খেলোয়াড়দের চাকরিঃ প্রায় ৪০টি সংস্থায় ‘নো ভ‍্যাকেন্সি’

0

◆সন্দীপ দে◆

“বিকেল হলেই মা আমাকে বলতেন, ‘তিনটে বেজে গ‍্যাছে,মাঠে যা বাবলু। মন দিয়ে ফুটবলটা খেলিস বাবা।’ আসলে আমার জানতে পেরেছিলেন, আমি ফুটবলটা ভাল খেলি। পাড়ায় বেশ নাম-ডাক হচ্ছে। ভাল ফুটবল খেললে চাকরি পাওয়া যায়। ওই জন‍্য প্রত‍্যেকদিন বিকেলে মা আমাকে মাঠে যাওয়ার জন‍্য উৎসাহ দিতেন। এখনকার মায়েরা কোনও ছেলেকে মাঠে যেতে বলেন কিনা আমি জানি না।” এক আড্ডায় এই সাংবাদিককে কথাগুলি বলেছিলেন ভারতের প্রাক্তন ফুটবলার সুব্রত ভট্টাচার্য।

জেলায় জেলায় বহু ছেলে-মেয়েরা ফুটবল সহ অনেক খেলার সঙ্গেই যুক্ত। কিন্তু সামনে শুধুই অনিশ্চয়তা। তাই আগের মতো ফুটবলার উঠে আসছে না। কিছুদিন খেলার পর সব ছেড়ে কোনও কাজে ঢুকে পড়ছে, সংসার বাঁচাতে। বাংলার ক্রীড়া জগতে এটাই বাস্তব ছবি। আজ, সন্তোষ ট্রফি খেলে আসা দুই প্রতিভাবান ও দুস্থ মনোতোষ চাকলাদার ও দিলীপ ওঁরাওকে চাকরির ব‍্যবস্থা করেছেন স্বয়ং মুখ‍্যমন্ত্রী। বিষয়টা ইতিবাচক,প্রশংসনীয়। শুধু সরকারকে একা এগিয়ে আসলে হবে না। এগিয়ে আসতে হবে কেন্দ্রীয় সরকার ও বেসরকারি. সংস্থাকেও। একটি সূত্রের খবর,২০১৫ সালে রাজ‍্য সরকারের স্পোর্টস পলিসিতে পরিস্কার উল্লেখ আছে,বিভিন্ন অফিসে চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের জন‍্য ২ শতাংশ সিট বরাদ্দ রাখতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ‍্যের বিষয় বহু অফিস রাজ‍্য সরকারের স্পোর্টস পলিসিকে মেনেও মানতে অপারগ। তার ফলোআপ হয় কিনা জানা নেই।

অথচ এই বাংলাতেই একটা সময় বিভিন্ন অফিসে,বিভিন্ন পদে চাকরি হয়েছে বহু খেলোয়াড়ের। তালিকাটা দীর্ঘ। খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, সরকারি,বেসরকারি অফিস মিলিয়ে প্রায় ৪০ টারও বেশি সংস্থা খেলোয়াড়দের আর চাকরি দিচ্ছে না। ফুটবল খেলে আগে কোন কোন অফিসে স্পোর্টস কোটায় প্রচুর চাকরি পাওয়া যেত? তার একটা তালিকা তুলে ধরার চেষ্টা করা হল মাত্র।

▪ রিজার্ভ ব‍্যাঙ্ক▪কাস্টমস▪ বিজি প্রেস▪ মেট্রো▪ পোর্ট ট্রাস্ট▪ কোল ইন্ডিয়া ▪ কলকাতা কর্পোরেশন ▪ এফসিআই▪ স্টেট ট্রান্স পোর্ট ▪ এসবিআই ▪ ইউবিআই ▪ এলাহবাদ ব‍্যাঙ্ক ▪ইউনিয়ন ব‍্যাঙ্ক ▪ সেন্ট্রাল ব‍্যাঙ্ক ▪ ব‍্যাঙ্ক অফ বরোদা ▪ ব‍্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ▪ সেন্ট্রাল এক্সাইস ▪ ওএনজিসি ▪ জুওলজিক‍্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ▪চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ▪ বার্ড অ‍্যান্ড কোম্পানি ▪ ভারত পেট্রোলিয়াম • এম এন দস্তুর ▪ সেইল ▪ ইছাপুর রাইফেল ফ‍্যাক্টরি ▪ গ্লুকোনেট▪ মহালক্ষ্মী কটন মিল ▪ এনইএস (আর্টিলারি রেজিমেন্ট) ▪ মোহিনী মিল ▪ বেঙ্গল ইমিউনিটি ▪হিন্দুস্তান ফার্টিলাইজার▪ গার্ডেনরিচ সিপ বিল্ডার্স ▪ পোস্ট অ‍্যান্ড টেলিগ্রাফ ▪ বেঙ্গল কেমিক‍্যাল ▪ ক‍্যালকাটা কাস্টমস ▪ জুট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া ▪ রাজ‍্য পরিবহন নিগম ▪ সিটিসি ▪ এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন চা বাগান।

