ড্রাগের রমরমা,মাঠ আছে খেলা নেই, ব‍্যর্থ ডিএসএ, খেলাকে ফেরাতে মরিয়া মালদা ক্লাব

0

সন্দীপ দে ◆ মালদা

কালিয়াচকের নরপতি সাহা। সাতের দশকে মালদা জেলার দুর্ধর্ষ স্ট্রাইকার। মাঠে তাঁর সঙ্গী ছিল কালিয়াচকের আর এক হাপের ফুটবলার দিবস কুমার সিনহা। যিনি সাতের দশকে শুরুতে কলকাতার এরিয়ান ক্লাবে চুটিয়ে খেলেছেন। নরপতি-দিবস জুটির খেলা দেখতে মাঠে ভিড় করত ক্রীড়াপ্রেমিরা। দিবস এখনও কালিয়াচকের একমাত্র ফুটবল কোচিং ক‍্যাম্প নিয়ে আছেন। তবে নরপতির শেষটা ছিল মর্মান্তিক। খেলা ছাড়ার পর কোনও চাকরি জোটেনি নরপতির। হতাশায় হেরোইন, চরসের নেশায় বুঁদ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতেন। হেরোইনের নেশা করেই মৃত‍্যু হয় ফুটবলার নরপতির।

মালদা জেলার যুব সমাজের একটা অংশ হেরোইন,চরসে আশক্ত। অভিযোগ কলেজ এমনকি স্কুলের ছাত্রদের মধ‍্যে ছড়িয়ে পড়ছে এই নেশা। ফলে নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ মাঠে খেলতে আসে না। মালদহর কালিয়াচক কুখ‍্যাত দুটি কারণে। এক) পোস্তর চাষ। পোস্তর আঠা সংগ্রহ করে তৈরি হয় আফিম। আর তা থেকেই হেরোইন, চরস। দুই) জাল টাকার রমরমা ব‍্যবসা। এই দুটোই চলে কালিয়াচকে। পুলিশ প্রশাসন এই অবৈধ ব‍্যবসা আটকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
মালদাকে উত্তরবঙ্গের গেট ওয়ে বলা হয়। খেলাধূলার মুখ হতে পারত। ব‍্যবসা করার খুব ভাল জায়গা। যোগাযোগ ব‍্যবস্থা, মিক্সড কালচার, উন্নতমানের হোটেল সব আছে। এই মালদায় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড, সিএবি, অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন ও আইএফএ-এর অন‍্যতম ভেন‍্যু হতে পারত। কিন্তু ক্রীড়া ক্ষেত্রে দক্ষ সংগঠকের অভাবে মালদা আজ বঞ্চিত, অবহেলিত।

এই শহরে এবিএ গনিখান চৌধুরী একটা মিথ। তাঁর উদ‍্যোগে এই জেলায় প্রথম তৈরি হয়েছিল স্টেডিয়াম। গনিখান যখন কৃষি ও বিদ‍্যুৎ মন্ত্রী ছিলেন তখন কৃষি ও বিদ‍্যুৎ বিভাগে দুটি ফুটবল দল তৈরি করেছিলেন। এই দলে যারা খেলতেন তাদের প্রত‍্যেককে চাকরি দিয়েছিলেন গনি সাহেব। আবার তিনি যখন রেলমন্ত্রী তখন এই জেলার ফুটবলের ফুটবলের প্রসার ও প্রচারের জন‍্য নিয়ে এসেছিলেন ভারতের তিন কিংবদন্তি ফুটবলার তুলসীদাস বলরাম, নিখিল নন্দী ও অরুণ ঘোষকে। জেলা ফুটবল দলকে কোচিং করানোর জন‍্য নিখিল নন্দীকে ৬ মাস মালদায় রেখেছিলেন গনিখান চৌধুরী।
এই জেলায় ৬ টি স্টেডিয়াম আছে। ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ‍্যাসোসিয়েশনের (ডিএসএ) স্টেডিয়াম ছাড়াও আছে মাধবনগর মাঠ, বৃন্দাবনী, রেল, রতুয়া, গাজল এবং চাঁচলে স্টেডিয়াম আছে। কিন্তু খেলা নেই। অতীতে একটা সময় বিখ‍্যাত কোহিনুর কাপ হত। বহু বছর তা বন্ধ। এখন নামকে ওয়াস্তে জেলা লিগ হয়। আর হয় গুড মর্নিং ক্লাবের পরিচালনায় হয় মশালা টুর্নামেন্ট। কলকাতা থেকে কিছু ক্লাব দল আনা হয়। আর ফাইনালের দিন বলিউডের নামি দামি শিল্পীদের আনা হয়। অতিথি হিসেবে ঘুরে গিয়েছেন গুলশন গ্রোভার, সুনীল শেঠি, প্রশেনজিতরা। এই মশলা টুর্নামেন্টে উড়ে লক্ষ লক্ষ টাকা। বিন্দাস স্ফূর্তি।


