◆সন্দীপ দে◆
“দোলের দিন সন্ধ্যায় বাড়িতে চলে আই। বসে কথা হবে।” তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে ফোন করতেই গত বৃহস্পতিবার ফোন কথা গুলি বলেছিলেন সুব্রত ভট্টাচার্য। দোলের সন্ধ্যায় যখন তাঁর গলফগ্রীনের বাড়িতে পৌঁছলাম,তার একটু আগে জামাই সুনীল ছেত্রী শ্যালক সাহেবের সঙ্গে বেড়িয়ে গিয়েছেন। দুধ সাদা রংয়ের পায়জামা,ফতুয়া গায়ে নিজের পছন্দের ড্রয়িং রুমে বসেছিলেন ময়দানের অতি বিতর্কিত এবং জনপ্রিয় (এখনও) বাবলু ভট্টাচার্য সোফায় বসেছিলেন। এই প্রতিবেদককে দেখেই হাসতে হাসতে বলতে শুরু করলেন,”আমার কাছে কেন? কি চাই তোর? আমি তো ফুটবলে আর নেই। আমাকে তোর কি দরকার? অনলাইনে না অফ লাইনে কি সব লিখছিস শুনলাম। বাংলার ফুটবল বাঁচবে?” লাইটার দিয়ে “৫৫৫” ধরিয়ে সুব্রত ভট্টাচার্যের সেই পুরনো স্টাইলে,চেনা মেজাজে।
প্রশ্ন : কোনও ভনিতা করছি না। সরাসরি আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, মোহনবাগান ক্লাব প্রশাসনে অন্যায় দেখলেই তো সোচ্চার হন। বাইরে থেকে বিদ্রোহ না করে ক্লাব নির্বাচনের লড়াইয়ে সুব্রত ভট্টাচার্যকে দেখা গেল না কেন? হেরে যাওয়ার ভয়? আপনাকে চাইছে না? সংগঠনের কাজে আত্মবিশ্বাসের অভাব? কোনটা? বলবেন প্লিজ।
সুব্রত ভট্টাচার্য : কিসের ভয়? আমাকে টুটুদারা তো চাননি। আজ থেকে ৮/৯ বছর আগে মোহনবাগান ক্লাব নির্বাচনে দাঁড়ালাম। কি হল? আমার থেকে সত্য (সত্যজিৎ চ্যাটার্জি) বেশি ভোট পেয়ে জিতে গেল। টুটুদাদের নির্দেশে এক রাজনৈতিক নেতা আমাকে হারিয়ে সত্যকে জিতিয়েছিল। আজ আর সেই নেতার নাম আমি বলছি না। কে বা কারা এই সব নোংরামি করে আমাকে হারিয়েছিল সব জানি। এত নোংরামি দেখেছি তাই আর ক্লাব প্রশাসনে যেতে ইচ্ছে করে না। চেষ্টাও করি না। আমি সত্যজিতদের মতো সমঝোতা করে পদ পেতে চাই না।
প্রশ্ন : টুটু বসুরা আপনাকে চায়নি?
সুব্রত ভট্টাচার্য : আমাকে ক্লাব থেকে সরানোর পিছনে টুটু দা,অঞ্জনদা,টুম্পাইদের হাত ছিল। প্রয়োজনে টুটুদারা আমাকে নানা ভাবে ব্যবহার করেছে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই আমাকে ছুঁড়ে ফেলেছে। অনেক হেনস্থা করেছে। তবে এটাও স্বীকার করছি,টুটুদা ক্লাবে অনেক টাকা ঢেলেছে। এটা ওঁর একটা ভাল দিক। কিন্তু আমার সঙ্গে যা করেছে তা কখনও ভুলতে পারবো না।
প্রশ্ন : টুটু বসুরা আপনাকে ক্লাব প্রশাসনে চায়তেন না কেন?
সুব্রত ভট্টাচার্য : আমার জনপ্রিয়তা ওঁরা পছন্দ করত না। আমার উপস্থিতি টুটুদাদের সমস্যা হত। তাই কিভাবে আমাকে তাড়ানো যায় সেই চেষ্টাই করে গিয়েছে। আমি মোহনবাগানে ১৭ বছর ৫ মাস খেলেছি। ইস্টবেঙ্গলের বড় অঙ্কের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি বহুবার। সত্য ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকায় সই করল আর আমি ৩৮ হাজারেই থেকে গেলাম। ক্লাবকে ভালবেসে। মোহনবাগানের প্রতি আমার ভালবাসার ওরা কেড়ে নিতে পারবে না। ক্লাব প্রশাসনে কেন বার বার মানস-বিদেশ-সত্যজিৎ আসবে। এরা ক্লাবে এসে কি করেছে? কেন অন্য ফুটবলাররা সুযোগ পাবে না? এরা লোক ধরে পদে বসেছে। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি মানস-বিদেশ-সত্যজিৎকে দিয়ে মোহনবাগানের কোনও উন্নতি হবে না। এতদিন ধরে তো ওরা আছে। কি উন্নতি করেছে? আশাকরি সমর্থকরাও বুঝতে পারছেন। সত্যজিৎ বরাবর শৈল -বীরুকে ধরে খেলে গেল। একটা মরসুম দেখা,যে ফুটবলার সত্যজিৎ একটা মরসুমে একাই মোহনবাগানকে সাফল্য এনে দিয়েছে? ও বরাবর লোক ধরে খেলেছে। এখনও তাই। কারও উপকারে এসেছে? হাজার অনুরোধ সত্বেও মোহনবাগান ছেড়ে মহমেডানে চলে গিয়েছিল মানস-বিদেশ। পরে আবার নিজের প্রয়োজনে ফিরে এসেছিল। এরা মোহনবাগানি? এই ফুটবলাররা কোনও দিন সততার সঙ্গে কাজ করেনি।
প্রশ্ন : মানস ভট্টাচার্য,বিদেস বসু,সত্যজিৎরা কিছুই করেননি?
সুব্রত ভট্টাচার্য : কি করেছে? বল আমায়। চূনী গোস্বামীকে প্লেয়ার্স সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান করেছিলেন ধীরেনদা। আমি তখন বিএনআরে খেলছি। একদিন হটাৎ আমার শ্যামনগরের বাড়িতে গিয়ে চূনীদা আমাকে মোহনবাগানে নিয়ে এসেছিলেন। আমি হলফ করে বলতে পারি, ধীরেনদা আজ থাকলে মানসদের আজ ক্লাবে কোনও জায়গা হত না।
প্রশ্ন : আপনি যাই বলুন না কেন,তবু তো এঁদেরকেই ডাকা হচ্ছে। তারমানে কোথাও অগ্রাধিকার পাচ্ছেন। এই যেমন সারা ভারত তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্লাব এবার কলকাতা লিগে খেলতে চলেছে। অভিষেক কিন্তু তাঁর নিজের ক্লাবের সচিব করেছেন মানস ভট্টাচার্যকে।
সুব্রত ভট্টাচার্য : তোদের “ইনসাইড স্পোর্টস”-এ খবরটা দেখেছি। আরে বাবা,অভিষেক তো নিজে ফুটবল দল গড়বে না। কিন্তু যাদের দায়িত্ব দিয়েছে সেটা অভিষেকের ভুল সিদ্ধান্ত। কখনও মুখ্যমন্ত্রী বা অভিষেকের সঙ্গে আমার দেখা হলে বলব, এই সব প্লেয়াররা কোনওদিন সততার সঙ্গে কাজ করেনি। যে ভাবে ওদের কাজ দেওয়া হচ্ছে তা মানতে পারছি না।
প্রশ্ন : এই যে কলকাতা লিগে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফুটবল ক্লাব খেলবে। এতে বাংলার ফুটবলের পক্ষে ভাল নয়?
সুব্রত ভট্টাচার্য : কিসের ভাল জানি না। আইএফএ-এর ভাল হতে পারে। নতুন অ্যাফিলিয়েশনের জন্য কিছু টাকা পাবে আইএফএ। কিন্তু অভিষেক যাদের দায়িত্ব দিয়েছে সেটা ভুল সিদ্ধান্ত। বাংলার ফুটবলের জন্য ওই আলো-নবাবরাই যা একটু করছে। আর লোক কোথায়?
প্রশ্ন : আপনার বিরদ্ধে অভিযোগ,আপনি বড্ড বেশি স্পষ্ট কথা বলে ফেলেন। আপনার মুখটাই হল শত্রু। এটা কি আপনি মানেন?
