নাগেরবাজারে বস্তাবন্দি অবহেলিত অমল দত্তর বহু নথি
সন্দীপ দে • উৎপল চন্দ্র
বাগুইআটির জোড়া মন্দিরে পৌঁছে যদি খোঁজ করেন ফুটবল কোচ অমল দত্তর বাড়িটা কোথায়? যে কেউ দেখিয়ে দেবে। জ্যাঙ্গড়া চৌরাস্তার পরের স্টপ গোবিন্দ নিবাসের খেলার মাঠ। মাঠের ঠিক উল্টো দিকের দোতালা বাড়ি। গ্রিলের গেটের ডান দিকে নাম ফলকে লেখা – ‘অমল দত্ত, ফুটবল কোচ, টি-৮৫ রাজারহাট রোড, কলকাতা ৭০০০৫৯।
এই ফলকটা এক বছর আগেও ছিল। এখন ফলক তো দুরের কথা, বাড়িটাই নেই। ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। গত সোমবার দুপুরে অমল দত্তর মাটিতে মিলিয়ে যাওয়া বাড়িটার ছবি তুলছি, পাস থেকে এক অবাঙালি ছাতু বিক্রেতা বলে উঠলেন,”বাবু, ছবি তুলে আর কি করবেন। অমল সাহাবকো সাথ হিস্ট্রিভি চলা গ্যায়া।” ২০ বছর আগে বিহার থেকে আসা ওই ছাতুর সরবত বিক্রেতাও ডায়মন্ড কোচের মাহাত্ব বুঝেছেন। আর ওঁরা….?
অমল দত্তর মৃত্যু হয়েছে ২০১৬ সালের ১০ জুলাই। তারও দেড় বছর পর তাঁর স্ত্রী আরতী দত্তর মৃত্যুর পর থেকেই বাড়ির দখল নিয়ে তীব্র অশান্তি শুরু হয় অমল পুত্র আশিস (হিটু) ও কন্যা নূপুরের মধ্যে। শেষ পযর্ন্ত বাড়িটি তাঁরা বিক্রি করে দেন শিলংয়ের জনৈক ব্যবসায়ী সিংহানিয়াকে। বাড়িটি পুরো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। প্রোমোটার সিংহানিয়া সেখানে তৈরি করবেন গেস্ট হাউস। অবাক কাণ্ড হল, কোচ অমল দত্তর বহু নথি, জার্সি, স্মারক, শারীরিক কসরত করার কিছু যন্ত্র পড়ে আছে নাগেরবাজারের স্বামীজি স্মৃতি সংঘর ক্লাবে। খবরটি পেয়ে ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-এর প্রতিনিধি পৌঁছে যায় এই ক্লাবে। দেখা যায়, ক্লাবের খোলা বাঙ্কে বস্তাবন্দি হয়ে পড়ে আছে প্রয়াত ‘ডায়মন্ড কোচে’র বহু জিনিস। বহু মূল্যবান বইও আছে।
স্বামীজি স্মৃতি সংঘর ক্লাবের সভাপতি গৌতম বসু ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে জানান,”অমলদা আমাকে ছেলের মত ভালবাসতেন। বাড়িটি বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর হিটু (অমল দত্তর ছেলে) অমলদার এই ব্যবহার করা জিনিস গুলো রেখে গিয়েছে। আমরা ভাবছি, অমলদার নামে আমাদের ক্লাবে একটা মিউজিয়াম করে তাঁর নথিগুলি রাখবো।” প্রায় এক বছর ধরে বস্তাবন্দী হয়ে আছে। ভাবাই যায় না।
অমল পুত্র আশিস দত্তর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন,”আমি এখন ছোট্ট ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকি। ঘরে জায়গার অভাব। বাবার কিছু জিনিস আমার কাছে রাখা আছে। আর বাকিটা নাগেরবাজারে রেখে দিয়েছি। এরপর কি হবে জানি না।” শোনা গিয়েছে,কিছু বই বিক্রিও করে দেওয়া হয়েছে।
