অবহেলিত বাংলার স্কুল ফুটবল
সন্দীপ দে
বামফ্রন্টের জমানাতেই বাংলার স্কুল ফুটবল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তৎকালীন রাজ্য সরকার। সালটা ছিল ২০১০। হঠাৎ একদিন জেলায় থাকা কোচেদের কাছে বিজ্ঞপ্তি পৌঁছে গেল – আপাতত জেলায় স্কুল ফুটবল কোচিং ক্যাম্প বন্ধ রাখা হবে। অতএব স্পোর্টস কাউন্সিলের অধিনে থাকা কোচদের কলকাতায় চলে আসতে হল। ২০১১ সালে বাংলার রাজনীতিতে পালা বদল ঘটল। ক্ষমতায় এল তৃণমূল। ক্রীড়ামন্ত্রী হলেন মদন মিত্র। দায়িত্ব নিয়ে অতীত সরকারের পরিকল্পনা খতিয়ে দেখার পর মদন ক্রীড়া উন্নয়নের জন্য নতুন করে কাজ শুরু করলেন। ওই সময় বাম সরকারের ‘লং টার্ম নন-রেসিডেন্সিয়াল কোচিং ক্যাম্প’-এর প্রজেক্টটা চোখে পড়ে মদনের। এটা ঠিক ভাবে নতুন করে শুরু করতে পারলে বাংলার ফুটবলের বিরাট সাপ্লাই লাইন হতে পারত। স্পোর্টস কাউন্সিল সূত্র থেকে একটি অভিযোগ শোনা গেল, ২০১১ সালের শেষের দিকে কলকতার এক ঐতিহ্যপূর্ণ ইংরেজি কাগজের প্রবীন ক্রীড়া সাংবাদিক শ্যামসুন্দর ঘোষ, মন্ত্রী মদন মিত্রকে বোঝান, যে ভাবে জেলায় এই ক্যাম্প চলে তাতে বন্ধ করে দেওয়াই ভাল। তারপর থেকে মদন মিত্র নাকি এই প্রজেক্টটা নিয়ে আর ভাবেননি।
বাম জমানায় ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে অনুরোধ করে জেলায় জেলায় স্কুলের এই কোচিং ক্যাম্প শুরু করেছিলেন। পুরো দায়িত্বে ছিলেন কো-অর্ডিনেটর শম্ভু মৌলিক। উনিই দেখতেন। কি ছিল এই কোচিং ক্যাম্পে?
বাংলার বিভিন্ন জেলায় কিছু স্কুল বেছে নিয়ে হত এই ফুটবল কোচিং ক্যাম্প। শুধু ফুটবল নয়, সাঁতার, ভলিবলেও কোচিং ক্যাম্প হত। তখন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় (যেমন, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, অবিভক্ত মেদিনীপুর, মালদা, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, নদিয়া, দুই ২৪ পরগনা, বর্ধমান) এই কোচিং ক্যাম্পের সংখ্যাটা ছিল ২২টি। স্পোর্টস কাউন্সিল থেকে কোচেরা যেতেন। সঙ্গে স্থানীয় কোচদেরও কাজ করার সুযোগ দিত রাজ্য সরকার।
▪এক একটা কোচিং ক্যাম্প (বছরে) আর্থিক অনুদান পেত ৬ হাজার টাকা।
▪প্রত্যেক ফুটবলারের মাথা পিছু টিফিন খরচ ৫ টাকা।
▪ গ্রাউন্ডস ম্যান পেতেন ১০০ টাকা
▪ফিজিক্যাল ট্রেনারকে দেওয়া হত ২০০ টাকা।
▪ কোচদের দেওয়া হত ১ হাজার ৬০০ টাকা।
▪ এই রাজ্য সরকারের স্কুল ফুটবল কোচিং ক্যাম্প থেকে উঠে এসেছেন বহু ফুটবলার। আজ তাদের বেশির ভাগই ফুটবল খেলে চাকরি পেয়ে প্রতিষ্ঠিত। উদাহরণ অনেক আছে। যেমন, অভিজিৎ মন্ডল, সংগ্রাম মুখার্জি, সুরজিৎ বসু, বিমান মন্ডল, রূপচাঁদ মুর্মু,কৃষ্ণ টুডু, ফুলচাঁদ হেমব্রম। আরও বহু নাম আছে, জায়গার অভাবে সব নাম দেওয়া সম্ভব নয়।
