ইনসাইড স্পোর্টসের প্রতিবেদন : জর্জটেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাব মুখী গোটা ময়দান। মিলন উৎসবকে ঘিরে শুক্রবার সন্ধ্যায় গড়ের মাঠের প্রাচীন ক্লাব জর্জটেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাব তাঁবুতে সামিল হয়েছিল কার্যত গোটা ময়দান। এ যেন ময়দানের মহা মিলন। নার্সারি থেকে প্রিমিয়ার ডিভিশনের ক্লাব কর্তাদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। সাম্প্রতিক কালে জর্জটেলিগ্রাফের এই অনুষ্ঠানে অতিথি উপস্থিতির হার সর্বাধিক। ক্রীড়া জগতের নবীন,প্রবীন প্রায় সবাই যেন শুক্রবারের সন্ধ্যায় জর্জমুখী।

প্রতিবছরই পুজোর পর এই ক্লাবে বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। আর এই অনুষ্ঠানকে ঘিরেই গড়ের মাঠের সকলকে নিয়ে হয় মিলন উৎসব। এই বছর দুর্গা পুজো, কালী পুজো হয়ে যাওয়ার পরও বিজয়া সম্মিলনী করা আর হয়ে ওঠেনি। নানান কারণে অনুষ্ঠানটি দেরিতে হওয়ায় জর্জ ক্লাব বিজয়া সম্মিলনী নামটা বাদ দিয়ে মিলন উৎসব রেখেই ময়দানি গেট টুগেদার করে ফেলল। এই বছর জর্জ টেলিগ্রাফের সচিব ও আইএফএ চেয়ারম্যান সুব্রত দত্ত নানান কাজের জন্য ব্যস্ত ছিলেন। তাই জর্জের যুগ্ম সচিব ও আইএফএ সচিব অনির্বান দত্ত মিলন উৎসবের দায়িত্ব নিয়ে বাজিমাত করলেন। মূলত তাঁর ডাকে এই বছরের উৎসব জমজমাট।

সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতায় ছিলেন জর্জ ক্লাবের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি অধিরাজ দত্ত। ছিলেন অনির্বানের ভাই (প্রদ্যোৎ দত্তর ছোট ছেলে) অনিন্দ দত্ত, অধিরাজের বাবা অতীন দত্ত। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে অতিথি আপ্যায়নে সদা ব্যস্ত থাকতে দেখা গেল সুব্রত দত্তকে। উৎসব সুপার হিট।

কে আসেননি! সিএবি সভাপতি স্নেহাশিস গাঙ্গুলি,আইপিএল কমিটির সদস্য অভিষেক ডালমিয়া থেকে সিএবির এক ঝাঁক কর্তা। এসেছিলেন অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন সভাপতি কল্যান চৌবে। তিনি প্রায় ঘন্টা খানেক জর্জ তাঁবুর এই মিলন উৎসবে সময় কাটিয়ে গেলেন। ময়দানের এমন মিলন উৎসবে হাজির থাকতে পেরে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছেন। এসেছিলেন এক ঝাঁক প্রাক্তন ফুটবলার। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য,বিকাশ পাঁজি,অমিত ভদ্র থেকে কৃষ্ণেন্দু রায়,মানস ভট্টাচার্য, শিশির ঘোষ,সঞ্জয় সেন,রহিম নবি, গৌতম ঘোষ, প্রশান্ত চক্রবর্তীর মতো প্রাক্তনরা।

দমকল মন্ত্রী সুজিত বসু প্রতি বছরেই জর্জটেলিগ্রাফের এই মিলন উৎসব হাজির থাকবেনই। “জর্জের এই অনুষ্ঠানটা খুব ভাল। ময়দানের সবাই আসেন। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। আমিও একটা সময় এই গড়ের মাঠে ফুটবল খেলেছি। এখন আমি আমার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় ময়দানে বেশি সময় দিতে পারি না। কিন্তু জর্জের এই অনুষ্ঠানে এলে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। মনটা ভাল হয়ে যায়। যেন পুরনো ময়দানকে ফিরে পাই।”

এসেছিলেন ইস্টবেঙ্গলের কর্তা দেবব্রত সরকার। দিল্লিতে থাকায় দেবাশিস দত্ত অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। তবে মোহনবাগান ক্লাবের সহসভাপতি কুনাল ঘোষ,ফুটবল সচিব স্বপন (বাবুন) ব্যানার্জি এবং সন্দীপন ব্যানার্জি এসেছিলেন। সন্ধ্যায় নৈহাটিতে আই লিগের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ থাকায় মহমেডান কর্তারা আসতে পারেননি। তবে ফোনে জর্জের মিলন উৎসবকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মহমেডান কর্তারা। নিজের কাজ সামলে উৎসবে ঘুরে গেলেন সিএবির প্রাক্তন কর্তা ও কাউন্সিলর বিশ্বরূপ দে। ছিলেন বিধায়ক তাপস রায়, চিকিৎসক তৃনমুলের নেতা শান্তনু সেন। দুই মাস আগে স্টেন বসেছে আইএফএ সভাপতি অজিত ব্যানার্জির। তাঁর শারীরিক অসুস্থতা আছেই। তবু অনির্বানের ডাকে প্রায় আড়াই ঘন্টা কাটিয়ে গেলেন অজিতবাবু। অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন প্রাক্তন, বর্তমান মিলিয়ে এক ঝাঁক ক্রীড়া সাংবাদিক।

জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাবে কবে থেকে এই বিজয়া সম্মেলন হচ্ছে? জর্জের সর্বময় কর্তা ও বিশ্বনাথ দত্তর পুত্র সুব্রত দত্ত এক আড্ডায় ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে বলেছিলেন,”আমি তখন সদ্য মাঠ করা শুরু করেছি। সালটা ঠিক মনে নেই। বাবা-কাকার সময় থেকেই ময়দানের সবাইকে নিয়ে বিজয়া সম্মেলন শুরু হয়েছিল জর্জে। এখনও সেটা ধরে রাখতে পেরেছি। ভাল লাগে ময়দানের সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই অনুষ্ঠানে আসেন। এটা শুধু জর্জের অনুষ্ঠান নয়। গোটা ময়দানের সকল ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের অনুষ্ঠান। সবাই মিলে কিছু ভাল মুহূর্ত আমরা কাটাই।”

এই বছর ব্যবসার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাই মিলন উৎসবের যাবতীয় দায়িত্ব একা কাঁধে নিয়ে অনির্বান দত্ত দুর্দান্ত ভাবে সফল। তিনি বলছিলেন,”এই অনুষ্ঠান শুধু দত্ত পরিবার বা জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাবের নয়। এই অনুষ্ঠান পুরো ময়দানের। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই উৎসবে এসে সামিল হন। এটাই তো সেরা প্রাপ্তি।”

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ৯৮ বছরের জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা হরিপদ দত্ত। বিশ্বনাথ দত্ত,প্রদ্যোৎ দত্তর বাবা হলেন হরিপদ দত্ত। তিনিই ১৯২৫ সালে জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাব তৈরি করে ছিলেন। তিনি জর্জ ক্লাব যখন শুরু করলেন তখন ক্লাব সচিব ছিলেন ব্রিটিশ সাহেব এ, এল কর্বেট। তিনি আসলে জর্জ টেলিগ্রাফ ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল ছিলেন। হরিপদবাবু এই কর্বেটকে ক্লাবের প্রথম সচিব করেছিলেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পরাধীন ভারতে বাংলা তথা ভারতীয় কোনও কোম্পানিতে (জর্জ টেলিগ্রাফ ইনস্টিটিউট) একজন জর্জের চাকুরিজীবী ছিলেন এই বিদেশি। হরিপদ দত্তর পাঁচ পুত্রর (তারাপদ দত্ত,বিশ্বনাথ দত্ত,প্রণব দত্ত, প্রশান্ত দত্ত এবং প্রদ্যোৎ দত্ত) মধ্যে ময়দানে এসেছেন বিশ্বনাথ দত্ত ও প্রদ্যোৎ দত্ত। পরের জেনারেশনেও দুই জন (সুব্রত দত্ত ও অনির্বান দত্ত) মাঠ করছেন। ফোর্থ জেনারেশন হিসেবে ছয় বছর হল জর্জ ক্লাবে যোগ দিয়েছেন প্রদ্যোৎবাবুর দাদা প্রশান্ত দত্তর নাতি ২৯ বছরের অধিরাজ দত্ত। যাকে ময়দানে স্মিত বলেই জানে সবাই। অধিরাজের কাজ এবং তাঁর স্মিত হাসি ময়দানে এখনই যথেষ্ট পরিচিতি পেয়ে গিয়েছেন।

জর্জ টেলিগ্রাফের খেলে গিয়েছেন বহু বিখ্যাত সব ফুটবলার। তালিকাটা দীর্ঘ। পাশাপাশি ক্রীড়া প্রশাসকদেরও ‘আঁতুরঘর’ হল এই জর্জটেলিগ্রাফ ক্লাব। বছরের পর বছর তালিম নিয়ে ‘আঁতুরঘরে’ই সিদ্ধিলাভ করে গিয়েছেন বিশ্বনাথ দত্ত, প্রদ্যোৎ দত্ত, সুব্রত দত্তরা। এঁদের উত্তরসুরি হিসেবে ‘আঁতুরঘরে’ যোগ্য ক্রীড়া প্রশাসক হয়ে ওঠার পথে প্রয়াত প্রদ্যোৎ দত্তর জৈষ্ঠ পুত্র অনির্বান দত্ত। যিনি এখন আইএফএ-এর সচিব। আর অনির্বানের জেঠুর নাতি অধিরাজ দত্ত নীরবে তালিম নিচ্ছেন। এই ‘আতুর ঘরেই’ তৈরি হচ্ছেন অধিরাজ।

এমন এক প্রাচীন ক্লাবের কর্তাদের আন্তরিকতার ডাক কেউ উপেক্ষা করতে পারেন না। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত চেনা মানুষের ভিড়। শুধু এই ভিড়ে দেখা গেল না আইএফএ-র প্রাক্তন সচিব জয়দীপ মুখার্জি এবং বতর্মান সহ সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসকে।