চাকরির জন‍্য আবেদন,ব‍্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে অসহায় প্রশান্ত পত্নী সৌমি

    0

    ◆সন্দীপ দে ◆

    আইসিইউ-র বেড থেকে স্ত্রী সৌমিকে ফোন প্রশান্ত ডোরার। “ফ‍্যাব ইন্ডিয়া থেকে কয়েকটা মাস্ক নিয়ে এসো তো। আর সঙ্গে আমলকি নিয়ে আসবে। জ্বরে মুখের স্বাদ নেই। কিছু খেতে ভাল লাগছে না। তুমি কাঁদবে না। মনটাকে শক্ত রেখো। দেখবে আমি ভালো হয়ে যাব। তুমি চিন্তা করবে না।” যেদিন সৌমিকে ফোন করে এই কথাগুলি প্রশান্ত বলেছিল তার পরের দিনই ভেন্টিলেশনে চলে গেলেন। তারপর কয়েকটা দিন জীবন বাঁচানোর লড়াই করলেন বটে কিন্তু শেষ রক্ষা আর হল না। সব শেষ।
    সেদিনের প্রশান্তর ফোনের কথাগুলি আজও ভুলতে পারছেন না সৌমি ডোরা। এমনটা হবে ভাবেননি। গতকাল (বুধবার) রাতে ফোনে ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে বলছিলেন প্রশান্ত পত্নী সৌমি।

    দমদম মেট্রো স্টেশনের পাশে ঝকঝকে একটি ফ্ল‍্যাট কিনেছিলেন প্রশান্ত। করোনা পরিস্থিতি কাটলেই মা-বাবা, স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে নতুন ফ্ল‍্যাটে উঠবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন ভারতের প্রাক্তন ফুটবলার প্রশান্ত। কিন্তু কোথা থেকে কি সব হয়ে গেল। সব যেন উথাল পাথাল। নতুন করে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন এখন তা স্বপ্নই থেকে গেল। সাড়ে এগারো বছরের এক মাত্র পুত্র সন্তান ও শ্বশুর -শাশুড়িকে নিয়ে প্রশান্ত পত্নী এখন বড্ড অসহায়।

    টকেটিভ সৌমি এখন আগের মতো বেশি কথা বলতে চান না। অনেকটাই চুপচাপ। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। ভালো থাকা যায়? নতুন ফ্ল‍্যাটের ইএমআই কি হবে? লিলুয়ার ডন বসকো স্কুলে ছেলের পড়াশোনা সুষ্ঠুভাবে করাতে পারবেন তো? শ্বশুর-শাশুড়িকে শেষ পর্যন্ত দেখাশোনা করতে পারবেন তো? দমদমে ব‍্যাঙ্কের ভাড়া ফ্ল‍্যাট এখনই ছেড়ে দিতে হবে নাতো? নতুন ফ্ল‍্যাটটা আদৌ ধরে রাখতে পারবেন? স্বামীর চাকরিটা আদৌ পাবেন? মাথায় এমন হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সৌমির।

    সৌমি শিক্ষিতা। লিনেন ডিসাইনার। কলকাতার আদিত‍্য গ্রুপে মোটা টাকার চাকরি করতেন। নিজের পেশার জন‍্য সৌমিকে দেশে-বিদেশে যেতে হত। কিন্তু পরিবারকে সময় দিতে পারছিলেন না। ছেলে,স্বামী শ্বশুর-শাশুড়িকে সময় দেওয়ার জন‍্য আদিত‍্য গ্রুপের মোটা টাকার চাকরিটা সৌমি ছেড়ে দিয়েছিলেন ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে। বাড়িতে বসে ছোট্ট বুটিকের ব‍্যবসা শুরু করেছিলেন। সঙ্গে মুম্বইয়ে কনসালটেন্ট জব। ঘরে বসেই। লকডাউনের জন‍্য দুটোই বন্ধ। প্রাশান্তর অকাল প্রয়ানে সৌমি কি স্বামীর রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের চাকরিটা পাবেন? কেউ জানে না।
    “ব‍্যাঙ্কের আধিকারিকদের সঙ্গে কথা হয়েছে। ২০২০ সালে অনেক নতুন নিয়ম তৈরি হয়েছে। চাকরি পাবোই এমনটা জোর দিয়ে বলতে পারছে না ব‍্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। চাকরির সুযোগ কম। তবে আমি চাকরির জন‍্য আবেদন করতেই পারি বলে আমাকে বলা হয়েছে। তাই আজ (বুধবার) প্রশান্তর অফিসে একটা চাকরির জন‍্য আবেদন করেছি। দেখা যাক কি হয়।” ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে বলছিলেন প্রশান্ত পত্নী সৌমি।