এখন স্পোর্টস কাউন্সিলের ফুটবল কোচের সংখ্যা ১০। সরকারের নির্দেশে তাঁরা এখন খড়দহে রাজ্য ফুটবল অ্যাকাডেমিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু জেলায় গিয়ে গ্রামের স্কুল থেকে ফুটবলারদের তালিম দেওয়ার এক অদ্ভুত আনন্দ খুঁজে পান স্পোর্টস কাউন্সিলের প্রবীন কোচ প্রবীর ভট্টাচার্য। এই প্রবীরবাবু এই কোচিং প্রকল্পে কাজ করার জন্য ১৮ বছর পুরুলিয়ায় ছিলেন। ঝিলিমিলিতে একটা ফুটবলের পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। সেই সময় রাজ্য ক্রীড়া দফতরের অনুরোধে এই সব কোচিং ক্যাম্প দেখতে যেতেন সুব্রত ভট্টাচার্য, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, কুন্তলা ঘোষ দস্তিদার,সঞ্জয় মাঝির মত একাধিক প্রাক্তনরা।
এই ঝিলিমিলি গ্রামটা হল পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের সীমান্তে। সেই সময় মাওবাদীদের মারাত্মক দাপট ছিল। এই ব্যাপারে কোচ প্রবীর ভট্টাচার্য ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে বলছিলেন,”প্রথম দিকে কাজ করতে ভীষন ভয় করত। হঠাৎ হঠাৎ অচেনা মানুষ এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলত। কি করি, কেন ফুটবল নিয়ে থাকি, আমাদের সঙ্গে পুলিশের কোনও যোগাযোগ আছে কিনা – ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে জেনেছিলাম ওই সব লোকেরাই হল মাওবাদী। সন্দীপ বিশ্বাস করবে না, পরে ওরাই আমাদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করত। আসলে মাওবাদীরা বুঝেছিল, আমরা, পুলিশের গুপ্তচর নই। সাঁওতাল ছেলেদের ফুটবলার তৈরি করতে এসেছি। পরে আমাদের খুব খাতির করত।”
কিন্তু এখন মাওবাদীও নেই, আপনাদের কোচিং ক্যাম্পও নেই। শুনলাম খড়দহের রাজ্য অ্যাকাডেমিতে সবাই কাজ করছেন। কিন্তু এত কোচ কি কাজ করার সুযোগ পাবেন? “সত্যি বলছি, জেলার বিভিন্ন গ্রামে এখনও বহু ফুটবল প্রতিভা আছে। এই লংটার্ম কোচিং ক্যাম্পটা খুব ভাল ছিল। আমরা সব সময় ওই সব রিমোট এলাকায় গিয়ে কাজ করতে চাই। তবে সরকার যা বলবে তাই করতে হবে। মন খারাপ লাগে। কেউস গুরুত্ব দিল না।” বলছিলেন স্পোর্টস কাউন্সিলের সফল কোচ প্রবীর ভট্টাচার্য।
দক্ষিণ দিনাজপুর ক্রীড়া সংস্থার প্রাক্তন সচিব ও দক্ষ ক্রীড়া প্রশাসক (এখন সিএবির অ্যাপেক্স কাউন্সেলের সদস্য) গৌতম গোস্বামী জানান,”রাজ্য সরকারের এই স্কুল কেন্দ্রিক ফুটবল কোচিং ক্যাম্পের কথা আমার মনে আছে। খুব ভাল প্রজেক্ট, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু যেভাবে চলছিল তাতে বন্ধ করে খুব ক্ষতি হয়নি। অন্য জেলার কোচিং ক্যাম্পের কি অবস্থা ছিল জানিনা। ভাল হতে পারে। আমাদের এখানে যারা কাজ করত তারা যত্ন নিয়ে, আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করত না।” গৌতমবাবুর অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আসলে সরকারি যে কোনও প্রকল্পে এমন ‘অযত্ন’ থাকেই।
