◆সন্দীপ দে◆
রাংতাকে রুপো ভাবলে যা হয়, তনুময় বসুকে নিয়ে হুগলী জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্তাদের এখন তাই হয়েছে। ভারতের প্রাক্তন বিখ্যাত গোলরক্ষক তনুময় বসুকে জেলা ক্রীড়া সংস্থার দায়িত্ব তুলে দেওয়ার আট বছর পর এখন ভুল ভেঙেছে কর্তাদের। আর সেই ভুল শুধরে নিয়ে কর্তারা হুগলী জেলা ক্রীড়া সংস্থায় তনুময় বসুকে আজ ব্রাত্য, ক্ষমতাহীন করে রেখে দিয়েছেন। হুগলী ক্রীড়া জগতের অধিকাংশ জুড়ে তনুময় বসুকে ঘিরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
কি এমন হল যে তনুময় বসুকে নিয়ে এত ক্ষোভের সৃষ্টি হল? হুগলী জেলা ক্রীড়া সংস্থার একাধিক কর্তার সঙ্গে কথা বলার পর তনুময় বসুর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উঠে আসছে।
অভিযোগ(১): গত আট বছরে হুগলী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি পদে থেকে সংস্থার মুখ হতে চেয়েছিলেন। ভারতীয় দলের প্রাক্তন ফুটবলার হওয়ায় সংস্থার উর্দ্ধে উঠতে চেয়েছিলেন।
অভিযোগ (২) : সংস্থার যুগ্ম সচিব প্রয়াত সুভাষ কুন্ডু ও বিকাশ মল্লিককে ব্যবহার করে নিজের মতো করে জেলা ক্রীড়া সংস্থা চালিয়ে এসেছেন তনুময় বসু।
অভিযোগ (৩) : গত আট বছরে সাড়ে চার লক্ষ টাকা দেনা। কোন খাতে, কত টাকা খরচ হয়েছে তার হিসেব দিলেও সংস্থার কর্তারা তনুময়ের পেশ করা হিসেবে সন্তুষ্ট নয়।
অভিযোগ (৪) : নিজের দাদা তাপস বসুকে দিয়ে বছরের পর বছর সংস্থার অ্যাকাউন্ট অডিট করিয়ে এসেছেন। যা নিয়ম বিরুদ্ধ কাজ।
অভিযোগ (৫) : সবার আপত্তি থাকা সত্বেও সংস্থার কোষাধ্যক্ষ রঞ্জিত ঘোষকে (অভিযোগ,ইনি ফুটবলের নাকি কিছুই বোঝেন না) আইএফএতে জেলার প্রতিনিধি করে পাঠান তনুময় বসু।
অভিযোগ (৬) : সব থেকে বড় অভিযোগ হল, জেলা ক্রীড়া সংস্থার নামে ফুটবল কোচিং ক্যাম্প শুরু করে। তার পরে সেই কোচিং ক্যাম্প একটি প্রাইভেট সংস্থার (হুগলী ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ্যাকাডেমি) নামে করে নেওয়া হয়। সেই নতুন সংস্থার প্রথম ট্রাস্টি বডিতে অন্যতম সদস্য হলেন তনুময় বসু ও বিকাশ মল্লিক।
২০১৩ সালে জেলার ফুটবলের উন্নয়নের আশা নিয়ে ভারতের প্রাক্তন ফুটবলার তনুময় বসুকে হুগলী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি পদে বসিয়ে ছিলেন স্থানীয় বিধায়ক অসিত মজুমদার। সহ-সভাপতির পদে বসলেও তনুময় বসুই নাকি সংস্থার শেষ কথা বলতেন। ফলে হাতে ক্ষমতা থাকায়,ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ উঠছে। আট বছর আগে যিনি তনুময়কে সংস্থায় ক্ষমতা দিয়ে এনেছিলেন সেই বিধায়ক অসিতবাবু নিজের ভুল বুঝতে পেরে শুদ্ধিকরনের রাস্তায় হাঁটছেন। নতুন কমিটিতে সহ-সভাপতি পদে রেখে দিলেও একদা ঘনিষ্ঠ তনুময়কে দুরে সরিয়ে দিয়েছেন বিধায়ক অসিতবাবু। কারণ তাঁর কাছে তনুময়ের বিরুদ্ধে সংস্থার একাধিক কর্তা অভিযোগ করেছেন। তাই গত দুই মাস আগে যে নতুন কমিটি তৈরি হয়েছে সেই কমিটিতে তনুময়কে সহ-সভাপতি হিসেবে রাখলেও সংস্থার যাবতীয় দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে যুগ্ম সচিব অমিত পালের হাতে। প্রসঙ্গত, এই অমিত পাল সহ একাধিক কর্তা তনুময়ের কার্যকলাপ নিয়ে বিধায়ক অসিত মজুমদারকে অভিযোগ করে এসেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,অসিত মজুমদার হলেন হুগলী জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্যাট্রন। ক্রীড়াপ্রেমী অসিতবাবুই কমিটি তৈরি করে দেন।