ফেয়ারলি প্লেস

যদিও কয়েক বছর ধরে স্পোর্টস কোটার চাকরি বন্ধ থাকার পর ইনকাম ট‍্যাক্স,রেল, এজি বেঙ্গল,সিএসসি আবার খেলোয়াড়দের চাকরির দেওয়া শুরু করেছে। কিন্তু সেটাও কম সংখ‍্যায়। তবু দিচ্ছে। পোর্ট ট্রাস্টে স্পোর্টস কোটায় চাকরি হয়েছে ২০ বছর আগে। ২০০২ সালে পোর্টের শেষ চাকরি পেয়েছেন গোলকিপার উৎপল হালদার। পোর্ট ট্রাস্টের স্পোর্টস অফিসার শুভাশিস সরকার (তিনি আবার আইএফএ-এর সহসচিব) বলছিলেন,”দুই দশক ধরে আমাদের আর স্পোর্টস কোটায় চাকরি হচ্ছে না। আসলে অল ইন্ডিয়া মেজোর পোর্ট থেকেই স্পোর্টস কোটায় চাকরির অপশন দিচ্ছে না। কিছু করার নেই। চাকরির অপশন থাকলে অনেক ভাল ফুটবলারকে সই করাতে পারতাম। সেটা হচ্ছে না। এভাবেই চলছে।”

রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কে শেষ দুই বার চাকরি হয়েছে ১৯৯৮ ও ২০১৪ সালে। তারপর স্পোর্টস কোটা বন্ধ। ক‍্যালকাটা কাস্টমসে স্পোর্টস কোটায় চাকরি হয়েছে ২০০০ সালে। তারপর ২০১৮ সালে ফের স্পোর্টস কোটায় চাকরির সার্কুলার দিলেও তা বাতিল হয়ে যায়। অর্থাৎ কাস্টমসে গত ২২ বছর ধরে স্পোর্টস কোটার চাকরি বন্ধ। ভাবা যায়!

একটা মরসুমে কলকাতা লিগে প্রায় ৬ হাজার ফুটবলার অংশ নেয়। সেখানে কয়েকটি মাত্র সংস্থার মুষ্টিমেয় যে চাকরি দেওয়া হয় তা রেসিওতে আসবে না।

একটা সময় প্রতিটি ব‍্যাঙ্কে প্রচুর সংখ‍্যায় ফুটবলার চাকরি পেয়েছেন শুধু ফুটবল খেলেই। ৯ এর দশকে কোচ চাঁদু রায়চৌধুরী বহু ফুটবলারকে রেলে চাকরি করে দিয়েছেন। আজ থেকে ২০ বছর আগে কর্পোরেশনে স্পোর্টস কোটার চাকরি দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রাজ‍্য পরিবহন নিগমে ১৯৯৬ সালে কিছু ফুটবলারকে চাকরি দিয়েছিল। পরে এই অফিসে ২০০৪ (সম্ভবত) শেষ রিক্রুট নরেশ ঢালি ও নীলাদ্রি চক্রবর্তী। সেইল এ ১৯৯৩ সালে ফুটবলার সুপ্রিয় দাশগুপ্ত ও বাস্তব রায়ের পর (১৯৯৬) প্রলয় সাহা,চঞ্চল ভট্টাচার্য শেষ রিক্রুট।

বার্ড অ‍্যান্ড কোম্পানির ফুটবল দল (ফাইল ছবি)

শুধু বাঙালি ফুটবলার নয়, কলকাতায় খেলতে এসে ভিন রাজ‍্যের ফুটবলাররাও ফুটবল খেলে চাকরি পেয়েছেন। নয়ের দশকে ইস্টবেঙ্গলের পক্ষ থেকে ক্লাবের তৎকালীন কর্তা কল্লোল বসু ৬ ফুটবলারের চাকরির ব‍্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। চন্দননগরের ইস্টবেঙ্গলের অন্ধ ভক্ত মিলনবাবুকে ধরে কল্লোল বসু এ জি বেঙ্গলে চাকরির ব‍্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, আকিল আনসারি,কিরন খোঙ্গসাই, অজয় সিং, গুনবীর সিং, মনোহরনদের। ইউনাইটেড স্পোর্টস (তখন এভাররেডি) কর্তা অলোকেশ কুন্ডু বহু ফুটববলারের চাকরির ব‍্যবস্থা করে দিয়েছেন। আসলে তখন চাকরির সুযোগ ছিল। ক্লাব কর্তারাও ফুটবলারদের জন‍্য চেষ্টা করতেন।

