সন্দীপ দে
ভয়ঙ্কর কঠিন সময়ের সামনে এসে পড়েছেন বাংলার কয়েক শো ফুটবলার। পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে এই বছরও যদি কলকাতা ফুটবল লিগ না হয় তাহলে কয়েকশো ফুটবলারের ফুটবল জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে।
এই বছর আইএফএ নতুন উদ্যোগ নিয়ে কলকাতা লিগে বয়স ভিত্তিক করে দিয়েছে। পঞ্চম ডিভিশনের গ্রুপ বি অনূর্ধ্ব – ১৬, পঞ্চম ডিভিশনের এ গ্রুপ অনূর্ধ্ব – ১৭, চতুর্থ ডিভিশন অনূর্ধ্ব – ১৮, তৃতীয় ডিভিশনে অনূর্ধ্ব-১৯ এবং দ্বিতীয় ডিভিশনে অনূর্ধ্ব – ২০। গতবছর করোনার কারণে লিগ হয়নি। এবারও যা পরিস্থিতি তাতে এবারও লিগ অনিশ্চিত। আগস্টে শুরু করার পর যদি করোনার তৃতীয় ঢেউ আসে তাহলে কোনও অবস্থায় লিগ সম্ভব নয়। এবার লিগ না হলে পরপর দুই বছর লিগ বন্ধ মানে একজন ফুটবলারের মারাত্বক ক্ষতি। আর সব থেকে বেশি ক্ষতির সামনে দ্বিতীয় ডিভিশনের ফুটবলাররা।
এই বছর লিগ না হলে যাদের বয়স ১৮ থেকে ২০ বছরের মধ্যে তাদের বেশির ভাগ ফুটবলারদের কার্যত তাদের ফুটবল জীবন শেষ। দ্বিতীয় ডিভিশনের ফুটবলাররা আর নিচের ডিভিশনে খেলতে পারবেন না। আর সবাই যে প্রথম ডিভিশন বা প্রিমায়ারে সুযোগ পাবে তাও নয়। ফল যা দাঁড়াচ্ছে সেই সব ফুটবলারদের বুট, জার্সি ভুলে যেতে হবে।
কলকাতা লিগে দ্বিতীয় ডিভিশনে ১৪ টি ক্লাব আছে। আইএফএ-এর নিয়মে দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাব কর্তারা ৩৫+৫ ফুটবলারদের সই করাতে পারেন। যদি গড় হিসেব করে নূন্যতম ৩০ জন করে ফুটবলারদের সই করানো হয় তাহলে দ্বিতীয় ডিভিশনের ১৪ টি ক্লাবের ফুটবলারের সংখ্যাটা দাঁড়াচ্ছে ৪২০। বয়স চলে যাওয়ার কারণে এই ৪২০ জনের মধ্যে অনেকেই আর নিচের ডিভিশনে খেলতে পারবেন না। এবার যারা প্রথম ডিভিশনে বা প্রিমিয়ারে সুযোগ পেলেন তারা বেঁচে গেলেন। আর যারা সুযোগ পেলেন না তাদের সামনে কলকাতা লিগ খেলা আর হবে না। সেই সংখ্যাটা দাঁড়াবে কয়েকশো।
হুগলি জেলার আভাস কুন্ডু। একটা সময় ইউনাইটেড স্পোর্টসের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৫ আই লিগে খেলেছেন। দুই বছর আগে অনূর্ধ্ব-১৬ ভারতীয় দলের (সাফ কাপ) স্কোয়াডে ছিলেন। গত বছর দ্বিতীয় ডিভিশনে খেললেও এবছর কোনও ক্লাব কর্তারা কথাই বলেননি। আভাসের এখন বয়স ১৯ বছর ছুঁই ছুঁই। এবার লিগ না হলে সামনের বছর আর দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলতে পারবে না। বাবার একখানা মুদিখানার দোকান আছে। ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে আভাস বলছিলেন,”বড়দের দেখেই ফুটবল শুরু করেছিলাম। একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। এবছর লিগ না হলে কি হবে, ভাবতেই পারছি না। সব সময় মাথায় এটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। আচ্ছা দাদা, আপনারা তো রিপোর্টার, অনেক খবর থাকে। লিগ হবে কিনা আপনি বলতে পারবেন দাদা?” আভাসের এমন করূন আর্তি শুনে মন খারাপ হয়ে যায়।
শুধু আভাস নয়, বরনগরের ন’পাড়া কলোনির এক রাজমিস্ত্রীর ছেলে সমীর বায়েন। তারও ১৯ বছর বয়স। প্রথম লকডাউনের আগে সমীর খেলেছেন গরলগাছার হয়ে। তখন তার বয়স ছিল ১৮ বছর। এখন ১৯+। “এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে স্বপ্নেও ভাবিনি। ফুটবল খেলা ছেড়ে দিতে হবে এটা ভাবলেই কান্না এসে যাচ্ছে।” বলছিলেন সমীর।
ডানকুনির ছেলে রিজু দাস। মিডফিল্ডার। গরলগাছার ফুটবলার ছিলেন। এই রিজু ইতিমধ্যে একবছর লিগ না হওয়ায় বয়সের কোপে পড়ে গিয়ে পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় ডিভিশনের কোনও ক্লাবেই খেলতে পারবেন না। কারণ আগামী জুলাই মাসে ২১ বছরে পড়বেন রিজু। “একটা বছর তো চলে গেল। এখন যদি প্রথম ডিভিশনে সুযোগ না পাই তাহলে ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে কোনও কাজের চেষ্টা করতে হবে।” বলছিলেন রিজু দাস।
