চন্দন নগরের ঐতিহ‍্যের ফুটবল সংকটে, আট থেকে আশি – সবার টান ক্রিকেটেই

0

সন্দীপ দে◆চন্দন নগর

কালো সাইড স্ক্রিন। সাদা বল। ক্রিকেটারদের গায়ে রঙিন পোশাক। গোটা মাঠে বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড। চার,ছক্কা হলেই বেজে উঠছে আইপিএলের টাইটেল মিউজিক। মাঠের ধারে ভিড় করে বসে খেলা দেখছেন এক ঝাঁক মহিলা। মঞ্চে বসে তখন সিএবি সভাপতি স্নেহাশিস গাঙ্গুলি সহ শীর্ষস্থানীয় কর্তারা। সঙ্গে অভিষেক পোড়েল। রবিবাসরীয় বিকেল-সন্ধ‍্যায় চন্দন নগরের প্রাচীন ‘কুঠির মাঠ’ যেন ক্রিকেটের নন্দন কানন। মাঠের ধারে এই প্রতিবেদকের পাশেই খেলা দেখছিলেন চন্দননগরের বাগবাজার বাসিন্দা (বয়স আনুমানিক ৬৫ বছর হবে) বিড়বিড় করে বলছিলেন,”এই মাঠে কত সব নামি দামি ফুটবলার খেলে গিয়েছেন। চূনী গোস্বামী, বদ্রু ব‍্যানার্জিরা বহুবার খেলে গিয়েছেন। আজ আর সেই ফুটবল এই মাঠে হয় কোথায়? “
কিন্তু ছোটদের ক্রিকেটেও তো এই মাঠ জমে উঠেছে। খেলা তো হচ্ছে। সমস‍্যা কোথায়? উত্তরে সেই প্রৌঢ় বলে উঠলেন,”ক্রিকেটে আমার কোনও আপত্তি নেই তো। স্নেহাশিসের মতো ক্রিকেটার এসে খেলছেন। খুব ভাল। কিন্তু ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলটাকে যদি এই ভাবে যত্ন নিত কর্তারা।”

আসলে চন্দন নগর মানেই ফরাসিদের স্মৃতি। আর এই মফস্বল শহরের খেলার মুখটাই ছিল ফুটবল। সঙ্গে কিছুটা কবাডি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল,১৮৮০ সালে নাকি চন্দন নগরের এই কুঠির মাঠে প্রথম ফুটবল খেলা শুরু হয়েছিল। তৎকালীন ফরাসি নৌ-সেনাপতি রেনে লেফ্রেসারের উদ্যোগে ফুটবল শুরু হয়। আর তার সাত বছর পর ১৮৮৮-তে তৈরি হয় চন্দননগর স্পোর্টিং ক্লাব। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯১১ সালে নাকি ট্রেডস কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল চন্দন নগর স্পোর্টিং ক্লাব। ওই বছরে মোহনবাগান ব্রিটিশদের হারিয়ে ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড জিতেছিল মোহনবাগান। আর সেই বছরই চন্দন নগরে এক প্রদর্শনী ম‍্যাচে শিল্ড জয়ী মোহনবাগানকে হারিয়ে দিয়েছিল এই জেলার ফুটবলাররা।

চন্দন নগরের ফুটবলে সে এক গৌরব গাথা। এক সময় কলকাতা ময়দান কাঁপিয়েছিলেন চন্দন নগরের ছেলে সতীশচন্দ্র পলসাই। বিখ‍্যাত ফুটবলার ছিলেন। আবার নিজেদের ফুটবল কেরিয়ারের শুরুতে চন্দন নগরের ক্লাবে খেলে গিয়েছেন চুনী গোস্বামী, তাঁর দাদা মানিক গোস্বামী, সমরেশ (পিন্টু) চৌধুরীরা। ফুটবল এবং হকি দুই খেলাই দাপিয়ে খেলেছেন শম্ভুজা মুখোপাধ্যায়। কৃষ্ণগোপাল চৌধুরী কলকাতার তিন বড় ক্লাবে মাথা উঁচু করে খেলেছিলেন। স্বপন পলসাই, বিজয় দিকপতিরও নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকে যাওয়ার আগে ভারতীয় ফুটবল দল কুঠির মাঠে খেলে গিয়েছিলেন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধিনায়কত্বে। পরবর্তীকালে যত বছর গিয়েছে, ততই চন্দন নগর থেকে হারিয়ে গিয়েছে তাদের ঐতিহ‍্যের ফুটবল। এখন যেন ইতিহাসের পাতায়। উল্টে দেখুন সব পাল্টে গিয়েছে। মাথা উঁচু করে সামনের দিকে দৌড় শুরু করেছে এই শহরের ক্রিকেট। চন্দন নগরের আট থেকে আশি – সব বয়সের ঝোঁক ক্রিকেটে। অবশ‍্য এই ছবি শুধু চন্দন নগরে নয়, সব জেলাতেই একই অবস্থা। বাংলার সেই সোনালী ফুটবল এখন অতীত। বাংলার ফুটবল আজ বড় বিপন্ন। সৌরভ গাঙ্গুলি যেদিন থেকে ব‍্যাট হাতে দেশের হয়ে ২২ গজ শাসন করতে শুরু করেছিলেন সেদিন থেকেই যেন ফুটবলকে পিছনে ফেলে সবাই ক্রিকেটেই মন দিয়ে বসেছে। সৌরভ মানেই যেন বাঙালির একটা আত্মতৃপ্তির অনুশীলন। অনুশীলনের সেই অভ‍্যাস এখনও অটুট।

