◆সন্দীপ দে◆
৯০-এর দশকে সুব্রত ভট্টাচার্যকে কোচ করে ময়দানে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ ফুটবল দলের কর্তারা। দলের স্বার্থে, ভাল কিছু করার স্বার্থে রাজ্য পুলিশ দলের কর্তারা তখন যেন সবাই এককাট্টা। সেই সময় পূলিশের ফুটবল দল নিয়ে প্রতিপক্ষ দলগুলি ভাবনা চিন্তা করত। সেই সব দিন এখন আর নেই। যত দিন যাচ্ছে ততোই যেন একটা জায়গায় আটকে আছে পুলিশের ফুটবল।
কলকাতা ফুটবল লিগে পুলিশের তিনটি ফুটবল দল। ১) ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ (রাজ্য পুলিশ) ২) পুলিশ অ্যাথলেটিক ক্লাব ৩) ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাব। একটা সময় ফুটবল খেলে স্পোর্টস কোটায় পুলিশে চাকরি পেতেন ফুটলাররা। ফলে নতুন মরসুমের জন্য পুলিশের দল করতে সুবিধে হত। এখন সেই সুযোগ নেই। বামফ্রন্ট জমানার শেষ দিকের সময় থেকে ফুটবল খেলে পুলিশে চাকরি পাওয়ার সুযোগটা বন্ধ হয়ে যায়। যারা পুলিশে চাকরি করে ফুটবল খেলেন তাঁদের বয়স বেড়ে গিয়েছে। বদলি হয়ে গিয়েছে জেলায়। ফলে বাইরে থেকে কোনও রকমে দল তৈরি করে পুলিশ। বর্তমানে কলকাতা লিগে পুলিশের ৩ দলের স্ট্যাটাস এই রকম – প্রিমিয়ার ‘বি’ গ্রুপে খেলছে ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ ও পুলিশ অ্যাথলেটি ক্লাব। আর ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাব খেলে ফার্স্ট ডিভিশনে। পুলিশের এই তিনটি ক্লাবের মধ্যে এই ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাব কিছুটা পিছিয়ে। একটা জায়গায় আটকে আছে। ঠিক এই আটকে যাওয়া জায়গাটাতেই ধাক্কা দিয়ে এগোতে মরিয়া ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাবের নবনির্বাচিত সচিব মহাদেব চক্রবর্তী।
১৯৩২ সালে এই ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাবের প্রতিষ্ঠা। ৮৮ বছরের এই ক্লাব থেকে উঠে এসেছেন বিখ্যাত গোলরক্ষক প্রদ্যোৎ বর্মণ, হুসেন মুস্তাফি, অনুপম ঘোষ সহ একাধিক ফুটবলার। মেয়ো রোড আর পার্ক স্ট্রিটের মুখটার কাছে ঝাঁ চকচকে ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাব তাঁবু। এই ক্লাবের ক্রিকেট দল সিএবি লিগের ফার্স্ট ডিভিশনে খেলে। সিএবির প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে সরকারি ভাবে এই ক্লাবের ক্রিকেট দলের মেন্টর। টেবল টেনিস খেলার চর্চাও আছে। লালবাজার গোয়েন্দা বিভাগের শীর্ষস্থানীয় অফিসার মহাদেব চক্রবর্তী সচিব হয়ে ক্লাবটাকে খোলনলচে বদলে ফেলতে বদ্ধপরিকর।
মহাদেববাবু গত ১৬ জানুয়ারি সচিব হয়েছেন। তারপরেই ফুটবল দলটা ভাল করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দলের টিডি নিয়োগ করলেন প্রাক্তন ফুটবলার জামশিদ নাসিরিকে। একই সঙ্গে গোলকিপার কোচ করা হয়েছে আর এক প্রাক্তন নাসির আহমেদকে। গত সোমবার সন্ধ্যায় ক্লাব তাঁবুতেই এই দুই টিডি ও গোলকিপার কোচের হাতে নিয়োগ পত্র তুলে দিয়েছেন ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাবের কর্তারা। আরও দুই প্রাক্তন ফুটবলার ও কোচ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য ও বাবু মানিকেও খুব শীঘ্রই দলের সঙ্গে যুক্ত করতে চলেছেন সচিব মহাদেব চক্রবর্তী।
“আমরা একটা লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। কেউ কখনও একা কিছু করতে পারে না। ক্লাবের সবাই আমরা এক সঙ্গে কাজ করব। আমরা জামসিদ নাসিরি, নাসির আহমেদের মতো দলের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছি। তবে আমাদের পুরনো কোচ বিজয় ঘোষ কিন্তু থাকছেন। নতুন মরসুমের জন্য কোচ, টিডি, গোলকিপার কোচ, ফুটবল সচিবরাই ফুটবলার বেছে নেবেন। ক্লাবের কোনও কর্তা দল গড়ার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবে না। টেকনিক্যাল ম্যানরাই দল তৈরি করবে। আমাদের লক্ষ্য অনেক কিছুই আছে। আপাতত লক্ষ্য প্রিমিয়ারে ওঠা।” মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ক্লাব তাঁবুতে বসে কথাগুলি বলছিলেন ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাবের সচিব মহাদেব চক্রবর্তী।
ক্লাবে কোনও স্পনসর নেই। তবে দল গড়তে অনেকেই সাহায্য করেন বলে জানালেন ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ শান্তনু চ্যাটার্জি। মহাদেববাবুর পাশে বশে শান্তনুবাবু ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে বলছিলেন,”ময়দানে এখন খুব বেশি স্পনসর পাওয়া যায় না। তবে কেউ কেউ সাহায্য তো করেই।” শান্তনু চ্যাটার্জির কথার রেশ ধরেই মহাদেব বাবু বললেন,”টাকা ছাড়া ভালো কিছু করা যায় না। সমস্যা হল, কোভিড সিচুয়েশন। গোটা বিশ্বে আর্থিক মন্দা চলছে। তবু আমরা কয়েকটা কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছি। আশা করছি কিছু একটা হবে।”
ফার্স্ট ডিভিশন ক্লাব। স্পনসর আসবে? কি মনে হয়?