পুরুলিয়ার ঝিলিমিলি, জলপাইগুড়ির বীরপাড়া, নদীয়ার কল্যাণী, উত্তর২৪ পরগনার নৈহাটি বা মালদহর কালিয়াচকে এই ক্যাম্প বেশ সাড়া ফেলেছিল। দার্জিলিংয়েও পাহাড়ি ছেলেরা ফুটবলমুখী হয়েছিল। প্রাক্তন ফুটবলার চন্দন সিং একটা প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে কোচ প্রবীর ভট্টাচার্যের প্রশিক্ষণে সাবডিভিশনের প্রতিযোগিতায় পুরুলিয়ার খাতড়া চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল।
সরকারের এই ক্যাম্প কেন বন্ধ হল? নতুন করে কি আর শুরু করা যায় না? ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-র এই প্রশ্নের উত্তরে স্পোর্টস কাউন্সিলের বর্তমান জয়েন্ট সেক্রেটারি গৌতম বিশ্বাস জানালেন,”আমি আপনার প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারব না। প্রোটোকল বলতে পারেন। আপনি প্রিন্সিপাল সেক্রেটারিকে ফোন করুন।” প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি বরুন রায়কে ফোন করেও যোগাযোগ করা যায়নি।
পরে স্পোর্টস কাউন্সিলের এক কর্তাকে ফোন করি। (তাঁর আপত্তি থাকার জন্যই সেই কর্তাটির নাম উল্লেখ করা গেল না) স্পোর্টস কাউন্সিলের সেই কর্তাটি বললেন,”সেই ক্যাম্পটি না থাকলেও ফুটবল অ্যাকাডেমি আছে। সেখানে বয়স ভিত্তিক দল আছে। জেলা থেকে কোচেরা ফুটবলার তুলে আনেন। এখনও ভাল ছেলে পেলে রাজ্য অ্যাকাডেমি লুফে নেবে। তাছাড়া, সরকার এখন পলিসি চেঞ্জ করে নতুন স্কিম চালু করেছে। প্রত্যেক কোচিং ক্যাম্পকে এক লক্ষ টাকা করে দেওয়া হয়। এবছর এই টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে সব ধরনের কোচিং ক্যাম্প মিলিয়ে ৪৬২ টি ক্যাম্পকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। জেলা যুব আধিকারিকরা এই ব্যাপারটা দেখেন। এ সবই তো ফুটবলের উন্নয়ন।”
কিন্তু উন্নয়নকে ঘিরেও ঘুঘুর বাসা। এমন অভিযোগও শোনা যায় যে, যাদের কোনও কোচিং ক্যাম্পের কোনও অস্তিত্বই নেই, অথচ তারা টাকা পেয়ে যাচ্ছে। এই সাংবাদিক মালদা টাউনের এক ভদ্রলোককে জানে, তিনি নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করে ফুটবল কোচিং ক্যাম্প চালান। খবরের কাগজে সরকারের বিজ্ঞাপন দেখে এক লক্ষ টাকা পেতে আবেদন পত্র জমা করতে যান। আবেদন করতে গেলে স্থানীয় এক তৃণমূল ‘সিকি নেতা’ ফর্মটি জমা নেওয়ার আগে প্রথমেই জানতে চান, তাঁর পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড কি? এই প্রশ্ন শুনে ঘেন্নায় সেই আবেদন পত্র আর জমা দেননি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোচিং ক্যাম্পের উন্নতির জন্যই এমন স্কিম চালু করলেও জেলার তৃণমুলের নিচু তলার নেতাদের নিচ মানসিকতায় অবহেলিত সত্যিকারের কিছু কোচিং ক্যাম্প। বেড়ালের গলায় ঘন্টা কে বাঁধবে? স্পোর্টস কাউন্সিলের একাধিক কর্তার কাছে এমন মৌখিক অভিযোগ এসেছে। কিন্তু কিছু করার নেই। সরকারি চাকরি করেন। মুখ খুললেই বিপদ।