এই জেলায় খেলাধূলা পিছিয়ে পড়ার বড় কারণ হল ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ‍্যাসোসিয়েশনের অযোগ্য কিছু কর্তা। দীর্ঘদিন ধরে এই ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ‍্যাসোসিয়েশনের সচিব ছিলেন শুভেন্দু নারায়ণ চৌধুরী। ইনি তৃণমূল সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু নারায়ন চৌধুরীর দাদা। কয়েকমাস আগেই শুভেন্দুর মৃত‍্যু হয়েছে। তাঁর জায়গায় ডিএসএ সচিব পদে বসেছেন কৃষ্ণেন্দুবাবু। গোটা মালদায় ভয়ঙ্কর প্রভাব আছে এই কৃষ্ণেন্দুবাবুর। ডিএসএ সচিবর ভূমিকা নিয়ে গত তিনদিনে প্রায় ৩০ জনের মুখোমুখি হয়েছিল ‘ইনসাইড স্পোর্টসে’র এই সাংবাদিক। ভয়ে কেউ মুখ খোলে না। তবু বুধবার সকালে মালদা শহরের ফোয়ারা মোড়ে ( অনেকে পোষ্ট অফিস মোড়ও বলে) একজনকে পেয়েছিলাম। তিনি নিজের নাম বলেননি। ফোয়ারা মোড়ের অস্থায়ী চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে বলছিলেন,”বেশ তো কলকাতায় ছিলেন। এখানে কেন এসেছেন? ঠান্ডা উপভোগ করুন। পরিবারের জন‍্য আমসত্ব নিয়ে যান। বেশি কিছু লিখতে যাবেন না। লিখেও কিচ্ছুটি করতে পারবেন না। একটা সত‍্যি কথা বলে রাখি, শুভেন্দু কৃষ্ণেন্দু এই দুই ভাই খেলা নিয়ে ভাবলো না। করলে অনেক কিছুই করতে পারে। কিন্তু কিছুই করেনি।”
কিছুদিন আগে নিজের প্রয়াত দাদার নামে স্টেডিয়ামের নামকরণ করে বিতর্ক হয়েছিল। ক্রীড়া জগতে শুভেন্দুর কোনও অবদান নেই। তবু তাঁর নামে স্টেডিয়াম? ভাবাই যায় না।
দাদার নামে স্টেডিয়াম বিতর্ক হওয়ার পর ড‍্যামেজ কন্ট্রোলে নেমেছেন কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী?

“ইনসাইড স্পোর্টস”কে কৃষ্ণেন্দুবাবু জানালেন, “রাজ‍্য সরকার দুকোটি টাকা সংস্থাকে দিয়েছে। সেই টাকা দিয়েই খোলনলচে বদলে ফেলা হবে। পরিকাঠামো তৈরি হবে। নতুন প্রজন্মর একটা অংশের মাদকাশক্ত হওয়ার কারণ হিসেবে বললেন,”সামাজিক ব‍্যাধি”। ডিএসএ-র ফুটবল কোচিং ক‍্যাম্প নিয়ে তিনি বলেন,মালদা ক্লাবের ফুটবল ক‍্যাম্পটাই তো তাদের সিস্টার কনসার্ন। ডিএসএ – এর কর্তাদের(নাম প্রকাশ‍্যে অনিচ্ছুক) কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল কৃষ্ণেন্দুবাবুর তথ‍্য ঠিক নয়।