প্রাক্তন ফুটবলার তনুময় বসুর বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ আনলেন চুঁচুড়ার ইউনিয়ন এসির কর্তা রানা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি হুগলী জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রাক্তন ইসি মেম্বার। একটা সময় তনুময় বসুর সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেল কেন? প্রশ্নের উত্তরে রানা বন্দ্যোপাধ্যায় “ইনসাইড স্পোর্টস”-কে বলেন,”সম্পর্ক ছিল খেলাকে কেন্দ্র করে। যখন দেখলাম সেই খেলাকে ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করছে তখন মেনে নেওয়া যায় না। আট বছর আগে আমাদের প্রিয় বিধায়ক ক্রীড়াপ্রেমী অসিত মজুমদারের নেতৃত্বে তনুময় সংস্থার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। অসিতদা এবং আমরা সবাই ভেবেছিলাম এত বড় মাপের ফুটবলার সংস্থায় থাকলে জেলার ফুটবলের উন্নতি হবে। শুরুটা ভালই করেছিল তনুময়দা। খোলা মাঠ ঘেরার ব্যবস্থা করেন। গ্রাসরুট ফুটবল শুরু করেন। কলকাতা লিগের ম্যাচও আনেন। আসলে এগুলি ছিল তনুময়দার চমক। চমক না দেখালে নিজের গ্রহণ যোগ্যতা বাড়বে না। আর গ্রহণ যোগ্যতা না বাড়লে পিছন থেকে আর্থিক নয় ছয় করা যাবে না। আড়ালে নয়ছয় করেছেন। শুরুতে বুঝতে না পারলেও এখন সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমরা সবাই জানি, অনেকেই সংস্থার কাছ থেকে টাকা পায়। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ টাকা। বছরের পর বছর সুভাষ কুন্ডু ও বিকাশ মল্লিককে ব্যবহার করেছেন। সংস্থার নামে ফুটবল কোচিং ক্যাম্প শুরু করলেন। কিছুদিন পর হুগলী ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ্যাকাডেমি তৈরি করে কোচিং ক্যাম্পকে ঢুকিয়ে নিলেন। অর্থাৎ কোচিং ক্যাম্প থেকে যে ফি জমা পড়ত সেটা জেলা ক্রীড়া সংস্থার তহবিলে না পড়ে নতুন সংস্থায় জমা হত। গত আট বছরে যে আর্থিক অনিয়ম হয়েছে তার নেতৃত্বে ছিলেন তনুময় বসু। আপনি ভাবতে পারবেন না, সংস্থার অ্যাকাউন্ট অডিট করানো হচ্ছিল তনুময়ের দাদা তাপস কুমার বসুর কাছে। অসিতদা যে আশা নিয়ে তনুময়দাকে সংস্থায় এনেছিলেন তার মর্যাদা দিতে পারেননি তনুময়দা। বরং বলব ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।”
এত অভিযোগ। এত ক্ষোভ থাকা সত্বেও তনুময় বসুকে চিনতে আট বছর লেগে গেল? “আসলে এই অভিযোগ তো একদিনে জমা হয়নি। তাছাড়া আমাদের মধ্যেও একটা হয়তো খামতি ছিল। কিন্তু যে ভাবে সংস্থার উর্দ্ধে উঠে নিজের স্বার্থ দেখছিলেন সেটা আর মানতে পারিনি। পরে তনুময়দার অতীত সম্পর্কেও জানতে পেরেছি। তনুময় বসুর নাকি অনেক লাইসেন্স আছে। তাই যদি থাকে, তাহলে বড় ক্লাবে কেন ডাক পায় না সে? আসলে সবাই বুঝে গিয়েছে। অমিতদা (পাল) এখন দায়িত্বে এসেছেন। নতুন ভাবে সংস্থার কাজও শুরু করে দিয়েছেন। আশাকরি ভাল হবে। তবে তনুময়ের সাড়ে চার লক্ষ টাকার প্রপার হিসেব চাই। সহজে ছাড়ব না।” বলছিলেন রানাবাবু।
হুগলী জেলা ক্রীড়া সংস্থার বর্তমান যুগ্ম সচিব অমিত পাল অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে নিয়ে “ইনসাইড স্পোর্টস”কে জানান, “গত আট বছরে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। তনুময় বসু সাড়ে চার লক্ষ টাকার যে হিসেব দিয়েছেন তাতে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। তবে আপাতত দুটি কাজ করতে পেরেছি তা হল, ফুটবল কোচিং ক্যাম্পটা আমাদের জেলা সংস্থার অধিনে নিয়েছি। আর আপনি যে অ্যাকাউন্ট অডিটের কথা বলছেন সেক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে আমরা নতুন অডিটরকে দিয়েই অডিট করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
বিধায়ক অসিত মজুমদারেরে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে তাঁকে ফোন করেও পাওয়া যায়নি। তার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এদিকে যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ সেই প্রাক্তন গোলরক্ষক তনুময় বসু “ইনসাইড স্পোর্টস” কে পরিস্কার জানালেন,”আমি কখনও সংস্থার আর্থিক বিষয়টা দেখতাম না। অতীতে সংস্থার টার্নওভার ছিল প্রায় ৬ লক্ষ টাকা। আমরা আসার পর সেটা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪ লাখ টাকা। তবে খরচও আছে। সাড়ে চার লক্ষ টাকা দেনা আছে ঠিকই কিন্তু খুব শীঘ্রই সমস্যা মিটে যাবে।”
কোচিং ক্যাম্প হুগলী জেলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে হুগলী ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ্যাকাডেমিতে নিয়ে এসেছেন। ফুটবল শিক্ষার্থীদের অ্যাডমিশন ফি ৫০০ টাকা এবং মাসিক ১০০ টাকা জমা তো জেলা সংস্থায় জমা পড়তো না? প্রশ্নটা শুনে হাসতে হাসতে তনুময় বসু বলে উঠলেন,”সন্দীপ, তোমাকে কে এসব আজগুবি কথা বলেছে? আমরা কোনও ফুটবল শিক্ষার্থীদের কাছে টাকা নিইনি। এই ক্যাম্প জেলা সংস্থার ছিল। কিন্তু এত খরচ বহন করতে পাছিল না সংস্থা। তখন বিধায়ক ,আমাকে বলেন,ক্যাম্পটা দেখতে।”
আপনার দাদা তাপস কুমার বসুকে দিয়ে হুগলী জেলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাকাউন্ট অডিট করিয়েছেন। এটা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তনুময়বাবু পাল্টা প্রশ্ন করে বললেন, “নিজের দাদাকে দিয়ে অডিট করানো যাবে না,এমননটা কোন আইনে আছে? যা হয়েছে সব কমিটির অনুমতি নিয়েই করা হয়েছে। আমি একা কোনও সিদ্ধান্ত নিইনি।”
আপনি গত আট বছরে জেলা সংস্থার সহ-সভাপতি পদে থেকে আপনিই ছিলেন শেষ কথা। আপনি যা বলতেন তাই হত। প্রশ্ন শেষ করার আগেই তনুময় বসু বলতে শুরু করলেন,”হ্যাঁ, আমি শেষ কথা বলতাম, এখনও তাই।”