আপনাদের বাড়িটা তো ফুটবলের ইতিহাস। বাংলার এমন কোনও ফুটবলার নেই যে আপনাদের বাড়িতে আড্ডা দেননি। কত কত স্মৃতি। হঠাৎ বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ার কারণ জানা যেতে পারে? উত্তরে আশিস ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে জানালেন,”দেখো সন্দীপ, বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তখন থেকেই বলে আসছিলাম, বাড়িটা নতুন করে সংস্কার করতে হবে। তুমি যদি আমার নামে করে দাও তাহলে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে সংস্কারের কাজ শুরু করতে পারি। কারণ, আমাদের বাড়িটা একটু নিচুতে। একটু বৃষ্টি হলেই ঘরে জল ঢুকে যায়। নিচের তলাটা ড্যাম হয়ে গিয়েছিল। বাবা চলে গেলেন, মা চলে গেলেন। তারপর থেকেই বাড়ির অধিকার নিয়ে দিদির চাপ আসতে থাকল। প্রায় লোক পাঠিয়ে বলা হত, বাড়িটি বিক্রি করে অর্ধেক টাকা দিদিকে দিয়ে দিতে। ফ্যামিলির অশান্তির কথা আর কি বলব। হয়তো তুমি বা অনেকেই বলবেন যে বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে পারলাম না। বিশ্বাস করো সন্দীপ, খুব চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি। এখন সমালোচনা শুনতে হবে জানি। কি আর করব।”
আমরা অমল দত্তর কন্যা নূপুরের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারিনি।
প্রাক্তন ফুটবলার মিহির বসু বলছিলেন,”অমলদার বাড়িতে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যেদিন শুনলাম বাড়িটা বিক্রি হয়ে গিয়েছে, খুব খারাপ লেগেছিল। কিন্তু এটা তো ওদের পারিবারিক ব্যাপার। তবে পরামর্শ চাইলে এগিয়ে আসতে পারতাম।”
কারও পরামর্শ চাওয়ার ব্যাপারে আশিস বললেন,”আমি মানসিকভাবে ভাল জায়গায় ছিলাম না। বাড়ি বিক্রির খবর শুনে একদিন ইস্টবেঙ্গল ক্লাব থেকে নিতুদা আমাকে ফোন করেছিলেন। কেন আগে আমি বলিনি? কেন ভাস্কর গাঙ্গুলি ,মিহির বসুকে বলিনি? আমি সেদিন নিতুদাকে আমাদের সমস্যার কথা বলেছিলাম।”
আশিস দত্তর কাছে জানা গেল, অমল দত্তর বহু মূলবান জিনিসের খোঁজ নেই। যেমন, সাতের দশকে প্রজেক্টর ঘারে করে বয়ে নিয়ে গিয়ে বিদেশি ফুটবল দেখাতেন অমল দত্ত। অমল দত্তর সেই প্রজেক্টরের মধ্যে দিয়ে বাংলার ফুটবল মহল প্রথম বিদেশি ফুটবলের স্বাদ পেয়েছিল। সেই প্রজেক্টর, ফিল্ম কি আছে?
আশিস জানান, ফিল্ম গুলো আর নেই। কোচিং কোর্স সহ বেশ কিছু ফুটবলের ডকুমেন্টারির ফিল্ম থেকে ডিভিডি করেছিলেন বাবা। কিন্তু সেগুলি খুঁজে পাচ্ছি না। আর প্রজেক্টরও হারিয়ে গিয়েছে। আমার ভাড়া বাড়িতে কিছু জিনিস আছে।”
আইএফএ-এর কাছে ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-এর আবেদন, অমল দত্ত, পি কে ব্যানার্জি, অচ্যুৎ ব্যানার্জি, দূখীরাম মজুমদা,বাঘা সোমদের মত কিংবদন্তিদের নথি নিয়ে একটা মিউজিয়াম করুক। যাতে বাংলার ফুটবলের নিয়ামক সংস্থার দফতরে গেলে তরুণ প্রজন্ম জানতে পারবে বাংলার ফুটবলের কিংবদন্তিদের।