এই চন্দননগর থেকেই উঠে এসেছে ইশান পোড়েল, অভিষেক পোড়েল। এই জেলার ক্রীড়া জগতে এরাই হলেন আইকন। ক্রিকেট এঁদের আইকন তৈরি করেছে। ফুটবলে এমন কেউ নেই যাকে দেখে ঝাঁকে ঝাঁকে ‘ব‍্যানার্জি’,’চ‍্যাটার্জি’ পরিবারের ছেলেরা ফুটবল মুখী হবে।

জেলা ক্রীড়া সংস্থাদের সিএবি যা দিতে পারে আইএফএ তা পারে না। স্বাভাবিক ভাবেই জেলার কর্তারাও একটু বেশিই ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকে আছে। গত মাসের ২৬ তারিখ থেকে এলাকার আটটি দল নিয়ে অনূর্ধ্ব – ১৩ ট‍্যালেন্টহান্ট ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছিলেন চন্দন নগর ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ‍্যাসোসিয়েশনের কর্তারা। যার পোশাকী নাম সুপ্রিম কাপ। এবং পুরো টুর্নামেন্টের পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল ‘সুপ্রিম নলেজ ফাউন্ডেশন’। লক্ষ‍্য এই এলাকা থেকে প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের তুলে আনা। এই বিভাগে ছেলে ও মেয়ে উভয়দের নিয়ে এই টুর্নামেন্ট।

জেলায় এই টুর্নামেন্টের গুরুত্ব বাড়াতে চন্দন নগরের কর্তারা অতিথি হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন রাজ‍্য ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা সিএবির সভাপতি স্নেহাশিস গাঙ্গুলি সহ এক ঝাঁক কর্তাদের। ছিলেন চন্দননগর পৌরনিগমের মেয়র রাম চক্রবর্তী। তাঁরা শুধু অতিথি হিসেবেই চন্দন নগর যাননি। চন্দননগরের ক্রিকেটকে উৎসাহ দিতে কুঠির মাঠে মেয়র একাদশের সঙ্গে একটি প্রদর্শনী ম‍্যাচও খেলেন স্নেহাশিস গাঙ্গুলি, আইবি রায়রা।

ছোটদের ফাইনাল ম‍্যাচ দেখতে দেখতে সিএবি সভাপতি স্নেহাশিস গাঙ্গুলি বক্তব‍্য রাখতে গিয়ে বলেন,”জেলার ক্রিকেটকে সিএবি ভীষণভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রতিভা তুলে আনতেই হবে। ইশান, অভিষেক এই জেলারই ছেলে। এই ভাবে প্রতিভা তুলে আনার চেষ্টা করছেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্তারা। আমরা ওঁদের ধন‍্যবাদ জানাই। এভাবেই কাজ করুন, সিএবি পাশে আছে,থাকবে।”

চন্দন নগর ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ‍্যাসোসিয়েশনের সচিব বামাপদ চ‍্যাটার্জি ‘ইনসাইড স্পোর্টস’ কে বলছিলেন,”আমাদের জেলার ক্রিকেট প্রতিভা তুলে আনতে চাই। কলকাতা গড়ের মাঠের সাপ্লাই লাইন হোক আমাদের চন্দন নগর।”


কিন্তু আপনাদের জেলার ফুটবলের ঐতিহ্যকে কি ফেরানো যাবে? বামাপদবাবু বলে উঠলেন “সেটাও আমাদের কাজে বিরাট চ‍্যালেঞ্জ। অনেক প্রতিকূলতার মধ‍্যেও আমরা বয়স ভিত্তিক ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু করে প্রতিভা তুলে আনার কাজ শুরু করে দেব।”

বামাপদ চ‍্যাটার্জির কাছেই জানা গেল, ছোটদের নিয়ে টুর্নামেন্ট করার খরচ নেহাতই কম নয়। তবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছেন ‘সুপ্রিম গ্রুপ’। এই ‘সুপ্রিম গ্রুপ’-এর চেয়ারম‍্যান হলেন বিজয় গুহ মল্লিক। ক্রীড়াপ্রমী মানুষ। তিনিই চন্দন নগর ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ‍্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তার পুত্র ডঃ সৌম গুহ মল্লিক ‘সুপ্রিম গ্রুপ’-এর ভাইস চেয়ারম্যান। তিনিও ভীষণ খেলা পাগল মানুষ। পড়ার সঙ্গে খেলার প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই নিজের জেলার ক্রীড়ার উন্নয়নে ইতিমধ‍্যে সামিল হয়ে গিয়েছেন প্রচার বিমুখ বিজয় গুহ মল্লিক ও ডঃ সৌম গুহ মল্লিক। জেলার খেলায় স্পনসরের আকাল সর্বত্র। অর্থ ছাড়া সবই অনর্থ। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলার ক্রীড়া জগতে সুপ্রিম হতে চন্দন নগরের একমাত্র ভরসা – ‘সুপ্রিম গ্রুপ।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here