◆সন্দীপ দে◆
সিএবি সভাপতি স্নেহাশিস গাঙ্গুলি চেয়েছিলেন বেঙ্গল প্রো টি২০ ক্রিকেট শুরু করে বাংলার ক্রিকেটে নতুন দিশা দেখানো। এই টুর্নামেন্ট কলকাতা কেন্দ্রিক না করে জেলার তৃণমূল স্তরে পৌঁছে যাক নতুন উদ্যোগের আঁচ। স্নেহাশিসবাবুর এই উদ্যোগে কোনও খামতি ছিল না। কিন্তু তাঁর ইচ্ছে মতন, ইচ্ছে পূরণ হল না। অন্তত প্রথম বছর তো হল না। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই শূন্য গ্যালারি। ভায়াকামের সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলের সরাসরি ম্যাচ সম্প্রচারের TRPও ভাল নয়। মাঠে এবং টিভির পর্দায় এই টুর্নামেন্ট দেখা থেকে বাংলার ক্রীড়া মহল যে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে তা বোঝার বা জানার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। টুর্নামেন্টটি এই প্রথম শুরু হল। পরের বছর ঘুরে দাঁড়াবে এমন আশা নিয়ে থাকতেই পারেন টুর্নামেন্ট কর্তৃপক্ষ।
এই কোটি কোটি টাকার টুর্নামেন্ট হওয়ায় ক্রিকেটার, কোচ থেকে সিএবি, টুর্নামেন্ট অর্গানাইজ কোম্পানি টাকার মুখ দেখেছে। কিন্তু বাংলার সামগ্রিক ক্রিকেটের প্রসার, প্রচার কতটা এগিয়েছে? কতটা এগিয়েছে বাংলার তৃণমূল স্তরের ক্রিকেট? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে অপেক্ষা করতে হবে।
শুরুতেই এই বেঙ্গল প্রো টি ২০ ক্রিকেটে জনপ্রিয় না হওয়ার অনেক কারণ আছে। ইডেন চত্বরে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে নানান জল্পনা। যেমন –
১) মনোজ তিওয়ারি, ঋদ্বিমান সাহা, অনুষ্টুপ মজুমদার, সুদীপ চ্যাটার্জিরা নিজেদের ক্রিকেট কেরিয়ারের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছেন। মনোজ তো অবসর নিয়েই ফেলেছেন। আইপিএল ধাঁচের টুর্নামেন্ট করলেও কোনও ফ্রাঞ্চাইজি দলেই তারকা ক্রিকেটার নেই। এমন কোনও মুখ নেই যাদের খেলা দেখার জন্য মাঠে এসে বা টিভিতে বসে দর্শকরা খেলা দেখবেন।
২) এমন একটা সময় টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছে যখন টি -২০ বিশ্বকাপ, ইউরো কাপ, কোপা আমেরিকা কাপ চলছে। কাজেই টুর্নামেন্টের সময় নির্বাচন নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
৩) সাধারণ ক্রিকেট দর্শকরা মাঠেই আসছেন না। এমনকি কোনও ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পের শিক্ষার্থীদেরও মাঠে দেখা যায়নি। ফ্রাঞ্চাইজি দলের নিজেদের কিছু লোক নির্দিষ্ট বক্সে এসে খেলা দেখেছন মাত্র।
৪) আর্থিক দিক দিয়ে টুর্নামেন্ট অর্গানাইজাররা লাভবান হলেও এই টুর্নামেন্টের ফ্রাঞ্চাইজি দলে অবাঙালির সংখ্যা বেশি। যদি পুরুষদের আটটি টিমের দিকে নজর দেওয়া যায় তাহলে প্রতি টিমে ১৫ জন খেলোয়াড়। অর্থাৎ আটটি টিম মিলিয়ে মোট ১২০ জন ক্রিকেটার। এই ১২০ জন ক্রিকেটারের মধ্যে বহু ক্রিকেটার ভিন রাজ্যের।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার অনেক আগে সাংবাদিক সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে সিএবি সভাপতি স্নেহাশিস গাঙ্গুলি বলেছিলেন,বাংলার প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের তুলে আনাটাই লক্ষ্য। এই টুর্নামেন্টে জেলার ক্রিকেটাররা খেলার সুযোগ পাবে। আর ভিন রাজ্যের ক্রিকেটারদের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন,যেহেতু সিএবি লিগে বিভিন্ন ক্লাবে একাধিক ভিন রাজ্যের ক্রিকেটারের রেজিস্ট্রেশন আছে তাই তারাও এই প্রো লিগে খেলবে।
ড্রাফটিং করার পর ফ্রাঞ্চাইজি দলের মালিকরা নিজেদের পছন্দ মতো দল করেছেন। সেই দল গুলোই কিন্তু জেলার খুব বেশি ক্রিকেটার সুযোগ পাননি। বেঙ্গল প্রো টি ২০ টুর্নামেন্টে জেলার ছেলেরা কেমন সুযোগ পেয়েছেন? বিভিন্ন জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে পুরুষ ও মহিলা ক্রিকেটারদের সুযোগ পাওয়ার যে সংখ্যা জানা গেল তার কিছু নমুনা তুলে ধরা হল।
