▪সন্দীপ দে▪
খেলার নিউজ পোর্টাল ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-এ সদ্য প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কেন এই প্রতিবেদন? এমন প্রশ্ন হয়তো কেউ কেউ করতেই পারেন। তা সত্বেও, না লিখলেই নয়। বাংলার সমাজে, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করার ক্ষেত্রে, এগিয়ে যাওয়ার কঠিন রাস্তায় তিনটি শব্দ অবচেতন মনেও উচ্চারণ করে গিয়েছেন -“ফাইট,কোনি ফাইট।” “কোনি” চলচ্চিত্রের এমন কালজয়ী চরিত্র ক্রীড়া জগতে এতটা প্রভাব আর কেউ ফেলেছে কিনা বলা মুস্কিল। সৌমিত্রবাবু নিজের চলচ্চিত্র জীবনের বাইরেও বাংলার ক্রীড়া জগতে একটা ছাপ রেখে চলে গেলেন।
রূপোলি পর্দায় কে সেরা? উত্তম না সৌমিত্র? এমন তর্ক-আলোচনা আগের মতোই এখনও হয়। এই দুই কিংবদন্তির অদৃশ্য লড়াইটা চলচ্চিত্র থেকে যেন এসে পড়েছিল বাংলার ক্রীড়া জগতে।
উত্তম কুমারও নিজের চলচ্চিত্র জীবনকে খেলার মাঠের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আসার আগে। “ধন্যি মেয়ে” ও “সপ্তপদী” বড় উদাহরণ। খেলার জগৎ উত্তমবাবুকে মনে রেখেছে “ধন্যি মেয়ে”-এর জন্য। হাড়ভাঙা শিল্ড দখলের লড়াই বাঙালি ক্রীড়াপ্রেমিদের আজও আনন্দ দেয়। অথচ “সপ্তপদী”-এর সেই ডাক্তারি পড়ুয়াদের ফুটবল ম্যাচের কথা হয়তো অনেকেই ভুলে গিয়েছেন। প্রসঙ্গত, সেই ম্যাচে উত্তম কুমার ইস্টবেঙ্গলের জার্সি পড়ে খেলেছিলেন। যা উত্তমবাবু একেবারেই চাননি।
ঘটনাটি না উল্লেখ করলেই নয়। মহানায়ক আদতে ছিলেন মোহনবাগানের অন্ধ ভক্ত। “সপ্তপদী”র এই ফুটবল ম্যাচের শ্যুটিংয়ের জন্য নিজের প্রিয় ক্লাব মোহনবাগানের মাঠকেই বেছে নিয়েছিলেন উত্তমবাবু। সেই সময় দল গড়ার কাজে মোহনবাগান ক্লাবের কর্তারা কেউ কলকাতায় ছিলেন না। তাই বাধ্য হয়ে ইস্টবেঙ্গল মাঠেই যেতে হয়। ইস্টবেঙ্গলের তৎকালীন ফুটবল সচিব মন্টু বসু খুব সাহায্য করেছিলেন। তিনিই দুই দলের জার্সির ব্যবস্থা করেছিলেন। সূচিত্রা সেন সমর্থিত দলের সাদা জার্সি। আর উত্তম কুমারদের দেওয়া হয় লাল-হলুদ জার্সি। শ্যুটিং সেট তৈরি। কিন্তু মহানায়ক উত্তম কুমার কিছুতেই ইস্টবেঙ্গলের জার্সি পড়তে রাজি হলেন না। সঙ্গে সঙ্গে ময়দান মার্কেটে লোক পাঠানো হল, নতুন জার্সি কিনে আনার জন্য। কিন্তু ময়দান মার্কেট সেদিন বন্ধ ছিল। তাই ইচ্ছের বিরুদ্ধে, বাধ্য হয়েই সেদিন লাল-হলুদ জার্সি পড়েই শ্যুটিং করতে হয়েছিল উত্তম কুমারকে। রূপোলি পর্দার মহানায়কের এমন মোহনবাগান ক্লাব প্রীতি, বাংলার ফুটবলে বহুল প্রচারিত নয়।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কোন দলের সাপোর্টার এই প্রতিবেদকের অন্তত জানা নেই। তবে তিনি পাগলের মতো ভালবাসতেন সিনেমা, থিয়েটারে অভিনয় করতে আর আবৃত্তি করতে। তাঁর ভাল লাগার বিষয় ছিল পেইন্টিং ও সিপিএম পার্টি। তিনি কখনও ভাবেননি, খেলার জগতের কোনও চরিত্রে তাঁকে অভিনয় করতে হবে। এই সুযোগটা এসেছিল পরিচালক সরোজ দের কাছ থেকে। সম্ভবত ১৯৮০ সাল। কোনও এক পুজো সংখ্যায় দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল। একটি হল শ্রদ্ধেয় ক্রীড়া সাংবাদিক মতি নন্দীর উপন্যাস “কোনি” আর অপরটি হল, সাঁতারু শ্রীপর্ণা ব্যানার্জির সাফল্যের খবর। উল্লেখ্য, শেওড়াফুলির সাঁতারু ইলা পালের কঠিন লড়াই নিয়েই ‘কোনি’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন মতি নন্দী। প্রত্যেকদিন ইলা শেওড়াফুলি থেকে সাঁতার শিখতে যেতেন শ্রীরামপুর ক্লাবে। কঠিন লড়াই করে সাফল্যর মুখ দেখা ইলাকে নিয়েই কালজয়ী উপন্যাস লিখেছেন মতিবাবু।