সুব্রত ভট্টাচার্য : হয়তো। কারণ আমি অন্যায় দেখলে মুখ বন্ধ করে থাকতে পারি না। উচিৎ কথা স্পষ্ট করে বলে ফেলি। সমঝোতা করতে পারি না। তাতে যদি আমি কাজ না পাই তাতে দূঃখ নেই।
প্রশ্ন : অগ্রজ ক্রীড়া সাংবাদিকদের কাছে শুনেছি, ধীরেন দে ফুটবলারদের বা কোনও কর্তাদের নাম মুখে আনতেন না। “এই ছেলে” বা “ওই কালো ছেলেটি (বিদেস বসু) গোল করেছে।” যেন তিনি নামে চিনতেন না। এই স্টাইলটা আপনার মধ্যেও আছে। আপনি নাম ধরে ডাকেন না। ধীরেন দেকে নকল করেন? নাকি অন্যকে তাচ্ছিল্য?
সুব্রত ভট্টাচার্য : (হাসতে হাসতে বলছিলেন) না না। সেই রকম কিছু নয়। আমি কাউকে নকল করতে যাব কেন? ওটা আমার হয়ে যায়। তবে যারা অসৎ,নিজের স্বার্থ নিয়ে চলে। তাদের আমি সচেতনভাবেই নাম নিই না।
প্রশ্ন : আপননি যখন কথা বলেন,আড্ডা মারেন তখন কথায় কথায় “আমিত্ব” সামনে এসে পড়ে। এটাও কি সচেতন ভাবে করেন? অন্যরা নিজেদের ছোট মনে করে,এটা কি বুঝতে পারেন না?
সুব্রত ভট্টাচার্য : আড্ডায় যখন কথা বলি তখন ফুটবল এলেই আমার পারফরমেন্স প্রসঙ্গ ওঠে। তখন আমি নিজের কথা বলি। সচেতনভাবে আমি কাউকে ছোট করি না।
প্রশ্ন : দেবাশিস দত্ত মোহনবাগানের সচিব হতে যাচ্ছেন। পাশাপাশি সৃঞ্জয় বসু ক্লাব ছেড়ে চলে গেলেন। এমন পরিস্থিতি দেখার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কি?
সুব্রত ভট্টাচার্য : সৃঞ্জয় কেন ক্লাব ছাড়ল তার কারণ জানি না। আর দেবাশিষ দত্তই তো বহু বছর ক্লাবটা চালিয়ে আসছে। সচিব দেবাশিসের মূল্যান পরে হবে।
প্রশ্ন : শোনা যায়,ধীরেন দের টাই ধরে হেনস্থা করেছিলেন অঞ্জন মিত্র। তিন বছর আগে অঞ্জন মিত্রকে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল। সেই বছর অঞ্জনবাবুর ক্ষমতাও চলে গিয়েছিল। বসু পরিবার আপনাকে হেনস্থা করে সরিয়ে দিয়েছিল। আপনার দাবি। এবার সেই “বসু”পরিবার আপাতত ক্ষমতার বাইরে। এ যেন ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে।
সুব্রত ভট্টাচার্য : মোহনবাগান জনতা দেখছেন। সবাই দেখছে। ভবিষ্যৎ বলবে। তবে আবার বলছি সৃঞ্জয়ের থাকা উচিৎ ছিল।
প্রশ্ন : এখন কিভাবে সময় কাটছে আপনার? ফুটবল নিয়ে কিছু ভাবনা চিন্তা করছেন?
সুব্রত ভট্টাচার্য : সেই ভাবে কিছু করছি না। কাজ করার সুযোগ আর পেলাম কোথায়? আমাদের শ্যামনগরে আমার নামে একটা ফ্যান ক্লাব আছে। ওখানে বাচ্চা ছেলেদের ফুটবল শেখানো হয়। আমি প্রতি রবিবার সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করি। বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করার এখনও স্বপ্ন দেখি। কিন্তু পেশাদার ভাবে কাজ করার সুযোগ নেই।
প্রশ্ন : শেষ প্রশ্ন। আপনার দেখা সেরা মোহনবাগানের তিন জন কর্তার নাম বলুন
সুব্রত ভট্টাচার্য : আমি চারজন কর্তার নাম বলছি। ধীরেন দে, সি এম রায়, আর কে তিওয়ারি এবং শৈলেন মান্না।