাঙ্গুলি,বিশ্বনাথ দত্ত এবং জগমোহন ডালমিয়ার নামে ইডেনে স্ট‍্যান্ড আছে। আর বিশ্বনাথ দত্ত সকলের কাছে নমস‍্য ব‍্যক্তি। বিশ্বনাথ দত্তর সঙ্গে কারও তুলনা করা ঠিক নয়। সিএবি যতদিন থাকবে ততদিন বিশ্বনাথ দত্তর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আগে যারা কমিটিতে ছিলেন তারা এই উদ‍্যোগ নিতে দেখা যায়নি। আমরা নতুন করে শুরু করছি। আবার বলছি, শুরু করছি, ভবিষ্যতে চলবে।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here