পরিচালক সরোজ দে সিদ্ধান্ত নেন, শ্রীপর্ণাকে দিয়ে “কোনি” সিনেমা করবেন। ওই সময় শ্রীপর্ণা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআর নিয়ে পড়াশোনা করছেন। পাশাপাশি সাঁতারও করছেন। শ্রীপর্ণার বাড়ি গিয়ে সরোজবাবু হতাশ হলেন। কারণ, কোনির চরিত্রটাই এক বস্তির মেয়ের লড়াই। সেখানে শ্রীপর্ণা বড়লোকের মেয়ে, আধুনিকা। প্রথমে হতাশ হলেও এক বছর পর আর কাউকে না পেয়ে শ্রীপর্ণাকেই নির্বাচন করেছিলেন পরিচালক সরোজ দে।
কোনি তো পাওয়া গেল। এবার ‘ক্ষিদ্দা’ কাকে দিয়ে করাবেন? প্রথমে উত্তম কুমারের কথা ভাবলেন। কিন্তু হঠাৎ উত্তম কুমারের মৃত্যু হয়। তখন বলিউডের নাসিরুদ্দিন শাহকে রাজি করান সরোজবাবু। কিন্তু নাসিরউদ্দিন শ্যুটিংয়ের ডেট দিলেন শীতকালে। মহা সমস্যা। শীতকালে সুইমিংপুলে শ্যুটিং করা কষ্টের। নাসিরউদ্দিন ছেড়ে তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেই মনোনীত করলেন সরোজবাবু।
সুযোগ পাওয়ার পর সৌমিত্রবাবু কলকাতার বেশ কয়েকটি সুইমিং ক্লাবে পৌঁছে যেতেন। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতেন। তিনি লক্ষ্য করতেন, একজন সাঁতার কোচ কিভাবে প্লেয়ারদের সঙ্গে কথা বলেন। আদব কায়দা কেমন? এসব জানার জন্য সুইমিংপুলে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় দিতেন। পাশাপাশি অভিনয় শিক্ষা দিয়ে বিশেষ ভাবে শ্রীপর্ণাকে তৈরি করেছিলেন এই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
উত্তম কুমার অভিনীত ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘সপ্তপদী’ ছিল হাসির সিনেমা। আর সৌমিত্রবাবু অভিনীত ‘কোনি’ ছিল এক কঠিন প্রতিবন্ধকতায় মোড়া জীবন যুদ্বের লড়াইয়ের ঘটনা। আমাদের কলকাতা ময়দানে চোখ মেলে দেখুন, ফুটবল, অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার বা অন্য কোনও খেলায় এমন কঠিন চরিত্রর আজও খোঁজ পাওয়া যায়। এ যেন আমার, আপনার জীবনের বঞ্চনার লড়াই, দারিদ্রের লড়াই, আপোসহীন থেকে সততার লড়াই। এসবই চেনা ঘটনা। কঠিন বাধা টপকাতে সবাই যেন মনে মনে নিজেকে বলে উঠি -“ফাইট, কোনি ফাইট।” এমনই এক চরিত্রকে নিজের উপন্যাসে তুলে এনেছিলেন কিংবদন্তি মতি নন্দী। কি উপন্যাস, কি সিনেমা – দুটি ক্ষেত্রেই ‘কোনি’ সুপার হিট। শুধু তাই নয়, মাধ্যমিকেও ‘কোনি’ পড়ানো হয় বলে এক সাক্ষাৎকারে শ্রীপর্ণা এমনটাই জানিয়েছিলেন। আম বাঙালির কাছে সৌমিত্রবাবু ‘ফেলুদা’ বলেই পরিচিত, সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু ‘কোনি’তে ‘ক্ষিদ্দা’র ভূমিকায় অসামান্য অভিনয় করার পর তিনি বাংলার ক্রীড়া জগতে আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি তা নিজেও বহুবার বলেছেন, ‘কোনি’ হল তাঁর সেরা ছবি গুলির মধ্যে অন্যতম। ১৯৮৪ সালে ‘কোনি’ মুক্তি পেয়েছিল। ১৯৮৬ সালে এই ‘কোনি’ পেয়েছিল জাতীয় পুরস্কার।
‘কোনি’র শেষ দৃশ্য মনে পরে? ন্যাশনাল মিটের শেষ মূহুর্তে জলে নামার সুযোগ পেয়েছিলেন কনক চাঁপা ওরফে কোনি। দর্শকাশন থেকে ক্ষিদ্দার মরিয়া চিৎকার – “ফাইট, কোনি ফাইট।” সেদিন জল ফুঁড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন কোনি। ৪০ দিন ধরে হাসপাতালের আইসিইউতে একা জীবন যুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছিলেন ৮৫ বছরের ‘ক্ষিদ্দা’। শুধু ক্রীড়া জগৎ কেন, বাংলার সব মহলই হয়তো মনে মনে চিৎকার করে গিয়েছেন,”ফাইট, ক্ষিদ্দা ফাইট।” কিন্তু হায়, জীবন মরণের লড়াইয়ে ‘কোনি’ হতে পারলেন না আমাদের সবার প্রিয় ‘ক্ষিদ্দা’। ১৫ নভেম্বর ১২.১৫ মিনিটে চলেই গেলেন। তিনি খেলোয়াড় ছিলেন না। তবুও ক্রীড়া জগতে আজ শুধুই শূন্যতা।