    তবে তিনি রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের কাছে কৃতজ্ঞও। সৌমি বলছিলেন,”প্রশান্তর চিকিৎসার জন‍্য প্রচুর টাকা খরচ হয়েছে। সব টাকাই রিজার্ভ ব‍্যাঙ্ক দিয়েছে। ব‍্যাঙ্ক পাশে না থাকলে প্রশান্তর চিকিৎসাই করাতে পারতাম না। হয়তো আরও আগেই ও চলে যেতো। ব‍্যাঙ্ক অনেক করেছে।”
    রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কে চাকরি করা এক প্রাক্তন ফুটবলার এই সাংবাদিককে বলছিলেন, রিজার্ভ ব‍্যাঙ্ক প্রশান্তর ব‍্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়তো নেবে বেঙ্গালুরুর অফিস। সব কিছু বেঙ্গালুরুতেই চূড়ান্ত হয়। এখন নতুন সব নিয়ম ইমপ্লিমেন্ট হয়েছে। অনেক যদি কিন্তু আছে। সৌমির চাকরি হবে কিনা সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। প্রশান্তর বকেয়া টাকা পেতেও একটু সময় লাগবে। তবে ব‍্যাঙ্ক পাশে ছিল। ভবিষ্যতেও পাশে থাকবে।

    সৌমি চাকরি না পেলেও প্রশান্তর প্রাপ‍্য টাকা পাবেন। পেশনও পাবেন। কিন্তু চাকরিটা পেলে প্রশান্তর স্ত্রী-পুত্র, বৃদ্ধ বাবা-মা আর্থিক ভাবে সুনিশ্চিত থাকতে পারবেন।

    সৌমির শ্বশুর-শাশুড়ি বরাবরই প্রশান্তর উপর নির্ভরশীল। দাদা হেমন্ত ডোরা নিজের পরিবার নিয়ে চন্দননগরে থাকেন। ভাই প্রশান্তর সঙ্গে সেই ভাবে যোগাযোগ ছিল না। ময়দানের অনেকেই তা জানেন। হাসপাতালে ভাই যখন মৃত‍্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন তখন ভাইকে দেখতে ছুটে গিয়েছিলেন দাদা হেমন্ত।

    ফাল্গুনি ও প্রশান্তর অনুরোধে ২০১৯ সালে সাইয়ের মাঠে রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের অফিস টুর্নামেন্ট দেখতে গিয়েছিল এই সাংবাদিক। তখন ব‍্যক্তিগত আলোচনায়, দাদা হেমন্ত ডোরা তাঁর সঙ্গে কথা বলে না বলে সেদিন অনেক দূঃখ করেছিলেন প্রশান্ত।
    অত‍্যন্ত ভাল মনের মানুষ ছিলেন প্রশান্ত। তাই তো বাবা-মাকে নিজের কাছে রেখে, নিজের দায়িত্ব সামলেছেন হাসপাতালে যাওয়ার আগে পযর্ন্ত। কিন্তু এখন কি হবে? মানসিক যন্ত্রণায় থাকা সৌমি ও নাতিকে কিছুদিনের জন‍্য বৈদ‍্যবাটির বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন প্রশান্তর শ্বশুর বাড়ির সদস‍্যরা। আর দমদমে প্রশান্তর ভাড়া ফ্ল‍্যাটে আছেন তার বাবা-মা। হেমন্ত ডোরা নিজের পরিবার নিয়ে আছেন চন্দননগরে।

    প্রশান্তর সতীর্থরা (প্রাক্তন ফুটবলার) ঠিক করেছেন, খুব শীঘ্রই হেমন্ত ডোরার কাছে অনুরোধ করবেন তিনি যেন, বাবা-মাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখেন। প্রশান্তর এক ঘনিষ্ঠ ফুটবলার বন্ধু (নাম প্রকাশ‍্যে অনিচ্ছুক) এই সাংবাদিককে বলছিলেন,”সৌমির এই কঠিন সময়ে আমাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। ও এখন মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। অনিশ্চত ভবিষ্যৎ। চাকরি হবে কিনা ঠিক নেই। হেমন্তদার উচিত বাবা-মাকে আপাতত নিজের কাছে রাখা। আমরা তাকে অনুরোধ করব ভেবেছি। আবার এটাও ভাবছি বলাটা ঠিক হবে কিনা। কারণ ব‍্যাপারটা একান্তই তাদের ব‍্যক্তিগত। জানি না বলতে পারব কিনা।”

    হেমন্ত ডোরার প্রতিক্রিয়া জানতে ফোন করে তাকে পাওয়া যায়নি। তিনবার ফোন করা হয়েছিল। তিনবারই হেমন্ত ছিলেন ‘পরিষেবার বাইরে।’

    আজ, কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাব তাঁবুতে প্রশান্তর স্মরণসভা। ময়দানের প্রায় সবাই আসবেন ধরেই নেওয়া যায়। এই ধরনের স্মরণ সভায় উঠে আসবে প্রশান্তর নানান ঘটনা। ফিরে যাবে তাঁর খেলোয়াড় জীবনের কিছু মুহূর্তে। তারপর? কিছুদিন পরে হয়তো আমরা ভুলে যাব প্রশান্তকে। হয়তো ভুলে যাব তাঁর পরিবারকেও। একটা সময় কেউ মনে রাখে না।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here