প্রশ্ন শুনে হাসতে হাসতে সচিব মহাদেব এই সাংবাদিককে বলে উঠলেন,”আমার আবার ধনু রাশি, বুঝলেন তো। যাদের ধনু রাশি তারা অনেক কষ্টে এগোনোর চেষ্টা করে। দিনের শেষে সাফল্য পায়। দেখা যাক।” তাঁর চোখে মুখে আত্মবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট।
এই মহাদেব চক্রবর্তী সফল পুলিশ অফিসার। পুলিশে চাকরি করলেও দীর্ঘদিন ক্লাব সংগঠনের যুক্ত (ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাবে সক্রিয় ভাবে এই প্রথম)। দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়ার বিখ্যাত মিতালি সংঘর সচিব তিনি। ক্রিকেটার ফারুক ইঞ্জিনিয়ার থেকে ফুটবলার সুব্রত ভট্টাচার্য, অলোক মুখার্জি, বাবু মানি সহ এক ঝাঁক ফুটবলারকে নিজেদের মিতালি সংঘে নানান প্রকল্পে নিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়,এই মহাদেববাবুর নেতৃত্বে ২০১৯ সালে নিউটাউনের ইকো পার্কে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে গায়ক অরিজিৎ সিংকে এনে অনুষ্ঠান করেছিল গড়িয়ার বিখ্যাত মিতালি সংঘ। ময়দানের খেলোয়াড়দের একটা বড় অংশ মহাদেববাবুর সঙ্গে যোগাযোগ আছে। ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে ক্যালকাটা ক্লাবের নতুন সচিব মহাদেব চক্রবর্তী বলছিলেন,”আমরা শুধু ফুটবল নয়, ক্রিকেট, টেবল টেনিসের উপর নজর দিচ্ছি। ক্লাবে সদস্য হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। তার আগে ক্লাবের পরিকাঠামো বদলে ফেলতে হবে। সদস্যরা ক্লাবে এসে যেন সুষ্ঠুভাবে সমস্তরকম সুবিধা পাই সেটাও আমরা ভাবনা চিন্তা করছি।”
তিনি আরও বলছিলেন, “যখন প্রথম চাকরিতে যোগ দিই তখন মাঝে মাঝে খেলার মাঠে ডিউটি পড়তো। সেই হোপ ৮৬ থেকে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে অনেক ডিউটি করেছি। খেলার ডিউটিতে আলাদা আনন্দ আছে। খেলাটা আমার প্যাশন বলতে পারেন। আমার যা চেহারা তাতে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমি কোনও দিনই খেলোয়াড় ছিলাম না। কিন্তু ক্রীড়া সংগঠনের কাজ করতে ভীষন উপভোগ করি। ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাবে সচিব হওয়ার পর ভাল কাজ করাটা আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ বলতে পারেন।”
এই ক্লাবে খেলে এখন চাকরি পাওয়া যায়? প্রশ্ন শুনে পুলিশ অফিসার, কোষাধ্যক্ষ শান্তনু চ্যাটার্জি বলছিলেন,”গত মরসুমে খেলার শেষে আমরা ৮ ফুটবলারকে সিভিক ভলেন্টিয়ার জব দিতে পেরেছি। আসলে সেই ভাবে স্পোর্টস কোটার চাকরি এখন আর হয় না। অদুর ভবিষ্যতে যদি ফুটবল খেলে হোমগার্ড বা কনস্টেবলে চাকরি দেওয়া যায় তাহলে দল গড়তে অনেকটাই সুবিধা হবে।” শান্তনুবাবু ছাড়াও ক্লাবের ফুটবল সচিব পুলক দত্ত দল নিয়ে খুব সক্রিয়। কর্তারা এখন ফুটবল দল নিয়ে নানান পরিকল্পনা করেছেন। যা এখনই সব বলতে চান না। ধাপে ধাপে এগোতে চান। আপাতত খুব শীঘ্রই দলের নতুন জার্সি উন্মোচন করা হবে।
ময়দানের ফুটবলে আটকে যাওয়া পুলিশ ক্লাব এখন ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। ক্লাবের কর্মীরাও যেন তৎপর।
ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাব তাঁবুতে এখন একটাই রিংটোন, ময়দানে এবার
“খেলা হবে”।