হাওড়ার আন্দুলের স্টপার সুরেশ দলুই। বয়স আঠারো বছর প্লাস। “এবছর লিগ হলে দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলতে পারব। আর না হলে সব শেষ। আইএফএ যদি আমাদের ব্যাপারটা একটু দেখেন তাহলে খুব ভাল হয়। আপনারা আইএফএকে একটু বলুন না যাতে আমাদের খেলার সুযোগ থাকে।’ইনসাইড স্পোর্টস’কে বলছিলেন সুরেশ।
দ্বিতীয় ডিভিশনের মুসলিম ইনস্টিটিউটের জহিদুল ইসলাম বলছিলেন,”গত বছর আমরা বয়স ভিত্তিক দলকে মাথায় রেখে ট্রায়াল করে মোটামুটি ৩০ জনের দল বেছে রেখেছিলাম। কিন্তু লিগ হল না। এবছর লিগ হলেও আগের বছরের বেছে নেওয়া ফুটবলারদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ফুটবলারকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে। বয়সের কারণে। আমি কিছুদিন আগেও আইএফএ সচিব ও সভাপতিকে অনুরোধ করেছিলাম, এবার বা সামনের বছর যেন বয়স ভিত্তিক না করে। যদি প্রথম একাদশে ৬ জন ওপেন ফুটবললার থাকল আর ৫ জন অনূর্ধ্ব-২০ থাকল। তাহলে ফুটবলাররাও সুযোগ পেল। আর আমাদের দল গড়তেও সুবিধা হল। শেষ পযর্ন্ত কি হবে জানি না। চিন্তায় আছি।”
দ্বিতীয় ডিভিশনের জোড়াবাগানের কর্তা শঙ্কর দাস বলছিলেন,”তুমি যে সমস্যার কথা বলছো, সেটা একদমই ঠিক বলেছো। কিন্তু সমস্যা তো অনেক। আমার মনে হয়, লিগ না হলে সবাকে নিয়ে আইএফএর আলোচনায় বসা উচিত।”
প্রথম ডিভিশনের অনুশীলনী ক্লাবের কর্তা দিলীপ আচার্য বলছিলেন,” আইএফএ-এর বয়স ভিত্তিক ব্যাপারটা খুবই ভাল উদ্যোগ। পাশাপাপাশি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ফুটবলাররা যদি একটু স্বস্তি পায় সেটাও দেখতে হবে। পরপর দুই বছর লিগ না হলে সব ডিভিশনের ফুটবলাররা কিন্তু দুই বছর পিছিয়ে গেল। সমস্যাটা মারাত্মক।”
প্রিমিয়ারের ইউনাটেড স্পোর্টসের কর্তা নবাব ভট্টাচার্য অনুরোধ, ফুটবলারদের কথা ভেবে বয়সের ব্যাপারটা আর একবার রিভিউ করা হোক। নবাববাবুর কথায়,”স্বাধীনতার পর থেকে দ্বিতীয় ডিভিশন থেকে পঞ্চম ডিভিশন নিয়ে কেউ গুরুত্ব দিয়ে ভাবেনি। আইএফএ-এর নতুন বডি গুরুত্ব দিয়ে বয়স ভিত্তিক করার চেষ্টা করেছে। এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। পাশাপাশি আমি আইএফএ-র চেয়ারম্যান, সভাপতি ও সচিবের কাছে প্রস্তাব দেব, বয়সের ব্যাপারটা আর একবার রিভিউ করা হোক। যেহেতু অতিমারি করোনার জন্য লিগ অনিশ্চিত তাই বয়সের ব্যাপারটা একটু বদল করা যায় তাহলে ফুটবলারদের পক্ষে ভাল হবে। তারপর এটা কন্টিনিউ প্রসেস। ভাল হবে কি খারাপ হবে তা দেখার জন্য একটু সময় দিতেই হবে। তবু বলছি, আমি এখনও আশাবাদী। লিগ হবে। সেই অপেক্ষায় আছি।”
এই পরিস্থিতিতে কি ভাবছেন আইএফএ সচিব জয়দীপ মুখার্জি? ‘ ইনসাইড স্পোর্টস’কে জয়দীপ মুখার্জি জানালেন,”আমরা সত্যি এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আইএফএ লক্ষ্য বাংলার ফুটবলের উন্নয়ন। তার জন্য আর্থিক স্বচ্ছলতা আনতে হবে। আর সুষ্ঠুভাবে সব টুর্নামেন্ট করতে হবে। কিন্তু করোনার জন্য আমাদের লক্ষ্যে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেক বছর প্রায় ৬ হাজার ফুটবলার নাম নথিভুক্ত করে। এই ৬ হাজার ফুটবলারকে টিকা দিয়ে খেলানো খুব সমস্যা। এত টিকার টাকা জোগার করা সমস্যার। যদি কোন স্পনসর এগিয়ে আসে তাহলে উপকৃত হব। আর বয়স ভিত্তিক ব্যাপারটা সমস্ত ক্লাবের মতামত নিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ক্লাব নিয়েই তো আইএফএ। অদুর ভবিষ্যতে কি হবে আমরা কেউ জানি না। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা সমস্ত ক্লাবের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নেব। তবু আমি আশা রাখি, সব সমস্যা মিটে যাবে। আবার ফুটবল শুরু হবে।”