◆ পুরুলিয়া(পুরুষ – ০, মহিলা – ২)
◆ মালদা (পুরুষ – ১ মহিলা-২)
◆ উত্তর দিনাজপুর (পুরুষ -০ মহিলা – ১)
◆ বীরভূম ( পুরুষ – ২ মহিলা – ০)
◆বাঁকুড়া (পুরুষ – ১ মহিলা -১)
◆দক্ষিণ দিনাজপুর (পুরুষ – ১ মহিলা – ১)
◆কোচবিহার (পুরুষ -৩ মহিলা -২)
◆জলপাইগুড়ি (পুরুষ -২ মহিলা -৩)
◆মুর্শিদাবাদ (পুরুষ-০ মহিলা -৪)
◆ পশ্চিম মেদিনীপুর (পুরুষ-৩ মহিলা -৬)
◆ শিলিগুড়ি (পুরুষ-১ মহিলা -৪)
শিলিগুড়ি থেকে পর্যাপ্ত সংখ্যায় ক্রিকেটাররা সুযোগ না পাওয়ার জন্য শিলিগুড়ি মহকুমা ক্রীড়া পরিষদের ক্রিকেট সচিব মনোজ ভার্মা তো সোসালমিডিয়ায় ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন। ‘ইনসাইড স্পোর্টস’ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে মনোজ বলেন,”শিলিগুড়ি নামেই একটা ফ্রাঞ্চাইজি দল তৈরি হয়েছে। অথচ সেই ভাবে শিলিগুড়ির ছেলেরা সুযোগ পেল কোথায়? ইন্টার ডিস্ট্রিক্টে অনেকেই ভাল খেলেছে। তাদের জায়গা হয়নি। সিএবি লিগে খুব ভাল খেলেছে আমাদের জেলার ভূমিপুত্র রাজকমল প্রসাদ ও সনু কুমার। অথচ তাদেরও জায়গা হল না। এই টুর্নামেন্টে জায়গা পাওয়ার জন্য মাপকাঠি কি, সেটাই বুঝতে পারছি না। আমরা হতাশ। আগামী বছর থেকে যাতে জেলার যোগ্য ক্রিকেটাররা সুযোগ পায় সেটা যেন সিএবি কর্তারা ভাবনা চিন্তা করেন।”
অবশ্য দল গড়ার ক্ষেত্রে ফ্রাঞ্চাইজির মালিকরাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কোনও এক জেলা ক্রীড়া সংস্থার সচিব(নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এই বিষয়ে ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে বলছিলেন,”ফ্রাঞ্চাইজি দলের কর্তারা যদি জেলার যোগ্য ক্রিকেটারদের না নেন তাহলে কিছু করার নেই। আইপিএলে কেকেআর টিমে কোনও বাঙালি ক্রিকেকারকে দলেই নেয়না। বেঙ্গল প্রো লিগেও তাই হচ্ছে। কিছু করার নেই। তারা টাকা দিয়ে দল করছে, তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।”
রাঢ় এলাকার একটি জেলার এক সিনিয়র কর্তা অবশ্য ফ্রাঞ্চাইজির মালিকদের সমর্থন করে বলেন,”শুধু বাঙালি বাঙালি করে চিৎকার করে লাভ নেই। কোন দিন বাংলা দলে ভিন রাজ্যের ক্রিকেটারর ছিল না? ৩৫ বছর আগে যখন আমরা রনজি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম তখন বাংলা দলে কতজন ভিন রাজ্যের ক্রিকেটার ছিল দেখে নিন। ভিন রাজ্যের ক্রিকেটার নিয়ে যে ইস্যু তৈরি করা হচ্ছে সেটা ঠিক নয়। ভিন রাজ্যের ক্রিকেটারদেরও প্রয়োজন। কিছু করার নেই।”
এদিকে, জেলার এক কর্তা জানালেন,বেঙ্গল প্রো টি২০ টুর্নামেন্টের দুই একটি ফ্রাঞ্চাইজি নাকি ইতিমধ্যে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। কারণ তারা যে সাড়ে চার কোটি টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকা খরচ করেছেন তার রিটার্ন কিছুই পাচ্ছেন না। কোনও মাইলেজ পাচ্ছে না। গত সপ্তাহ থেকে খরচ কমানোর জন্যই নাকি মহিলা দলের কয়েকটি ফ্রাঞ্চাইজি হোটেলের খাবার বন্ধ করে সংশ্লিষ্ট ক্রিকেটারদের দিন পিছু দুই হাজার টাকা করে দিয়ে দিচ্ছে। জেলার সেই কর্তাটির দাবি,কয়েকজন মহিলা ক্রিকেটার তাঁকে ফোন করে এমনটাই জানিয়েছেন। ‘ইনসাইড স্পোর্টস’ অবশ্য এই তথ্য যাচাই করেনি। তবে এটা নিশ্চিত কয়েকটি ফ্রাঞ্চাইজির শুরুতেই মোহভঙ্গ হয়েছে। তারা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন। সব মিলিয়ে প্রথম বছরেই হোঁচট খেয়েছে বেঙ্গল প্রো টি২০ ক্রিকেট। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী বছর এই টুর্নামেন্ট সাফল্য পায় কিনা সেটাই দেখার বিষয়।