‘কাম ব‍্যাক’-এর লক্ষ‍্যে খিদিরপুর স্পোর্টিং

0

◆খুব শীঘ্রই শুরু হতে যাচ্ছে প্রিমিয়ার ডিভিশনের লিগ। তার আগে প্রিমিয়ার ‘এ’ গ্রুপের দলের প্রস্তুতি,তথ‍্য তুলে ধরার চেষ্টায় ‘ইনসাইড স্পোর্টস’। আজ,খিদিরপুর স্পোর্টিং ক্লাব।◆

◆সন্দীপ দে◆

প্রায় দেড় যুগ পর প্রিমিয়ার ডিভিশনের ‘এ’ গ্রুপে উঠেছিল ২০১৯ সালে। করোনার কারণে ২০২০ লিগ হয়নি। ২০২১ লিগ হলেও অবনমন ছিল না। তবুও মুখ থুবড়ে পড়েছিল ১০৫ বছরের খিদিরপুর স্পোর্টিং ক্লাব। এবার যেন খাদের কিনারা থেকে ফিরে আসার লড়াই একদা ভারতীয় ফুটবল দলের সাপ্লাইন লাইন খিদিরপুরের।

গোলরক্ষক প্রিয়ন্ত সিংয়ের সঙ্গে খিদিরপুর স্পোর্টিং ক্লাবের ফুটবল সচিব অমিতাভ বিশ্বাস

খিদিরপুর স্পোর্টিং মানেই তো ভারতীয় ফুটবলের উজ্জ্বল ইতিহাস। এই ক্লাবকে ঘিরে কত সব গল্পগাঁথা যা নতুন প্রজন্ম হয়তো জানেই না। সাতের দশকের শুরুর দিকে জুনিয়র ভারতীয় দলে ১৮ জনের মধ‍্যে বাঙালি ফুটবলার ছিলেন ১০ জন। এরা হলেন, তরুণ বসু, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, গৌতম সরকার, দিলীপ কয়াল, বিনয় পাঁজা, প্রশান্ত মিত্র, প্রসূন ব‍্যানার্জি, দিলীপ সরকার, শ‍্যামল ঘোষ এবং রঞ্জিৎ মুখার্জি। ভারতীয় দলে এক ঝাঁক বাঙালি। এঁরা সবাই তখন খিদিরপুর স্পোর্টিং ক্লাবের ফুটবলার। ভাবা যায়! একটা ক্লাবের ১০ জন ফুটবলার এক সঙ্গে জুনিয়র ইন্ডিয়া টিমে সুযোগ পাওয়াটা আজও রেকর্ড হয়ে আছে।
পরবর্তীকালে এই খিদিরপুর ক্লাবে যারা খেলেছেন তাঁদের বেশির ভাগ ফুটবলার ইন্ডিয়া খেলেছেন মাথা উঁচু করে।

খিদিরপুর স্পোর্টিং ক্লাব তাঁবু

গ্র‍্যান্ড হোটেলের ঠিক উল্টো দিকে,ময়দান মার্কেটের ঠিক পাশেই এখনও যেন সেই ঐতিহ্য ও অতীত সাফল‍্যের অদৃশ্য পতাকা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টায় শতাব্দী প্রাচীন – খিদিরপুর স্পোর্টিং ক্লাব। কত ফুটবলারের ‘আঁতুর ঘর’ ছিল এই ক্লাব তাঁবু। কত, কত ফুটবলার এই ক্লাবে খেলে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আজ থেকে ৪০ বছর আগেও এই ক্লাব তাঁবুর ঘরে,বাগানে ঘুরে বেড়াতেন সুরজিৎ, চিন্ময়,প্রদীপ,সুকল‍্যাণের মত বহু ফুটবলার। আর সবার উপরে ছাতা হয়ে সর্বক্ষন সতর্ক থাকতেন ময়দানের বিখ‍্যাত ‘ভুতোদা-কোকোদা’ জুটি। আর এখন? প্রত‍্যেকদিন দুপুরে গেলেই দেখা যাবে, ষাটোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক একা চেয়ারে বসে থাকেন। সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে যেন খিদিরপুরের ইতিহাস আগলে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন সেই ভদ্রলোক – বুবুন ওরফে সিদ্ধার্থ বিশ্বাস। ইনি হলেন ভুতনাথ বিশ্বাসের পুত্র। ময়দানে যাকে সবাই ‘বুবুনদা’ নামেই চেনে।

ভুতনাথ বিশ্বাসের দুই পুত্র সিদ্ধার্থ ও অমিতাভ। ক্লাব তাঁবুতে

ভারতীয় ফুটবলে খিদিরপুর ক্লাব আলাদা জায়গা করে নিয়েছিল দুটি মানুষের জন‍্য। ভুতনাথ বিশ্বাস (ভুতদা) এবং ফুটবলার ও কোচ অচ‍্যুৎ ব‍্যানার্জি (কোকোদা)। বিভিন্ন জেলার গ্রামে গিয়ে ফুটবলার তুলে আনতেন ভুতনাথবাবু। আর তাদের তালিম দিতেন কোচ অচ‍্যুৎ ব‍্যানার্জি। ফুটবলার তৈরির কারিগর হিসেবে স‍্যার অচ‍্যুৎ ব‍্যানার্জির নাম ভারতীয় ফুটবলে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। অমল দত্ত, পিকে ব‍্যানার্জিকে শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তাঁরা যত না ফুটবলার তৈরি করেছেন তার থেকে অনেক অনেক বেশি ফুটবলারকে ভারতীয় ফুটবলে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন এই কোকোদা ওরফে স‍্যার অচ‍্যুৎ ব‍্যানার্জি। সাতের দশকে জাতীয় দলের সাপ্লাই লাইন হিসেবে খিদিরপুর ক্লাবকে ধরা হত। কলকাতা লিগে ভাল খেলার সুবাদে ডাক পড়ত মোহনবাগান,ইস্টবেঙ্গল ও মহামেডানে। এই ‘ভুতদা-কোকোদা’ জুটির সাফল‍্য এখনও ময়দানে অমর হয়ে আছে। তাঁদের ফুটবলের প্রতি ডেডিকেশন এখনও আলোচনার চর্চা হয়ে ওঠে।

ভুতনাথ বিশ্বাস

১৯৭৩ সাল। ওই সময়ের একদিন (মাস,তারিখ জানা যায়নি) খিদিরপুর ক্লাবের সর্বময় কর্তা ভুতনাথ বিশ্বাসের ভাইয়ের বিয়ে। বিয়ের দিন সকাল থেকে ভুতনাথবাবুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন মোবাইল ছিল না। যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। বাড়ির সবাই চিন্তিত। বাড়ির গৃহকর্তা যদি না থাকে বিয়ে হবে কি করে? হটাৎ বিয়ের এক ঘন্টা আগে বাড়িতে হাজির। সবার এক প্রশ্ন, “কোথায় ছিলে?” পরিবার সদস‍্যদের উত্তরে ভুতনাথবাবু বলেছিলেন,”প্রদীপকে (দত্ত) সই করিয়ে আনলাম। আজ সই করাতে না পারলে প্রদীপ হাত ছাড়া হয়ে যেত।” আসলে সেই বছর সুরজিৎ সেনগুপ্ত,দিলীপ কয়াল ও শ‍্যামল ঘোষ খিদিরপুর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ভাইয়ের বিয়ের থেকেও তাঁর কাছে একটা ভাল স্ট্রাইকার সই করানোটাই প্রথম পছন্দ ছিল। এই ছিল ভুতনাথ বিশ্বাসের ডেডিকেশন।