এই সব সরকারি অফিস গুলি থাকলেও অনেক কোম্পানি আবার বন্ধই হয়ে গিয়েছে। যেমন, বার্ড অ‍্যান্ড কোম্পানি। ফুটবল খেলে এই কোম্পানিতে চাকরি করতেন এমএ সাত্তার, পি ভেঙ্কটেশ, নারায়ণ সান‍্যাল, বিজন সেন শর্মা, ধনরাজ, বিনু চ‍্যাটার্জি, সুমিত ঘোষ (ক‍্যাপ্টেন ঘোষ)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বার্ড কোম্পানিতে সেই সময় বিজন সেন শর্মাদের সঙ্গে চাকরি করতেন আজকের বলিউড অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন।
হিন্দুস্তান ফার্টিলাইজারে চাকরি করতেন নঈমুদ্দিন,চিন্ময় চ‍্যাটার্জি সহ বহু ফুটবলার। এখন এই অফিসটার অস্তিত্ব নেই।

এফসিআই অফিস

উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পলতায় মহালক্ষ্মী কটন মিল। এই কোম্পানি জেলা লিগ ও আইএফএ পরিচালিত অফিস লিগ খেলত। তখনকার সময়ে জেলা লিগ খেলেও চাকরি পাওয়া যেত। এই কটন মিলে ফুটবল খেলে চাকরি পেয়েছিলেন জেলার বহু ফুটবলার। প্রাক্তন ফুটবলার ও বর্তমানে ধারাভাষ‍্যকার মিহির দাস জানালেন,”শ‍্যামনগরে তখন ফুটবল তুঙ্গে। তারকা ফুটবলাররা জেলা লিগ খেলতেন। আমরা খেলার জন‍্যই চাকরি পেয়েছিলাম মহালক্ষ্মী কটন মিলে। প্রতাপ ঘোষ, মহম্মদ মকিম সহ এক ঝাঁক ফুটবলারের চাকরির সুযোগ হয়েছিল। এছাড়াও বেলঘরিয়ার মোহিনী মিল, ইছাপুর রাইফেল ফ‍্যাক্টরি, এনইএস, আর্টিলারি রেজিমেন্ট কত সব নাম। ওই সময় আমাদের দুটি লক্ষ‍্য ছিল-১)বড় ক্লাবে খেলা। ২) একটা চাকরি পাওয়া। এখন সব বন্ধ। খুব খারাপ লাগে।”

শুধু এই ২৪ পরগনা জেলাই নয়, বর্ধমান, আসানসোলে ফুটবল খেলেও কিন্তু চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভে চাকরি করেছেন বহু ফুটবলার। আবার উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছিল বহু চা বাগান। উত্তরবঙ্গের ছেলেরা একটু ঘরকুনো। নিজের জেলা থেকে বেড়তে চান না। জেলা লিগ খেলে তখন বিভিন্ন চা বাগানে চাকরি পাওয়া যেত। জলপাইগুড়ি জেলা ক্রীড়া সংস্থার সচিব কুমার দত্ত একবার এই সাংবাদিককে বলেছিলেন,”নতুন প্রজন্মর ছেলেরা আর ফুটবল খেলতে চায় না। আমাদের এই জেলাতে অনেক চা বাগান ছিল। সেই চা বাগানে বহু ফুটবলার চাকরি পেয়েছিল। এখন অধিকাংশ চা বাগান বন্ধ হয়ে গিয়েছে।” বামফ্রন্ট সরকারের সময় রাজ‍্য সরকারের একটা নিয়ম ছিল, পুলিশ নিয়োগের সময় ১০ শতাংশ স্পোর্টস কোটা বরাদ্দ থাকবে। কিন্তু ২০০৯ সালের পর এই নিয়ম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পরে ১০ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়। কিন্তু তারপরেও পুলিশে স্পোর্টস কোটায় চাকরি নেই। কোনও রকমে কয়েকজনকে সিভিক পুলিশের কাজ দেওয়া গেছে। যে কারণে এখন আগের মত ভাল দল গড়তে পারে না পুলিশের দুটি দল।

সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল। সমস‍্যা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ভাল লক্ষন একটাই মুখ‍্যমন্ত্রী নিজের কোটা থেকে দুই ফুটবলারকে চাকরি দিচ্ছেন। এটাই উঠতি ফুটবলারের কাছে দিশা। এই দিশাকে জিইয়ে রাখতে হলে স্পোর্টস বিলের ২ শতাংশ স্পোর্টস কোটাকে মান‍্যতা দিয়ে যদি বিভিন্ন অফিস খেলোয়াড়দের চাকরি দেয় তাহলে শুধু ফুটবল নয়,বাংলার সব খেলার উন্নতি ঘটবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here