ডিএসএ-এর ব‍্যর্থতায় এই জেলার খেলাধূলা যখন প্রায় শেষ হতে বসছে তখন নিজেদের উদ‍্যোগে খেলাকে ফেরাতে মরিয়া মালদা ক্লাব। এই ক্লাব প্রতিষ্ঠা হয় ১৯০২ সালে। এটা মূলত রিক্রেশন ক্লাব। সাতের দশকে এই ক্লাবের একশো বছরের বিলিয়ার্ডস বোর্ডে বোমা ফেলে বিদ্রোহ করেছিল নকশাল নেতারা। এই ক্লাব বুর্জুয়ার ক্লাব। এই আওয়াজ তুলে মালদা ক্লাবকে শেষ করতে চেয়েও পারেনি নকশালরা।

মালদা ক্লাব কর্তারা এখন নতুন প্রজন্মর কাছে আশার আলো। টেবল টেনিস, ক্রিকেট, লন টেনিস এবং গত দুই মাস হল ফুটবল কোচিং ক‍্যাম্প তৈরি করেছে। ফুটবল ক‍্যাম্প শুরু হতেই ব‍্যাপক সাড়া পড়েছে। প্রায় দেড়শো ছাত্র। এই ক্লাবে সভাপতি ডিএম রাজর্ষি মিত্র। সহসভাপতি হলেন জেলার এসপি অলোক রাজোরিয়া। এরা প্রত‍্যেকে ক্লাবের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। বুধবার সকালে ক্লাবেই পরিচয় হল এসপি অলোকবাবুর সঙ্গে। টেনিস কোর্টে নামার আগে এই সাংবাদিককে এসপি বললেন,” আমাদের এই ক্লাব খেলা নিয়ে খুব ভাল কাজ করছে। আপনারা লিখুন।” এসপি নিজের ছেলেকে ফুটবল ক‍্যাম্পে পাঠান। আদিবাসী ছেলেদের সঙ্গে দিব্বি ফুটবল খেলছেন এসপি পুত্র। মায়েরা নিজের ছেলে-মেয়েদের ফুটবল শেখাতে মাঠে নিয়ে আসছেন। যা এই জেলা ফুটবলের পক্ষে ভাল বিজ্ঞাপন।

গত দুই মাসে এই ফুটবল ক‍্যাম্পে যোগ দিয়েছে প্রায় দুশো ছাত্র। কুশমন্ডিতে নিজের খরছে একটি ফুটবল ক‍্যাম্প চালান প্রাক্তন ফুটবলার ও এনআইএস ডিগ্রি কোচ শিবশঙ্কর পাল। তাঁর ডেডিকেশন দেখে মালদা ক্লাব কর্তারা শিবশঙ্করকেই চিফ কোচ করেছেন। তার অধিনে আছেন আরও পাঁচজন কোচ। পরিকাঠামো বেশ ভাল। সব ঠিক চললে আগামী দু তিন বছরেই উঠে আসবে ভবিষ্যতের ফুটবলার। ডিএসএ যা করতে পারেনি তা করে দেখাচ্ছে মালদা ক্লাব।
“আমাদের এখন লক্ষ‍্য জেলার খেলার প্রসার ঘটানো। আমাদের যে সব ক‍্যাম্প আছে সবাই অংশ নিতে পারে। ওপেন টু অল। আমরা প্রখ‍্যাত কোচ জহর দাসকে এনেছিলাম। ওনার পরামর্শ মেনেই আমরা ক‍্যাম্পের ছেলে-মেয়েদের মেডিকেল টেস্ট করানো হবে। ডিএসএতে কৃষ্ণেন্দু নারায়ন চৌধুরী সচিব হয়েছেন। তিনিও চেষ্টা করছেন ভাল কিছু করার। আর আমরা সবাই খেলাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। খেলাধূলার চর্চা বাড়াতে হবে। বেশি করে ছেলে-মেয়েদের মাঠমুখো করতেই হবে। আমাদের নানান পরিকল্পনা আছে। আশাকরি আমাদের জেলার খেলাধূলার জগতে ভাল কিছু দেখতে পাবেন।” কথাগুলি প্রত‍্যয়ের সঙ্গে বলছিলেন মালদা ক্লাবের সচিব কিশোর ভগত। এই ক্লাবের সব কর্তার এখন একটাই লক্ষ‍্য – মালদার ক্রীড়া জগতের সোনালী অতীতকে ফিরিয়ে আনা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here