স‍্যার অচ‍্যুৎ ব‍্যানার্জি

খিদিরপুর স্পোর্টিংয়ের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯১৭ সালে। শোনা যায় হুগলি নদীর কোল ঘেঁষে কেল্লার মাঠে খিদিরপুরের কিছু যুবক ফুটবল খেলতেন। তাঁরা একদিন একটি ক্লাব করার কথা ভাবলেন। কিন্তু ক্লাবের নাম কি হবে? যেখানে তাঁরা ফুটবল খেলতেন তার কাছেই ছিল নেপিয়ার অফ ম‍্যাকডোল্লা বা কর্নেল নেপিয়ার সাহেবের স্ট‍্যাচু। তাই নেপিয়ার নামেই ক্লাবের নাম করণ (নেপিয়ার স্পোর্টিং ক্লাব) হল। পানবাজারের লক্ষ্মীনারায়ণগঞ্জ লেনে দেওয়ানজীর বাড়িতে ছিল ক্লাবের প্রথম ঠিকানা। ১৯৫৩ সালে নেপিয়ার থেকে হয় খিদিরপুর স্পোর্টিং ক্লাব। আর সেই বছরই প্রথম ডিভিশনে ওঠে খিদিরপুর। কি নেপিয়ার, কি খিদিরপুর – বিখ‍্যাত হওয়ার আগে এই ক্লাবে খেলে গিয়েছেন বহু ফুটবলার। মেওয়ালাল,আন্তালাল,সন্মথ দত্ত থেকে সিআর দাস, বিজন সেন শর্মা, মঙ্গল পুরকায়স্থ সহ এক ঝাঁক তারকা ফুটবলার খেলে গিয়েছেন।

ম‍্যাচ রিপোর্ট

সাতের দশকে এআইএফএফের সচিব ছিলেন খলিফা জিয়াউদ্দিন। তিনি ভুতনাথ বিশ্বাসকে নিজের সন্তানের মতো ভালবাসতেন। ভুতনাথবাবুর ফুটবলের প্রতি ডেডিকেশন জিয়াউদ্দিনকে মুগ্ধ করেছিল। ওই সময়কালে খিদিরপুর অংশ নিত রোভার্স, ডুরান্ড, ডিসিএমের মতো সর্বভারতীয় টুর্নামেন্টে। ফলে এই টুর্নামেন্টে খেলার স্বপ্ন নিয়ে খিদিরপুরে সই করার জন‍্য অপেক্ষা করতেন তরুণ ফুটবলাররা। আর যেহেতু ভুতনাথবাবু জিয়াউদ্দিনের স্নেহের পাত্র ছিলেন সেই কারণে ভারতীয় ফুটবল দলের কথা ভেবে বহু ফুটবলার খিদিরপুর ক্লাবে সই করার জন‍্য মুখিয়ে থাকতেন।

ম‍্যাচ রিপোর্ট

এই ক্লাব শুধু তারকা ফুটবলারদের আঁতুর ঘর ছিল না। বাংলার প্রথম সারির ক্রীড়া সাংবাদিকদের আস্তানাও ছিল এই খিদিরপুর স্পোর্টিং ক্লাব। মতি নন্দী, অজয় বসু, শ‍্যাম সুন্দর ঘোষ, বিপুল ব‍্যানার্জি, নীলিমেশ রায় চৌধুরী থেকে সরোজ চক্রবর্তী, মানস চক্রবর্তী, পূর্নেন্দু চক্রবর্তীরা এই খিদিরপুর ক্লাবে এসে নিজেদের কপি লিখতেন। শ‍্যাম সুন্দর, বিপুলবাবুরা কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাব করার চিন্তা ভাবনা করেছিলেন এই খিদিরপুর ক্লাব থেকেই।

৬ – এর দশকের খিদিরপুর ফুটবল দল

পরবর্তীকালে যতদিন গিয়েছে ক্লাবের গ্রাফ নিচের দিকে নেমেছে। ময়দানের আর পাঁচটা ক্লাবের মতোই লড়াই করে কোনও রকমে বেঁচে আছে। না আছে লোকবল, না আছে অর্থবল। প্রতি বছর ফুটবল ও ক্রিকেট দল গড়েন কর্তারা। এই খিদিরপুর ক্লাবের ফুটবল বিভাগটা দেখেন ভুতনাথ বিশ্বাসের ছোট ছেলে টুলু ওরফে অমিতাভ বিশ্বাস। আর ক্রিকেট দেখেন বুবুন ওরফে সিদ্ধার্থ বিশ্বাস। খিদিরপুর মানেই প্রবীণ কর্তাদের ভিড়। এই বয়সেও সঙ্গে আছেন প্রদ‍্যোৎ বোস,জ‍্যোতিপ্রকাশ মিত্র,তুষার দত্ত রায়, গৌরাঙ্গ বাবু,শঙ্কু বাবুরা খিদিরপুর স্পোর্টিংয়ের সঙ্গে জড়িত। একদিন দূঃখ করে বুবুন ওরফে সিদ্ধার্থবাবু বলছিলেন,”ময়দানের পরিবেশ বদলে গেছে। নতুন প্রজন্মের কেউ আর ক্লাব করতে আসছে না। সব ক্লাবের এক অবস্থা। খুব শীঘ্রই এমন দিন আসছে যে, ক্লাব চালাতে টাকা দিয়ে লোক রাখতে হবে।”

২০২২ এর খিদিরপুর ফুটবল দল

কেন থমকে গেল ক্লাব? খিদিরপুরের ফুটবল সচিব অমিতাভ বিশ্বাস ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে বলছিলেন,”অনেকেই বলে থাকেন, এখনকার ক্লাব কর্তাদের নাকি ডেডিকেশন নেই। আমি বলব, ডেডিকেশন এখনও আছে। ভুলে গেলে চলবে না, বাবারা যখন কাজ করেছেন, তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি অনেক আলাদা। প্রথমত, অর্থের অভাব। দ্বিতীয়ত, বাঙালি ছেলেরা আর ফুটবল খেলতে মাঠে আসছে না। আমাদের বিভিন্ন জেলায় এখনও প্রতিভা আছে। আমরা এখনও ক্লাব করি মাঠের নেশায়। অনেক সমস‍্যা আছে। তবু ক্লাবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।”

খিদিরপুর ক্লাবের সন্ধ‍্যার আড্ডার একটি মুহূর্ত

গত বছরের ভুল শুধরে এবছর ব‍্যালান্সড দল গড়েছেন কর্তারা। দল গড়ার দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন জনৈক ব‍্যবসায়ী আকাশ দাসকে। কোচ দেবরাজ চট্টোপাধ্যায় ফুটবলার বেছে নিয়েছেন নিজের পছন্দ মতো ফুটবলার। এবারের সন্তোষ ট্রফির গোলরক্ষক প্রিয়ন্ত সিংকে খিদিরপুরের হয়ে খেলতে দেখা যাবে। এছাড়াও ময়দানের পরিচিত মুখ প্রশেনজিৎ চক্রবর্তী, ফারুক সেখ, তন্ময় কুন্ডু, সাদ্দাম হোসেন মন্ডল, গৌরব দাসরা দলে আছেন। ডিকসন, অ‍্যাডামা কুলুবালি ও বেঞ্জিমা – এই তিন বিদেশিকে সই করিয়েছেন খিদিরপুর কর্তারা। গত দুই মাস ধরে অনুশীলন করছে। খিদিরপুরের লক্ষ‍্য এবছর প্রিমিয়ার লিগে ‘কাম ব‍্যাক’ করা। “পুরনো দিন কি আর ফিরে পাওয়া যায়? সময় বদলে গেছে। তবে ক্লাবের সুনাম ফিরিয়ে আনার জন‍্য আমরা চেষ্টা করছি।” বলছিলেন অমিতাভ বিশ্বাস।

এবছরের অনুশীলনে খিদিরপুরের ফুটবলাররা।

অভাব আছে। প্রতিকুলতা আছে। তবু ওঁরা এখনও স্বপ্ন দেখেন। ধ্বংসস্তুপের মধ‍্যে থেকেও মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা। বর্তমান সমাজে এমন তো নয় যে, অবক্ষয় শুধু ফুটবলেই! সমাজের কোন স্তরে অবক্ষয় আসেনি? আজ বিধান রায়ের মত ডাক্তার পাওয়া যায়? আমরা আর একটা জগদীশ চন্দ্র বসু, একটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেয়েছি? একটা উত্তম-সুচিত্রা পেয়েছি? এখনও তো মান্না-হেমন্ত-কিশোরের বাইরে কেউ বেরতেই পারিনি। এঁদের সমতুল‍্য কেউ উঠে আসেনি। তবু থামতে নেই, চলতে হয়, এক বুক স্বপ্ন নিয়ে। অতীতের গর্বই ভবিষ্যতের জন্ম দেয়। সেই লক্ষ‍্যেই খিদিরপুর স্পোর্টিং ক্লাব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here